গানের আড়াল কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । চক্রবাক কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ১৯টি। এই কাব্যে নজরুল বেদনার ছবি তুুুলে ধরেছেন; এতে রয়েছে প্রেমের অনুুুভূতি এবং অতীত সুুখের স্মৃতিচারণা।

গানের আড়াল কবিতা
তোমার কন্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কন্ঠের গান -- এইটুকু শুধু রবে পরিচয় ? আর সব অবসান ? অন্তরতলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়, গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয় ? হয়তো কেবলি গাহিয়াছি গান, হয়ত কহিনি কথা, গানের বানী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা ? হৃদয়ে কখন জাগিল জোয়ার, তাহারি প্রতিধ্বনি কন্ঠের তটে উঠেছে আমার অহরহ রণরণি' -- উপকূলে ব'সে শুনেছ সে সুর, বোঝ নাই তার মানে ? বেঁধেনি হৃদয়ে সে সুর, দুলেছে দু'ল হয়ে শুধু কানে ? হায় ভেবে নাহি পাই -- যে - চাঁদ জাগালো সাগরে জোয়ার, সেই চাঁদই শোনে নাই । সাগরের সেই ফুলে ফুলে কাদা কূলে কূলে নিশিদিন ? সুরেরে আড়ালে মূর্চ্ছনা কাঁদে, শোনে নাই তাহা বীণ ? আমার গানের মালার সুবাস ছুঁল না হৃদয়ে আসি' ? আমার বুকের বাণী হল শুধু তব কন্ঠের ফাঁসি?
বন্ধু গো যেয়ো ভুলে -- প্রভাতে যে হবে বাসি, সন্ধায় রেখো না সে ফুল তুলে ! উপবনে তব ফোটে যে গোলাপ -- প্রভাতেই তুমি জাগি' জানি, তার কাছে যাও শুধু তার গন্ধ-সুষমা লাগি' । যে কাঁটা লতায় ফুটেছে সে-ফুল রক্তে ফাটিয়া পড়ি' সারা জনমের ক্রন্দন যার ফুটিয়াছে শাখা ভরি' দেখ নাই তারে ! -- মিলন মালার ফুল চাহিয়াছ তুমি, তুমি খেলিয়াছ বাজাইয়া মোর বেদনার ঝুমঝুমি ! ভোল মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়, আমি শুধু তব কন্ঠের হার, হৃদয়ে কেহ নয় ! জানায়ো আমারে যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি-- কন্ঠ পারায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি !

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।

চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- তোমারে পড়িছে মনে
- বাদল-রাতের পাখি
- স্তব্ধ রাতে
- বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি
- কর্ণফুলী
- শীতের সিন্ধু
- পথচারী
- মিলন-মোহনায়
- গানের আড়াল
- তুমি মরে ভুলিয়াছ
- হিংসাতুর
- বর্ষা-বিদায়
- সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে
- অপরাধ শুধু মনে থাক
- আড়াল
- নদীপারের মেয়ে
- ১৪০০ সাল
- চক্রবাক
- কুহেলিকা