খোকার গপ্প বলা কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। ঝিঙেফুল বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ । বইটি বাংলা আশ্বিন মাসে ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিল ডিএম লাইব্রেরি, ৬১ নম্বর কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট, কলিকাতা। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছিল- বীর বাদলকে ।
খোকার গপ্প বলা কবিতা
মা ডেকে কন, ‘খোকন-মণি! গপ্প তুমি জানো? কও তো দেখি বাপ!’ কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে এক লাফ বললে খোকন, ‘গপপ জানি, জানি আমি গানও!’ বলেই খুদে তানসেন সে তান জুড়ে জোর দিল – ‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল!’ মা সে হেসে তখন বলেন, ‘উহুঁ, গান না, তুমি গপ্প বলো খোকন!’ ন্যাংটা শ্রীযুত খোকা তখন জোর গম্ভীর চালে সটান কেদারাতে শুয়ে বলেন, “সত্যিকালে এক যে ছিল রাজা আর মা এক যে ছিল রানি, হাঁ মা আমি জানি, মায়ে পোয়ে থাকত তারা, ঠিক যেন ওই গোঁদলপাড়ার জুজুবুড়ির পারা! একদিন না রাজা – ফড়িং শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড়ভাজা! রানি গেলেন তুলতে কলমি শাক বাজিয়ে বগল টাক ডুমাডুম টাক!
রাজা শেষে ফিরে এলেন ঘরে হাতির মতন একটা বেড়াল-বাচ্চা শিকার করে। এসে রাজা দেখেন কিনা বাপ! রাজবাড়িতে আগড় দেওয়া, রানি কোথায় গাপ! দুটোয় গিয়ে এলেন রাজা সতরোটার সে সময়! বলো তো মা-মণি তুমি, খিদে কি তায় কম হয়? টাটি-দেওয়া রাজবাড়িতে ওগো, পান্তাভাত কে বেড়ে দেবে? খিদের জ্বালায় ভোগো! ভুলুর মতন দাঁত খিঁচিয়ে বলেন তখন রাজা, নাদনা দিয়ে জরুর রানির ভাঙা চাই-ই মাজা। এমন সময় দেখেন রাজা আসচে রানি দৌড়ে সারকুঁড় হতে ক্যাঁকড়া ধরে রাম-ছাগলে চড়ে! দেখেই রাজা দাদার মতন খিচমিচিয়ে উঠে –” ‘হাঁরে পুঁটে!’ বলেই খোকার শ্রীযুত দাদা সটান দুইটি কানে ধরে খোকার চড় কসালেন পটাম্। বলেন, ‘হাঁদা! ক্যাবলাকান্ত! চাষাড়ে। গপ্প করতে ঠাঁই পাওনি চণ্ডুখুড়ি আষাঢ়ে? দেব নাকি ঠ্যাংটা ধরে আছাড়ে? কাঁদেন আবার! মারব এমন থাপড়, যে কেঁদে তোমার পেটটি হবে কামার শালার হাপর!’ চড় চাপড় আর কিলে, ভ্যাবাচ্যাকা খোকামণির চমকে গেল পিলে! সেদিনকারের গপ্প বলার হয়ে গেল রফা, খানিক কিন্তু ভেড়ার ভ্যাঁ ডাক শুনেছিলুম তোফা!
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।
ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- খাঁদু-দাদু
- খুকি ও কাঠবেড়ালি
- খোকার খুশি
- খোকার গপ্প বলা
- খোকার বুদ্ধি
- চিঠি
- ঝিঙে ফুল
- ঠ্যাং-ফুলি
- দিদির বে-তে খোকা
- পিলে-পটকা
- প্রভাতি
- মা
- লিচু চোর
- হোঁদলকুতকুতের বিজ্ঞাপন