বিদ্রোহী কবিতাটি বিদ্রোহী কাজী নজরুলের বিখ্যাত কবিতাসমূহের একটি। কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ধূমকেতুতে (২২ আগস্ট ১৯২২) ছাপা হয়। প্রকাশিত হওয়া মাত্রই এটি ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি “চির উন্নত শির” বিরাজমান।

কবিতাটির প্রথম প্রকাশ নিয়ে মতভেদ রয়েছে।প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘বিদ্রোহী কবিতা বিজলীতে প্রকাশেরও আগে মোসলেম ভারত এ প্রকাশিত হয়।
বিদ্রোহী বিদ্রোহী ইতিহাস ও পটভূমি:
১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে কাজী নজরুল ইসলাম তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুজাফফর আহমেদের সাথে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে, যখন তারা কলকাতার তালতলা লেনে বসবাস করছিলেন, নজরুল কবিতাটি লেখেন। মুজাফফর আহমেদের মতে, কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ৬ জানুয়ারি ১৯২২ সালে সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায়। প্রকাশের পর, কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং দ্য মোসলেম ভারত , প্রবাসী , মধুমতি এবং সাধনা ম্যাগাজিন সহ অন্যান্য কিছু পত্রিকাও কবিতাটি প্রকাশ করে। কবিতাটি প্রথম ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত অগ্নিবীণা বইয়ে অন্যান্য ১১টি কবিতার সাথে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন:
“ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব, বাংলা সাহিত্যের এসব পটভূমি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে। ”
![বিদ্রোহী কবিতা । অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম 3 Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]](/wp-content/uploads/2022/01/Kazi-Nazrul-Islam-15-300x300.jpg)
বিদ্রোহী কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম
বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর –
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর –
আমি চির উন্নত শির!
আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর –
চির-উন্নত মম শির!
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল;
আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা!
আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর!
বল বীর –
আমি চির উন্নত শির!
আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;
আমি কৃষ্ন-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধীর।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর –
চির – উন্নত মম শির!
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার,
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!
আমি কভূ প্রশান্ত কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভোন্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহা কল্লোল,
আমি উদ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্জ্বল,
আমি উচ্ছ্বল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণু, তন্বী-নয়নে বহ্ণি
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বন্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ – জ্বালা, প্রিয় লান্চিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়
চিত চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন!
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমি উথ্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্ণি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সন্চারি ভুবনে সহসা সন্চারি’ ভূমিকম্প।
ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’ –
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’।
আমি দেব শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব মায়ের অন্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম
ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠি’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!
আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না –
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর –
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
![বিদ্রোহী কবিতা । অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম 5 Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]](/wp-content/uploads/2022/01/Kazi-Nazrul-Islam-14.jpg)
বিদ্রোহী কবিতা জনপ্রিয়তা:
বিজলী পত্রিকায় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি, ২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ শুক্রবারে প্রথম কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতাটি প্রকাশের পর হতেই নজরুল সকলের কাছে পরিচিত হতে থাকে এবং নানানভাবে সমাদৃত হতে থাকে। সে সময় বিজলী পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলো নলিনীকান্ত সরকার।
বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশনার ঐদিন বিজলী পত্রিকা পরপর দুই বার ছাপতে হয়েছিল, যার সংখ্যা ছিলো ২৯ হাজার। মুজাফফর আহমদের কাছ থেকে জানা যায়, সেদিন কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ বিদ্রোহী পড়েছিল। ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ উপলক্ষে জাতীয় কবির সমাধিস্থলে অনুষ্ঠিত হয়েছে শত কন্ঠে বিদ্রোহী কবিতা পাঠ। এ পাঠের আয়োজন করে নজরুল চর্চা কেন্দ্র বাঁশরী।
![বিদ্রোহী কবিতা । অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম 6 Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]](/wp-content/uploads/2022/01/Kazi-Nazrul-Islam-16-300x200.jpg)
বিদ্রোহী কবিতা নিয়ে বিতর্ক:
মুজফফর আহমদ -এর বই হতে জানা যায়, ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হওয়ার পর কবি মোহিতলাল মজুমদার দাবী করেছিলেন যে, তার ‘আমি’ শীর্ষক একটি লেখার ভাব নিয়ে নজরুল কবিতাটি লিখেছে, কিন্তু কোন ঋণ স্বীকার করেনি। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত ও ‘বিংশ শতাব্দী’-তে লিখেছিলেন, মোহিতলাল মজুমদারের ‘আমি’ প্রবন্ধের ভাববস্তুর সঙ্গে নজরুলের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির সাদৃশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। তবে অন্যান্য সাহিত্যিকগণ এবং মুজফফর আহমদ নিজেও তাদের সেই দাবিকে সম্পূর্ণরূপে নাকোচ করে দেন।
বিদ্রোহী কবিতাটি অন্যান্য মাধ্যমে ব্যবহার:
১৯৪৯, মতান্তরে ১৯৫২ সালে সংক্ষিপ্তাকারে ‘বিদ্রোহী’র সুর করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম সংগীতগুরু, লোক ও নজরুলসংগীতশিল্পী এবং সুরকার গিরীন চক্রবর্তী। আর এতে কন্ঠ দিয়েছিলেন সংগীতশিল্পী শেখ লুৎফর রহমান এবং অভিনেতা ও গায়ক আরিফুল হক। ১৯৬৫ সালে বিদ্রোহী’ কবিতায় সম্পূর্ণ নতুন এবং আধুনিক জোড়ালো একটি সুরারোপ করেছিলেন বাংলাদেশের শহীদ গায়ক ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ।
ভারতীয় চিত্রনায়ক জিৎ অভিনীত এবং ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র ‘দ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ এবং ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় বাংলা ভাষার নাট্যধর্মী চলচ্চিত্র ‘কণ্ঠ’-তে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটি ব্যবহৃত হয়েছে।
![বিদ্রোহী কবিতা । অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম 7 Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]](/wp-content/uploads/2022/01/Kazi-Nazrul-Islam-32-300x203.jpg)
বিদ্রোহী কবিতার মূলভাব | বিদ্রোহী কবিতা ব্যাখ্যা :
কাজি নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক তীব্র আলোড়ন উপস্থিত করেন। একদিকে এই কবিতা পড়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভা কবিকে স্বাগত জানান, আপামর জনসাধারণ নজরুলকে তাদের প্রাণের কবি হিসাবে বরণ করে নেন। অন্যদিকে কবি ব্রিটিশ সরকারের ক্রোধ-দৃষ্টিতে পড়েন, সজনীকান্ত দাসের নেতৃত্বে তাঁর বিরোধী এক কবি-সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয় যারা ব্যঙ্গে, বিদ্রূপে কবিকে অস্থির করে তোলেন।
কবি ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যে বিদ্রোেহ উপস্থিত করেছেন এবং ‘আমি’ বলে যে শক্তিকে মূর্ত করে তুলেছেন তার প্রকৃতি সম্বন্ধে বিরোধী ব্যাখ্যাই কবিতাটি সম্পর্কে এই মিশ্র প্রতিক্রিয়ার কারণ। সুতরাং প্রথমেই কবি ‘আমি’ বলতে কী বলতে চেয়েছেন তা বোঝবার চেষ্টা করা দরকার।
‘আমি’ বলতে প্রাথমিকভাবে কবি নিশ্চয়ই তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ই তুলে ধরতে চাইছেন, কিন্তু এই পরিচয়কে কবির প্রাত্যহিক জীবনের ধূলি-মলিন পরিচয় ভাবলে অবিচার করা হবে। প্রত্যেক আত্মসচেতন ব্যক্তির মধ্যে থকে দুটি সত্তা—একটি তার প্রতিদিনের পরিচয় বহন করে, আর একটি তার বিরাটত্বের পরিচয়বাহী। প্রাত্যহিক সত্তার থাকে অহংকার, বৃহত্তম সত্তার থাকে অহংবোধ ।
রবীন্দ্রনাথ এই দুটি সত্তাকেই বোঝাতেই চেয়েছেন ‘ক্ষুদ্র-আমি’ ও ‘বিরাট আমি’ বলে। দর্শনের ভাষায় বলা যায় এই ‘বিরাট-আমি’ মানুষের এক ধরনের ‘ego’ বা আত্মব্যক্তিত্ব । এই অহংবোধ মানুষের মধ্যে অকস্মাৎ জাগ্রত হয়ে তাকে এক বিরাট মানসিক শক্তি দান করে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও একদিন এই শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘প্রভাত সংগীতের’ কবিতাগুলি রচনা করেন। নজরুল ইসলাম মনের মধ্যে সেই শক্তির প্রেরণাতেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং নিজের সেই বৃহত্তর সত্তাকে প্রকাশ করেছেন ‘আমি’ হিসাবে।
কিন্তু ‘আমি’ বলতে শুধুই ব্যক্তিগতভাবে কবিকে মনে করা ঠিক হবে না—এ ‘আমি’ কোনো বিশেষ ‘আমি’ নয়, এর পরিচয় আরও বিস্তৃত। কবি এখানে নতুন যুগের মানুষের চিত্তজাগরণের অগ্রদূত, তিনি শুধু নিজের মুক্তিই অনুভব করেননি—তাঁর মনে প্রাণে জেগেছে নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করার নেশা। কবি কেবলমাত্র নিজে স্বাধীন, একথা উচ্চারণ করেননি, তিনি সদ্য জাগ্রত মানুষের অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে তাদেরও চিত্তজাগরণের মন্ত্রপাঠ করিয়েছেন। কবিতার প্রথমেই তিনি ওই সব জাগ্রত চেতনায় মানুষকে আহ্বান করে বলেছেন—
“বল বীর
চির উন্নত মম শির।”
সুতরাং এর পর ‘আমি’ হিসাবে যে কথা তিনি বলতে চেয়েছেন সে আমি কেবল কবি হতে পারেন না—সে আমি আসলে মুক্তি পাগল প্রতিটি মানুষ। কবির সংকল্প প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেকটি মানুষেরই সংকল্প। সুতরাং আমি বলতে শুধুমাত্র কবি নিজে নন, তিনি যাদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন তাদেরও বোঝানো হয়েছে।

কবি এখানে যে বিদ্রোহের কথা শুনিয়েছেন তার সঠিক প্রকৃতি বোঝা সহজ নয়, কারণ কবি সমগ্র কবিতাতেই উচ্ছ্বসিত। কখনো তিনি ধ্বংসের কথা বলেছেন, কখনো বলেছেন ত্রাস সঞ্চারের কথা, কখনো পৌরাণিক ঋষির সঙ্গে নিজের তুলনা করেছেন, কখনো বা অন্তরের অন্তঃস্থলে হয়েছেন রোমাতি। বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করলে বলা যায়, কবির বিদ্রোহ ঘন ঘন দিক পরিবর্তন করেছে–কখনো তিনি দৈব-প্রভাব ক্ষুণ্ণ করতে চেষ্টা করেন, কখনো তিনি পৃথিবীর সমস্ত নিয়মকানুন ধ্বংস করার চেষ্টা করেন, কখনো সৃষ্টিকেই করতে চান ধূলিসাৎ, আবার কখনো তাঁর বিদ্রোহ পৃথিবীর ক্ষত্রিয় জাতির প্রতি, রণদুর্মদ শক্তির প্রতি, যে-কোনো অত্যাচারী প্রভুত্বের প্রতি।

কবির এই বিদ্রোহকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে এক কথায় প্রকাশ করতে গেলে বলতে হবে, তাঁর এই বিদ্রোহ মানুষের যে কোনো ধরনের পরাধীনতার বিরুদ্ধে। মানুষকে সর্বক্ষেত্রে স্বাধীন করবার জন্যই তাঁর এই উদার আহ্বান। মানুষের পরাধীনতা শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়–নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, সব ক্ষেত্রেই তার বশ্যতা এবং অবসাদ থাকতে পারে; সেই সর্বক্ষেত্রের অবসাদ ও অধীনতা দূর করার জন্যই কবি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তাই ক্ষত্রিয়কে নির্মূল করার কথাও যেমন কবি বলেন, তেমনি একথা বলতেও তাঁর বাঁধে না—
“আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান্ বুকে এঁকে দেবো পদ–চিহ্ন।”
সুতরাং কবির এই বিদ্রোহকে অবসন্ন ও পরাধীন মানুষকে সর্বক্ষেত্রে উন্নত চিত্ত স্বাধীন করার এক বলিষ্ঠ আহ্বান মনে করা যেতে পারে।
কবির বিদ্রোহের প্রকৃতি সঠিকভাবে বুঝতে পারলে বিদ্রোহের লক্ষ্যবস্তু কে, সে কথা বোঝাও কঠিন হবে না। মানুষকে যেসব শক্তি অবদমিত করে রেখেছে, উৎপীড়নের চাপে তার স্বাধীন সত্তা বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছে—তারই বিরুদ্ধে কবির বিদ্রোহ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের মানুষের স্বাধীনতা গুঁড়িয়ে দিয়েছে উৎপীড়নের চাপে, তাই কবি সগর্বে বলেছেন—
“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন–রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ–ভূমে রণিবে না–
বিদ্রোহী রণ–ক্লস্ত
আমি সেই দিন হব শাস্ত।”
কিন্তু মানুষের অধীনতা শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, ধর্মীয় অত্যাচারও মানুষের চিত্তকে অবসাদগ্রস্ত করে রাখে, তাই কবি দেবতার বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহের কথা ঘোষণা করেছেন, বলেছেন তিনি বিশ্ব-বিধাত্রীর বিদ্রোহী সূত-গোলক ভেদ করে তাঁর উন্নত শির মহাকাশের ওপরে গিয়ে পৌঁছবে।
এই পৃথিবীতে সামাজিক সংস্কারও পদে পদে মানুষকে শৃঙ্খলিত করছে। তাই কুসংস্কারের অন্ধতায় ভরা এই পৃথিবীর বিরুদ্ধেও তাঁর বিদ্রোহ। তিনি বলেন—
“আমি দাবানল দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।”
অন্যত্র তিনি বলেছেন—
“আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।”
লক্ষণীয়, তিনি বিদ্রোহ করবেন শুধু ধ্বংস করতে নয়, তাকে শুদ্ধ করতেও। পৃথিবীকে তিনি দহন করতে চান শুধু ধ্বংসের কারণে নয়, তাকে অগ্নিশুদ্ধ করার কারণে, পৃথিবীকে উৎপাটিত করতে চান নবসৃষ্টির জন্যই। এখানেই কবির বিদ্রোহের সার্থকতা।
আরও পড়ুন: