হোঁদলকুতকুতের বিজ্ঞাপন কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। ঝিঙেফুল বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ । বইটি বাংলা আশ্বিন মাসে ১৩৩৩ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিল ডিএম লাইব্রেরি, ৬১ নম্বর কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট, কলিকাতা। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছিল- বীর বাদলকে ।

হোঁদলকুতকুতের বিজ্ঞাপন কবিতা
মিচকে-মারা কয় না কথা মনটি বড়ো খুঁতখুঁতে।
‘ছিঁচকাঁদুনে’ ভ্যাবিয়ে ওঠেন একটু ছুঁতেই না ছুঁতে।
ড্যাবরা ছেলে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থেকে গাল ফুলান,
সন্দেশ এবং মিষ্টি খেতে – বাসরে বাস – এক জাম্বুবান!
নিম্নমুখো-যষ্টি ছেলে দশটি ছেলে লুকিয়ে খান,
বদমায়েশির মাসি পিসি, আধখানা চোখ উঁচিয়ে চান!
হাঁদারা হয় হদ্দ বোকার, সব কথাতেই হাঁ করে!
ডেঁপো চতুর আধ-ইশারায় সব বুঝে নেয় ঝাঁ করে!
ভোঁদা খোকার নামটি ভুঁদো বুদ্ধি বেজায় তার ভোঁতা।
সব চেয়ে ভাই ইবলিশ হয় যে ছেলেদের ঘাড় কোঁতা।
পুঁয়ে-লাগা সুঁটকো ছেলে মুখটা সদাই মুচকে রয়!
পেটফুলো তার মস্ত পিলে, হাত-পাগুলোও কুঁচকে রয়!
প্যাঁটরা ছেলের য়্যাব্বড়ো পেট, হাত নুলো আর পা সরু!
চলেন যেন ব্যাংটি হো হো উ-র্ গজ-ঢাক গাল পুরু!
গাবদা ছেলের মনটি সাদা একটুকুতেই হন খুশি,
আদর করে মা তারে তাই নাম দিয়েছেন মনটুসি।
ষাঁড়ের নাদ সে নাদুস নুদুস গোবর-গণেশ যে শ্রীমান,
নাঁদার মতন য়্যাভ ভুঁড়ি তাঁর চলতে গিয়ে হুমড়ি খান!
ছ্যাঁচড় ছেলে বেদড় ভারি ধুমসুনি খায় সব কথায়।
উদমো ছেলে ছটফটে খুব একটুকুতেই উতপুতায়!
ফটকে ছেলে ছটকে বেড়ায় আঁটি তারা বজ্জাতের,
দুষ্টু এবং চুলবুলেরা সবখানে পায় লজ্জা ঢের।
বোঁচা-নাকা খাঁদা যে হয় নাম রেখো তার চামচিকে,
এসব ছেলে তেঁদড় ভারী ডরায় না দাঁত-খামচিকে!
টুনিখুকির মুখটি ছোটো টুনটুনি তার মন সরল,
ময়না-মানিক নাম যার ভাই মনটি তারও খুব তরল!
গাল টেবো যাঁর নাম টেবি তাঁর একটুকুতেই যান রেগে।
কান-খড়কে মায়ের লেঠা, রয় ঘুমুলেও কান জেগে।
খুদে খুকির নামটি টেপু মা-দুলালি আবদেরে।
ডর-পুকুনে আঁতকে ওঠে নাপতে দেখে আঁক করে!
পুঁটুরানি বাপ-সোহাগি, নন্দদুলাল মানিক মা-র,
দাদু বুড়োর ন্যাওটা যে ভাই মটরু ছাগল নামটি তার!
ভুতো ছেলে ঠগ বড়ো হয়, ভয় করে না কাউকে সে,
নাই পরোয়া যতই কেন কিল আর থাপড় দাও ঠেসে।
দস্যি ছেলে ভয় করে না চোখ-রাঙানি ভূত-পেরেত,
সতর-চোখি জুজুর খোঁজে বেড়িয়ে বেড়ায় রাত বিরেত!
ডানপিটেরা ঝুলঝাপপুর গুলি-ডাণ্ডায় মদ্দ খুব!
বাঁদরা-মুখোর ভ্যাংচিয়ে মুখ দাঁত খিঁচে বে-হদ্দ হুব!
বীর বাদল সে – দেশের তরে প্রাণ দিতে ভাই যে শিখে,
আনবে যে সাত-সাগর-পারের বন্দিনী দেশ-লক্ষ্মীকে!
কেউ যদি ভাই হয় তোমজদের এমনিতরো মর্দ ফেরো,
হো হো! তাকে পাঠিয়ে দেব বাচ্চা হোঁদল কুতকুতের!

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।

১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।
ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- খাঁদু-দাদু
- খুকি ও কাঠবেড়ালি
- খোকার খুশি
- খোকার গপ্প বলা
- খোকার বুদ্ধি
- চিঠি
- ঝিঙে ফুল
- ঠ্যাং-ফুলি
- দিদির বে-তে খোকা
- পিলে-পটকা
- প্রভাতি
- মা
- লিচু চোর
- হোঁদলকুতকুতের বিজ্ঞাপন