কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্ট রাগ ও তাল সমূহ : কাজী নজরুল তার জীবদ্দশায় প্রচুর প্রচলিত ও অপ্রচলিত হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগে গান বেঁধেছেন। পাশাপাশি তিনি নতুন কিছু রাগ সৃষ্টি করেছিলেন। সেই রাগগুলো অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। আজ জানবো সেসব রাগের আরোহ, আবরোহ, সহ কারিগরি বিষয়গুলো। তাছাড়া নজরুল কিছু তাল নিয়েও কাজ করেছিলেন। সেগুলো সম্পর্কেও জানবো।
কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্ট রাগ ও তাল সমূহ
রাগ-অরুণ ভৈরব :
আরোহনে ধা ণা সা ঝা সা গা মা, দা পা, ণা ধা সা অবরোহ : সা ণা ধা ণা পা মা দা পা মা গা মা ঝা সা। জাতি : বক্রসম্পূর্ণ। বাদী : মধ্যম। সমবাদী : ষড়জ (সা)। এই রাগে রে ও নি স্বর দুটি কোমল। এ ছাড়া ধা স্বরটি শুদ্ধ ও কোমলরূপে প্রযুক্ত হয়ে থাকে। এটিও বজ্রগতির রাগ। গান- জাগো অরুণ ভৈরব জাগো হে, শিবধ্যানী।/ শোনাও তিমির ভীত বিশ্বে নব দিনের বাণী।
রাগ-রুদ্র ভৈরব :
আরোহ: সা ঝা মা দা, ণা র্সা। অবরোহ : সা ণা দা মা ঝ সা। জাতি : ঔড়ব। বাদী : ধৈবত (রা); সমবাদী: ঋষভ (রে)। এই রাগে রে, ধ ও নি স্বর তিনটি কোমল। এ ছাড়া বাকি সব স্বর শুদ্ধ। উত্তরাঙ্গে এই রাগটি গীত হয়ে থাকে। গান-এস শঙ্কর ক্রোধাগ্নি, হে প্রলয়ঙ্কর রুদ্রভৈরব সৃষ্টি সংহর।
রাগ-আশা ভৈরবী :
আরোহ: সা ঝা জ্ঞাসা ঝা মা, পা দা ণা পা দাসা। অবরোহ : সা, দা পা মা ঝা সা। জাতি : সম্পূর্ণ ঔড়ব। সম্পূর্ণ বাদী : পঞ্চম (পা); সমবাদী ঃ ষড়জ (সা)। এই রাগে রে, গ, ধ ও নি স্বরগুলি কোমল। রাগ-শিবানী-ভৈরবী : আরোহ: সা রা জ্ঞা পা, দা সা। আরোহঃ সারা জ্ঞা সা ণা দা পা, মা জ্ঞা সা। জাতি : ঔড়ব-সম্পূর্ণ। বাদী ষড়জ (সা); সমবাদী : পঞ্চম (পা)। এই রাগে গ, ধ ও নি স্বরগুলি কোমল। এছাড়া বাকি সব স্বর শুদ্ধ। গান ভগবান শিব জাগো জাগো, ছাড়িয়ে গেছেন দেবী শিবান সতী।
রাগ-রক্তহংস সারং:
আরোহ: সারা মা পা ধা সা। অবরোহ : সা না পা মা রা সা। জাতি ঔড়ব-ঔড়ব। বাদী: পঞ্চম (পা)। সমবাদী; ঋষভ (রা)। এই রাগে সব স্বরই শুদ্ধ। গান বলরাঙা হংসদৃতী তার বারতা দাও তা’র বিরহ-লিপি, বল সে কোথা।
রাগ-সন্ধ্যামালতী:
আরোহ্ : নাসা, জ্ঞারাসা, গামাপা, গাধামা, পানার্সা। অবরোহ : সা না দা পা হ্মা জ্ঞা রা সা। জাতি ঃ বক্র সম্পূর্ণ। বাদী : পঞ্চম (পা); সমবাদী : ষড়জ (সা)। এই রাগে গ ধ ও নি স্বরগুলি কোমল ও শুদ্ধরূপে প্রয়োগ হয়ে থাকে এবং মাধ্যম অর্থাৎ মা তীব্র। গান শোন ও সন্ধ্যামাতলী বালিকা তপতী বেলা শেষের বাঁশী বাজে।
রাগ-বনকুন্তলা :
আরোহ: পা ধা সা রা, গা পা ধা পা ধা না। অবরোহ সা না ধা পা গা রা, গা সা। জাতি : বজ্রগতির ঔড়ব-যাড়ব। বাদী : পঞ্চম (পা)। সমবাদী : ষভ (রা)। এই রাগে সব সর শুদ্ধ-গান! বনকুন্তল এলায়ে।
রাগ-বেণুকা :
আরোহ: সারা মা, পাণা ধা পা ধা মা পা ধা না। অবরোহ : সা না পা ধা না, গা রা গা সা। জাতি : বজ্রগতির ষাড়ব-ষাড়ব। বাদী: মধ্যম (মা)। সমবাদী ষড়জ (সা)। এই রাগে আরোহ গতিতে কোমল নি ব্যবহার হয়ে থাকে, এছাড়া বাকী সব স্বর শুদ্ধ। এটি বজ্রগতির রাগ। গান-রেণুকা ও কে বাজায় মহুয়া বনে। রাগ-উদাসী ভৈরব : আরোহ: সা, ঝা, গা, মা, ক্ষমা, ক্ষণসা, বার্সা। অবরোহ : কাণাহ্মা মা, মা গা ঝা সা। জাতি : বক্রগতির ঔড়ব-ঔড়ব। বাদী মধ্যম (মা) সমবাদী : ষড়জ (সা)।
এই রাগে রে ও নিস্বর দুটি কোমল এবং উভয় প্রকার মধ্যম ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ললিত রাগের সহিত এই রাগের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। গান-সতী-হারা উদাসী ভৈরব কাদে/বিষাণ ত্রিশুল ফেলি’ গভীর বিষাদে।
রাগ-শঙ্করী:
আরোহ: সা গা পা না ধার্সা। অবরোহ: সা না পা, গা পা গা পা, গা সা। জাতি : ঔড়ব-ঔড়ব। বাদী: গান্ধার (গা); সমবাদী: নিষাদ (নি)। এই রাগে অবরোহে কেবলমাত্র কোমল নি প্রয়োগ হয়ে থাকে। এছাড়া বাকী সব স্বর শুদ্ধ। গান-শঙ্কর অঙ্গলীনা যোগমায়া শঙ্করী শিবানী। /বালিকা সমলীলাময়ী নীল উৎপল পাণি।
রাগ-যোগিনী:
আরোহ: সা ঝাজ্ঞা হ্মা দা পা, মা পা ণা দা পা সা। অবরোহ: সা না দা পা. পাহ্মাগা, মা, মাঝা সা। জাতি : বক্র সম্পূর্ণ। বাদী : পঞ্চম (পা)। সমবাদী : ষড়জ (সা)। এই রাগে রে ও ধ স্বর দুটি কোমল। এছাড়া ম তীব্র ও শুদ্ধরূপে এবং গ ও নি কোমল ও শুদ্ধরূপে প্রয়োগ হয়ে থাকে। গান-শান্ত হও শিব, বিরহ-বিহ্বল চন্দ্রলেখায় বাঁধ জটাজুট পিঙ্গল।
রাগ-শিব সরস্বতী :
আরোহ: দা না সা গা মা, দা পা, জ্ঞা মা সা। অবরোহ সা না দা মা, দা পা মা জ্ঞা মা সা। জাতি: ষাড়ব-ষাড়ব। বাদী মধ্যম (মা)। সমবাদী: ষড়জ (সা)। এই রাগে গ স্বরটি কোমল ও শুদ্ধ উভয়-রূপেই প্রয়োগ হয়। এছাড়া ধ স্বরটিও কোমল।
রাগ-নির্ঝরিণী :
আরোহ: সা পা গা মা পা র্সা। অবরোহ: সাদা পা মা গা মা য়া সা। বাদী : পঞ্চম; সমবাদী ষড়জ (না)। গান-রুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম্ কে বজায়/জল ঝুমঝুমি/ চমকিয়া জাগে ঘুমন্ত বনভূমি। রাগ-রূপমঞ্জুরী : আরোহ: সারা মা পা না সা। অবরোহ: সা না ধা পা গা মা রা গা, সা রা না সা। জাতি : ঔড়ব-সম্পূর্ণ। বাদী: পঞ্চম (পা): সমবাদী ষড়জ (রা)। এই রাগে ব্যবহৃত সব স্বরই শুদ্ধ। গান পায়েলা বোলে রিণিঝিণি/নাচে রূপমঞ্জরী শ্রীরাধার সঙ্গিনী।
রাগ-অরুণ রঞ্জনী:
আরোহ: সা, জ্ঞা, পা, হ্মা, পা দাসা। অবরোহ: সা, গা, দা পা, জ্ঞা, ঝা, সা। জাতি : ঔড়ব-ষাড়ব। বাদী পঞ্চম (পা); সমবাদী : ষড়জ (সা)। এই রাগ রে, গ, ধ ও নি স্বরগুলি কোমল এবং মৃ স্বরটি তীব্ররূপে প্রয়োগ হয়ে থাকে। গান-হাসে আকাশে শুকতারা হাসে/অরুণ রঞ্জনী-ঊষার পাশে।
অরুণ রঞ্জনী সম্পর্কে আরও দেখুন ..
রাগ-দেবযানী:
আরোহ: সা রা পা পা ধা রা পা, ণা ধা নাসা। অবরোহ : সা ণা ধা পা রা সা। জাতি : ঔড়ব-ঔড়ব। বাদী : পঞ্চম (পা); সমবাদী : ঋষভ (রে)। এই রাগে কেবলমাত্র নি স্বরটি কোমল, এছাড়া বাকী সব শুদ্ধ। গান-দেবযাণীর মনে প্রথম প্রীতির কলি জাগে/ কাঁপে অধর-আঁখি অনুরাগে। রাগ-দোলন চাঁপা : আরোহ: সাগা হ্মা পা, গা মা না ধা, পা না ধা সা। অবরোহ : সা না ধা না ধা পা হ্মা, পা, গা মা রা সা। জাতি : ষাড়ব-সম্পূর্ণ। বাদী : পঞ্চম (পা)। সমবাদী ষড়জ (রা)। এই রাগে ম স্বরটি তীব্র ও শুদ্ধরূপে প্রয়োগ হয়ে থাকে, এছাড়া বাকী সব স্বরটি শুদ্ধ। গান-দোলনচাঁপা বনে দোলে দোলে পূর্ণিমা রাতে/চাঁদের সাথে।
রাগ-মীণাক্ষী :
আরোহ: ণা ধা সা ণা রা, গা মা পা গা মা পা ধা র্সা। অবরোহ : সা ণা ধা মা পা, দা পা মা জ্ঞা রা, গা সা। জাতি : বজ্রগতির সম্পূর্ণ। বাদী : ঋষভ (রে); সমবাদী : পঞ্চম (পা)। এই রাগে অবরোহে নি স্বরটি কোমল এবং অবরোহে গ ও ধ স্বর দুটি কোমল ও শুদ্ধরূপে প্রয়োগ হয়ে থাকে। গান-চপল আঁখির । ভাষায়, হে মীণাক্ষি ক’য়ে যা/না-বলা কোন্ বাণী বলিতে চাও।
নজরুল সৃষ্ট তাল
নজরুল ইসলাম তাঁর রচিত গানে তালের বৈচিত্র্যতার জন্যে ৬টি তাল সৃষ্টি করেন, তালগুলো নিম্নরূপ:
১. প্রিয়াছন্দ:
মাত্রাসংখ্যা-৭ (২।৩।২) ছন্দঃ। ১২। ১২৩।১২।
গান : মহুয়া বনে বন পাপিয়া।
২. মনিমালা ছন্দ:
মাত্রা সংখ্যা-২০ (২।৪।২।২।২।৪।২।২) ছন্দ ১২। ৩৪৫৬। ৭৮। ৯১০। ১১১২। ১৩১৪১৫১৬। ১৭১৮৷ ১৯২০
গান: মনজু মধুছন্দা নিত্য তব সঙ্গী
৩. মঞ্জু ভাষিনী ছন্দ :
মাত্রা সংখ্যা-১৮ (২। ৩। ৫।৩।৩(২)
ছন্দ। ১২। ৩৪৫। ৬৭৮৯১০। ১১১২১৩। ১৪১৫১৬। ১৭১৮
৪. স্বাগতা ছন্দ :
মাত্রা সংখ্যা-১৬ (৩।৫।৪।২।২)
ছন্দ: । ১২৩। ৪৫৬৭৮ | ৯১০১১১২। ১৩১৪। ১৫১৬।
গান : স্বাগতা নককচম্পক বর্ণা।
৫. মন্দাকিনী ছন্দ:
মাত্রা সংখ্যা-১৬ (৬াত।হাত।২)
ছন্দঃ। ১২৩৪৫৬৭৮৯।১০১১। ১২ ১৩ ১৪ ১৫ ১৬৷
গান : জল ছল ছল এস মন্দাকিনী।
৬. নবনন্দনঃ
মাত্ৰাসংখ্যা-২০(৪৪81818)
ছন্দ: ১২৩৪৫৬৭৮৷ ৯১০১১১২। ১৩১৪১৫১৬। ১৭১৮১৯২০।
গান : দেবযানীর মনে প্রথম প্রীতির কলি জাগে।
আরও পড়ুন: