নজরুল সংগীতের গায়কী : প্রতিজন মানুষ স্বতন্ত্র। সেই মানুষই গীতিকার ও সুরকার হন। তাই তাদের স্বতন্ত্র চরিত্র অনুযায়ী, তাদের লেখা ও সুর স্বতন্ত্র হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সেই স্বতন্ত্র বজায় রাখে হবে, নাকি সেটি পরিবর্তন হতে পারে, সেটা সবসময় একটা বিতর্কের বিষয়। এখন ধরা যাক – একজন গীতিকার তার জীবদ্দশায়, তার গানের যেমন সুর পছন্দ করেছিলেন, সেটি বজায় রাখলে, গীতিকার যে দৃষ্টিভঙ্গিতে গানটি রচনা করেছেন, তা বজায় থাকে।
![নজরুল সংগীতের গায়কী বিতর্ক [ Nazrul Sangeet ] 2 নজরুল সংগীতের গায়কী Kazi Nazrul Islam Colorize, Wikipedia, ShareAlike 4.0 International (CC BY-SA 4.0)](http://amarnazrul.com/wp-content/uploads/2021/09/Kazi-Nazrul-Islam-Colorize-Wikipedia-ShareAlike-4.0-International-CC-BY-SA-4.0-223x300.jpg)
একই বিষয় সুর ও সুরকারের ক্ষেত্রেও। আবার এটিও ঠিক যে কোন গীতিকার লেখা, অন্য সুরকারের সুর করা একটি গান, ভবিষ্যতে আর কোন প্রতিভাবান মানুষ এসে, সেটাকে আরও শানিত ও যুগপোযগী করে, মানুষের অনুভবের আরও কাছাকাছি পৌঁছে দিতে পারে। দুটি সম্ভাবনার কোনটিকেই একেবারে ফেলে দেয়া যায় না।
কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও সুনির্দিষ্ট। কারণ তিনি নিজে লিখেছেন এবং সুর করেছেন। তার উপরেও যে বিষয়টি আছে তা হলো, তার জীবদ্দশায় তিনি সেই গান নিজে নির্দেশনা দিয়ে শিল্পীদের দিয়ে গাইয়েছেন, রেকর্ড করিয়েছেন। তাই নজরুলের জীবদ্দশায় তার গানের অর্থাৎ নজরুল সংগীতের গায়কী একটা মানদণ্ড বা স্ট্যান্ডার্ড ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তবে মানদণ্ড মানে এক ধরণের স্থিরতাও। সেই স্থিরতা ভালো কি খারাপ, সেটা অবশ্য ভিন্ন বিতর্ক।
![নজরুল সংগীতের গায়কী বিতর্ক [ Nazrul Sangeet ] 3 শিষ্যদের সঙ্গীত শিক্ষা দিচ্ছেন কাজী নজরুল ইসলাম](http://amarnazrul.com/wp-content/uploads/2022/01/শিষ্যদের-সঙ্গীত-শিক্ষা-দিচ্ছেন-কাজী-নজরুল-ইসলাম-300x217.jpg)
সেই মানদণ্ড থেকে নড়াচড়া করলে তা নিয়ে বিতর্ক হবে এটাই স্বাভাবিক। নজরুল সংগীতের গায়কী নিয়েও আমরা মাঝে মধ্যেই সেই বিতর্ক দেখি। নজরুলের ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি নিজে গান শিখিয়েছেন বহু শিল্পীর। তাই তার কাছে প্রশিক্ষিত এবং নির্দেশনায় গাওয়া শিল্পীরা তার সেই মানদণ্ডের অংশ। তারাও সেই রক্ষণশীলতার একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা প্রাচীর।
তার গায়কী পরিবর্তন হতে দেয়া ঠিক হবে কি না, সেই বিতর্কের কোন উপসংহার আমরা টানছি না। সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর এর এই গুরুকুলে এই বিষয়ক উপসংহার টানাকে সমর্থন করে না। বরং আমরা যেমন রক্ষণশীলতার পক্ষে যারা বলেছেন, তাদের মতামত খুব শ্রদ্ধা ভরে জানতে-শুনতে চাই, একই ভাবে যারা পরিবর্তন এর পক্ষে বলছেন, তাদের মতটিও যত্নসহকারে শোনার প্রয়োজন মনে করি। এটিই আমাদের শিক্ষার আদর্শ।
একদল আছেন যারা বলছেন- আগের সময়ের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত – ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুকরির মতো অথরিটেটিভ ও রক্ষণশীল গায়কী বিগত শতকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এমন বিশুদ্ধ শিল্প যদি পরিবর্তিত হতে পারে, তবে নজরুলের গান নয় কেন? আবার এরকম রক্ষণশীল গায়নরীতি যদি যুগোপযোগী করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে, তবে নজরুলের গানের ক্ষেত্রে কেন সেটা নয়?
জনাব প্রদীপ কুমার নন্দী তার লিখিত “বাংলা গান ও নজরুলসঙ্গীত প্রসঙ্গ” গ্রন্থে নজরুল সংগীতের গায়কী বিষয়ে লিখেছেন – আজকাল জনপ্রিয় শিল্পীদের দিয়ে নজরুলসঙ্গীত গাওয়াবার একটা অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। জনপ্রিয় শিল্পীর কণ্ঠ ও শিক্ষা নজরুলসঙ্গীতের উপযোগী হোক বা না হোক বর্তমানের জনপ্রিয় শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানোর ফলে নজরুলসঙ্গীত অধিক জনপ্রিয় হবে-এই রকম একটা অবাস্তব চিন্তা উদ্যোক্তাদের মনে ক্রিয়া করছে। ফলে নজরুলসঙ্গীত সাময়িক জনপ্রিয়তা পেলেও তার মান ক্রমশ ক্ষুণ্ণ হতে থাকবে। অদূর ভবিষ্যতে নজরুলসঙ্গীত তার গায়কী ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলবে।
অর্থ ব্যয় করে অযোগ্য কণ্ঠ একক সঙ্গীতের অনুষ্ঠান করা যায়, কাগজে অনুকূল সমালোচনা বার করা যেতে পারে। কিন্তু এর দ্বারা ব্যক্তি বিশেষের প্রচার ছাড়া নজরুলসঙ্গীতের মান উন্নত হবে না বরঞ্চ ক্রমশ নিম্নগামী হবে। সুতরাং পক্ষপাতমুক্ত হয়ে সামগ্রিকভাবে চেষ্টা করা দরকার যাতে নজরুলসঙ্গীতের অবিকৃত চরিত্র ও গায়কী অক্ষুণ্ণ থাকে।
কবির কীর্তিকে একটি পূর্ণাঙ্গ মানসিক বিকাশ হিসেবেই ধরা উচিত। নতুবা কবিকে একপেশে ও ছোটো করা হয়। কোনো কোনো ব্যক্তি ও সমালোচক কবিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ হতে বিচার করে তাঁর আধ্যাত্মিক সঙ্গীতগুলিকে স্বীকার করতে চান না। কিন্তু চারণ-কবি মুকুন্দদাসের মতো কবি নজরুলেরও সৃষ্টির উৎস ছিল তাঁর আধ্যাত্মিক অনুভূতি ও মূল্যবোেধর উপর। নজরুল যে-সব শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন তা রামপ্রসাদ-কমলাকান্তের প্রকৃত উত্তর সাধকের বলা যেতে পারে। ‘বলরে, জবা বল’ অথবা ‘আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে’-এই রকম দু-একটি গানের দ্বারাই নজরুল অমর হয়ে থাকতে পারতেন। যেমন অপূর্ব রচনা তেমনই অপূর্ব সুর যোজনা। নজরুলকে শুধুমাত্র উদ্দীপক গানের স্রষ্টা বললে ভুল হবে।
মানুষের প্রেম ও ভালোবাসায় নজরুলের প্রতি রক্তবিন্দু রঙিন। তাঁর সাড়ে তিন হাজারের গানের অনেকখানি জুড়ে রয়েছে এই কাব্য-সঙ্গীত । কিন্তু তাঁর কাব্য সঙ্গীতে রয়েছে একটি বিশেষ গায়কী আধুনিক ও লঘু-সঙ্গীত হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। নজরুল ভারতীয় সঙ্গীত শৈলীর প্রায় সমস্ত সঙ্গীতের উপরই সঙ্গীত রচনা করেছেন তাতে সুর যোজনা করেছেন। এছাড়া কিছু বিদেশী সুর নিয়েও বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন।
যেমন-‘রুম ঝুম, রুম ঝুম খেজুর পাতায়’ বা ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ অথবা ‘দূর দ্বীপাসিনী’ ইত্যাদি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী এই জাতীয় সঙ্গীতগুলোর মধ্যে দিয়ে নজরুলের প্রকৃত গায়কী পাওয়া যাবে না। বর্তমানে নজরুলের এই জাতীয় সঙ্গীতগুলিই আসরে নতুন নতুন নজরুল-শিল্পীরা বেশি গেয়ে থাকেন।
এগুলো কবির কতগুলি এক্সপেরিমেন্ট। কবির গানের সত্যকার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর গাজল গানে, ঠুংরি ভাঙা গানে, তাঁর চৈতী, কাজরী, রাগপ্রধান গাাানে। নজরুলের অভিনব সৃষ্টি হলো তাঁর গজল। মনে হয় নজরুলই সর্বপ্রথম বাংলাগানে গজল গানের প্রবর্তন করে বাংলাসঙ্গীতকে করেছেন সমৃদ্ধশালী। তাই তাঁর সব ধরনের গানের গায়কীর অবস্থানটি লক্ষ করেই শিল্পীর পরিবেশন করা উচিত।
আসুন দুপক্ষের যুক্তিগুলো মনোযোগ সহকারে পাঠ করি। এরপর আমাদের নিজেদের শিক্ষা, আদর্শ এবং সৃজনশীলতা দিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত নেই।
[ নজরুল সংগীতের গায়কী ]
নজরুল সংগীত সম্পর্কে আরও পড়ুন:
- উইকিপিডিয়া : নজরুলগীতি
- নজরুলের গান – রাগ নির্ভরতা
“নজরুল সংগীতের গায়কী বিতর্ক [ Nazrul Sangeet ]”-এ 11-টি মন্তব্য