শাদী মোবারক কবিতা টি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । মরুভাস্কর কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। হজরত মোহাম্মদ সঃ এর জীবনী নিয়ে চারটি সর্গে ১৮ টি খণ্ড-কবিতা নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ।

শাদী মোবারক কবিতা
মোদের নবি আল-আরবি সাজল নওশার নওল সাজে ; সে রূপ হেরি নীল নভেরই কোলে রবি লুকায় লাজে॥ আরাস্তা আজ জমিন আশমান হুরপরি সব গাহে গান, পূর্ণ চাঁদের চাঁদোয়া দোলে, কাবাতে নৌবত বাজে॥ কয় ‘শাদি মোবারক বাদি’ আউলিয়া আর আম্বিয়ার, ফেরেশতা সব সওদা খুশির বিলায় নিখিল ভুবন মাঝে॥ গ্রহ তারা গতিহারা চায় গগনের ঝরোকায়, খোদার আরশ দেখছে ঝুঁকে বিশ্ব-বধূর হৃদয়-রাজে॥ আয়রে শাপী দুঃখী তাপী আয় হবি কে বরাতী, শাফায়তের শিরীন শিরনি পাবি না আর পাবি না যে॥
বিপুল বিত্ত-শালিনী ‘খদিজা’ ছিল আরবের চিত্ত-রানি,
রূপ আর গুণে পূজিত তাহায় মুগ্ধ আরব অরর্ঘ্য দানি।
স্তুতি গাহি তার যশ মহিমার হার মেনে যেত কবির ভাষা,
শুভ ভাগ্যের সায়র-সলিলে সে ছিল সোনার কমল ভাসা!
শুদ্ধাচারিণী সতী সাধ্বী সে ছিল আজন্ম, তাই সকলে
শ্রদ্ধা ভক্তি প্রীতি-ভরা নামে ডাকিত তাহারে ‘তাহেরা’ বলে।
হজরতের আর খদিজার ছিল একই গোষ্ঠী বংশ-শাখা,
আরব-পূজ্য যশোমণ্ডিত ত্যাগ-সুন্দর গরিমা-মাখা।
বীর ‘আবুহানা’ বিবি খদিজার আছিল প্রথম জীবন-সাথি,
মৃত্যু আসিয়া হরিল তাহারে, খদিজার প্রাণে নামিল রাতি।
বিধবার বেশে রহি কতকাল বরিল খদিজা ‘আতীক’ বীরে,
জীবনের পারে সে-ও গেল চলি, আসিল শোকের তিমির ঘিরে।
সে শোকের স্মৃতি শিশুদের বুকে চাপি ভুলে রয় বুকের ব্যথা,
দ্বি-বিংশতি গো বৎসর গেল কাটি জীবনের, কেমন কোথা।
এমন সময় এল আহমদ তরুণ অরুণ ভাগ্যাকাশে,
পাণ্ডুর নভ ভরিল আবার আলো-ঝলমল ফুল্ল হাসে।
পঁচিশ বছরি যুবক তখন নবি আহমদ রূপের খনি,
সারা আরবের হৃদয়-দুলাল কোরেশ-কুলের নয়ন-মণি।
‘সাদিক’ – সত্যবাদী বলে তারা ডাকিত নবিরে ভক্তিভরে,
যুবক নবিরে ‘আমিন’ বলিয়া ডাকিত এখন আদর করে।
বিশ্বাস আর সাধুতায় তাঁর মক্কাবাসীরা গেল গো ভুলি
মোহাম্মদের আর সব নাম ; কায়েম হইল ‘আমিন’ বুলি।
‘আমিন’ ‘তাহেরা’ সাধু ও সাধ্বী, ইঙ্গিতে ওগো খোদারই যেন
আরববাসীরা না জানিয়া এই নাম দিয়েছিল তাদেরে হেন!
মহান খোদারই ইঙ্গিতে যেন ‘সাধু’ ও সাধ্বী’ মিলিল আসি,
শক্তি আসিয়া সিদ্ধির রূপে সাধনার হাত ধরিল হাসি।
গিরি-ঝরনার স্রোতোবেগে আসি যোগ দিল যেন নহর-পানি,
ঊষর মরুর ধূসর বক্ষে বান ডেকে গেল উদার বাণী!
মরুর আকাশে ঘনাল যে ছায়া, বক্ষ ছাইল যে শীতলতা,
সুজলা সুফলা ধরা যুগে যুগে হেরেছে স্বপ্নে ইহারই কথা।

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তার জীবন শুরু হয়েছিল অ কিঞ্চিত কর পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।
মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজন্যদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জন প্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্ত র্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।
মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
প্রথম সর্গ
- অবতরণিকা
- অনাগত
- অভ্যূদয়
- স্বপ্ন
- আলো-আঁধারি
- দাদা
- পরভৃত
দ্বিতীয় সর্গ
- শৈশব-লীলা
- প্রত্যাবর্তন
- “সাক্কুস সাদ্র” (হৃদয় উন্মোচন)
- সর্বহারা
তৃতীয় সর্গ
- কৈশোর
- সত্যাগ্রহী মোহাম্মদ
চতুর্থ সর্গ
- শাদী মোবারক
- খদিজা
- সম্প্রদান
- নও কাবা
- সাম্যবাদী
