মোবারকবাদ কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর নতুন চাঁদ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । নতুন চাঁদ কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। প্রকাশক ছদরুল আনাম খান, মোহাম্মদী বুক এজেন্সী, ৮৬এ, লোয়ার সার্কুলার রোড, কলকাতা এতে রয়েছে নজরুলের ১৯টি কবিতা ।

মোবারকবাদ কবিতা
মোরা ফোটা ফুল, তোমরা মুকুল এসো গুল-মজলিশে
ঝরিবার আগে হেসে চলে যাব – তোমাদের সাথে মিশে।
মোরা কীটে-খাওয়া ফুলদল, তবু সাধ ছিল মনে কত–
সাজাইতে ওই মাটির দুনিয়া ফিরদৌসের মতো।
আমাদের সেই অপূর্ণ সাধ কিশোর-কিশোরী মিলে
পূর্ণ করিয়ো, বেহেশ্ত এনো দুনিয়ার মহফিলে।
মুসলিম হয়ে আল্লারে মোরা করিনিকো বিশ্বাস,
ইমান মোদের নষ্ট করেছে শয়তানি নিশ্বাস!
ভায়ে ভায়ে হানাহানি করিয়াছি, করিনি কিছুই ত্যাগ,
জীবনে মোদের জাগেনি কখনও বৃহতের অনুরাগ!
শহিদি-দর্জা চাহিনি আমরা, চাহিনি বীরের অসি,
চেয়েছি গোলামি, জাবর কেটেছি গোলামখানায় বসি।
তোমরা মুকুল, এই প্রার্থনা করো ফুটিবার আগে,
তোমাদের গায়ে যেন গোলামের ছোঁয়া জীবনে না লাগে।
গোলামের চেয়ে শহিদি-দর্জা অনেক ঊর্ধ্বে জেনো;
চাপরাশির ওই তকমার চেয়ে তলোয়ারে বড়ো মেনো!
আল্লার কাছে কখনও চেয়ো না ক্ষুদ্র জিনিস কিছু,
আল্লাহ্ ছাড়া কারও কাছে কভু শির করিয়ো না নিচু!
এক আল্লাহ্ ছাড়া কাহারও বান্দা হবে না, বলো,
দেখিবে তোমার প্রতাপে পৃথিবী করিতেছে টলমল!
আল্লারে বলো, ‘দুনিয়ায় যারা বড়ো, তার মতো করো,
কাহাকেও হাত ধরিতে দিয়ো না, তুমি শুধু হাত ধরো।’
এক আল্লারে ছাড়া পৃথিবীতে কোরো না কারেও ভয়
দেখিবে – অমনি প্রেমময় খোদা, ভয়ংকর সে নয়!
আল্লারে ভালোবাসিলে তিনিও ভালোবাসিবেন, দেখো!
দেখিবে সবাই তোমারে চাহিছে আল্লারে ধরে থেকো!
খোদার বাগিচা এই দুনিয়াতে তোমরা নব মুকুল,
একমাত্র সে আল্লাহ্ এই বাগিচার বুলবুল!
গোলামের ফুলদানিতে যদি এ মুকুলের ঠাঁই হয়,
আল্লার কৃপা-বঞ্চিত হব, পাব মোরা পরাজয়!
যে ছেলেমেয়ে এই দুনিয়ায় আজাদমুক্ত রহে,
তাহাদেরই শুধু এক আল্লার বান্দা ও বাঁদি কহে!
তারাই আনিবে জগতে আবার নতুন ঈদের চাঁদ,
তারাই ঘুচাবে দুনিয়ার যত দ্বন্দ্ব ও অবসাদ!
শুধু আরশের আতরদানিতে যাহাদের হয় ঠাঁই,
তোমাদের এই মহফিলে আমি সেই মুকুলেরে চাই!
সেই মুকুলেরা এসো মহফিলে, বসাও ফুলের হাট,
এই বাংলায় তোমরা আনিয়ো মুক্তির আরফাত।

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তার জীবন শুরু হয়েছিল অ কিঞ্চিত কর পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজন্যদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জন প্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্ত র্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।

নতুন চাঁদ কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- নতুন চাঁদ
- চির-জনমের প্রিয়া
- আমার কবিতা তুমি
- নিরুক্ত
- সে যে আমি
- অভেদম্
- অভয় সুন্দর
- অশ্রু-পুস্পাঞ্জলী
- কিশোর রবি
- কেন জাগাইলি তোরা
- দুর্বার যৌবন
- আর কতদিন
- ওঠ রে চাষী
- মোবারকবাদ
- কৃষকের ঈদ
- চাষীর ঈদ
- আজাদ
- ঈদের চাঁদ
- চাঁদনী রাতে