শৈশব লীলা কবিতা টি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । মরুভাস্কর কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। হজরত মোহাম্মদ সঃ এর জীবনী নিয়ে চারটি সর্গে ১৮ টি খণ্ড-কবিতা নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ।

শৈশব লীলা কবিতা
খেলে গো ফুল্লশিশু ফুল-কাননের বন্ধু প্রিয়
পড়ে গো উপচে তনু জ্যোৎস্না চাঁদের রূপ অমিয়।
সে বেড়ায়, হীরক নড়ে,
আলো তার ঠিকরে পড়ে!
ঘোরে সে মুক্ত মাঠে পল্লিবাটে ধরার শশী,
সে বেড়ায় – শুষ্ক মরুর শুক্লা তিথি চতুর্দশী।
অদূরে স্তব্ধগিরি মৌনী অটল তপস্বী-প্রায়,
পায়ে তার পুষ্প-তনু কন্যা যেন উপত্যকায়।
শিরে তার উদার আকাশ,
ব্যজনী দুলায় বাতাস।
বয়ে যায় গন্ধ শিলায় ঝরনা নহর লহর লীলায়,
যেতে সে খোশবুপানি ছিটায় কূলের ফুলমহলায়!
পাখি সব শিস দিয়ে যায় কিশমিশেরই বল্লরিতে,
আকাশ আর বনদেবীতে মন বিনিময় নীল হরিতে।
মাঝে তার ফুল্লশিশু বেড়ায় খেলে ফুল-ভুলানো,
বুকে তার সোনার তাবিজ নিখিল আলোক দোল-দোলানো।
কভু সে দুম্বা চরায় সাধ করে হয় মেষের রাখাল,
কভু তার দৃষ্টি হারায় দূর সাহারায়, যায় কেটে কাল।
অচপল মৌনী পাহাড় মন হরে তার, রয় বসে সে,
খেলাতে মন বসে না যায় হারিয়ে নিরুদ্দেশে।
অসীম এই বিশাল ভুবন
ওগো তার স্রষ্টা কেমন!
কে সে জন করল সৃজন বিচিত্র এই চিত্রশালা?
মেষেরা যায় হারিয়ে, মুগ্ধ শিশু রয় নিরালা।
কভু সে বংশী বাজায়, উট-শিশুরা সঙ্গে নাচে,
ভুলে নাচ বেড়ায় খুঁজে কে যেন তায় ডাকছে কাছে।
সহসা আনমনা হয় সঙ্গীজনের সংগীতে সে,
চোখে তার কার অপরূপ বেড়ায় রূপের ভঙ্গি ভেসে।
সাথি সব ভয় পেয়ে যায় চক্ষুতে তার এ কোন জ্যোতি!
ও আঁখি নীল সুঁদিফুল সুন্দরেরে দেয় আরতি।
ও যেন নয় গো শিশু, পথভোলা এক ফেরেশতা কোন
ও যেন আপন হওয়ার ছল করে যায়, নয়কো আপন।
হালিমা ভয়-চকিতা রয় চেয়ে গো শিশুর পানে,
ও যেন পূর্ণ জ্ঞানী, সকল কিছুর অর্থ জানে।
কে জানে কাহার সাথে কয় সে কথা দূর নিরালায়,
কে জানে কাহার খোঁজে যায় পালিয়ে বনের সীমায়।
কভু সে শিশুর মতো,
কভু সে ধেয়ান-রত।

একী গো পাগল তবে, কিংবা ভূতে ধরল এরে,
এনে হায় পরের ছেলে পড়ল কী কু-গ্রহের ফেরে!
স্বামী তার বলল ভেবে, “শোন হালিমা, কাল সকালে
দিয়ে আয় যাদের ছেলে তাদেরকাছে, নয় কপালে
আছে সে বদনামি ঢের, নাই এ গ্রামে ভূতের ওঝা,
কাবাতে ‘লাত মানাতের‘ কৃপায় এ ভূত হবেই সোজা!”
হালিমা অশ্রু মুছে মোহাম্মদে আনল আবার
হারানো মাতৃক্রোড়ে, বললে, ‘লহো পুত্র সোনার!’
আমিনার বক্ষ বেয়ে অশ্রু ঝরে আকুল স্নেহে,
ওরে মোর সোনার দুলাল আজ ফিরেছে আঁধার গেহে!
এল আজ মুত্তালিবের চোখের মণি, শান্তি শোকের,
এল আজ সফর করে সফর চাঁদে চাঁদ মুসাফের!
পারায়ে কৃষ্ণা তিথি শুক্লা তিথির আসল অতিথ,
কত সে দিনের পরে আঁধার ঘরে উঠল রে গীত!
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তার জীবন শুরু হয়েছিল অ কিঞ্চিত কর পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।
মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজন্যদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জন প্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্ত র্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি।
এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।

মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
প্রথম সর্গ
- অবতরণিকা
- অনাগত
- অভ্যূদয়
- স্বপ্ন
- আলো-আঁধারি
- দাদা
- পরভৃত
দ্বিতীয় সর্গ
- শৈশব-লীলা
- প্রত্যাবর্তন
- “সাক্কুস সাদ্র” (হৃদয় উন্মোচন)
- সর্বহারা
তৃতীয় সর্গ
- কৈশোর
- সত্যাগ্রহী মোহাম্মদ
চতুর্থ সর্গ
- শাদী মোবারক
- খদিজা
- সম্প্রদান
- নও কাবা
- সাম্যবাদী