চাঁদনী-রাতে কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সিন্ধু হিন্দোল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । সিন্ধু হিন্দোল কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থে মোট ১৯টি কবিতা রয়েছে। কাব্যগ্রন্থটি “বাহার ও নাহার”-কে (হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও শামসুন নাহার) উৎসর্গ করেন।

চাঁদনী-রাতে কবিতা
কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে, হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্বুদ, জোছনা সোনায় রাঙে। তৃতীয় চাঁদের ‘শাম্পানে’চড়ি চলিছে আকাশ-প্রিয়া, আকাশ দরিয়া উতলা হল গো পুতলায় বুকে নিয়া। তৃতীয়া চাঁদের বাকি ‘তেরো কলা’আবছা কালোতে আঁকা, নীলিম প্রিয়ার নীলা ‘গুল রুখ’ অবগুণ্ঠনে ঢাকা। সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রানি, সেহেলি ‘লায়লি’ দিয়ে গেছে চুপে কুহেলি-মশারি টানি। দিকচক্রের ছায়া-ঘন ওই সবুজ তরুর সারি, নীহার নেটের কুয়াশা-মশারি – ও কি বর্ডার তারই? সাতাশ তারার ফুল-তোড়া হাতে আকাশ নিশুতি রাতে গোপনে আসিয়া তারা-পালঙ্কে শুইল প্রিয়ার সাথে।
উহু উহু করি কাঁচা ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে নীলা হুরি, লুকিয়ে দেখে তা ‘চোখ গেল’বলে চেঁচায় পাপিয়া ছুঁড়ি! ‘মঙ্গল’তারা মঙ্গল-দীপ জ্বালিয়া প্রহর জাগে, ঝিকিমিকি করে মাঝে মাঝে – বুঝি বঁধুর নিশাস লাগে। উল্কা-জ্বালার সন্ধানী-আলো লইয়া আকাশ-দ্বারী ‘কাল-পুরুষ’ সে জাগি বিনিদ্র করিতেছে পায়চারি। সেহেলিরা রাতে পলায়ে এসেছে উপবনে কোন আশে, হেথা হোথা ছোটে পিকের কণ্ঠে ফিক ফিক করে হাসে। আবেগে সোহাগে আকাশ-প্রিয়ার চিবুক বাহিয়া ও কি শিশিরের রূপে ঘর্মবিন্দু ঝরে ঝরে পড়ে সখী, নবমী চাঁদের সসারে ও কে গো চাঁদিনি-শিরাজি ঢালি বধূর অধরে ধরিয়া কহিছে – ‘তহুরা পিয়ো লো আলি!’ কার কথা ভেবে তারা-মজলিশে দূরে একাকিনী সাকি চাঁদের সসারে কলঙ্ক-ফুল আনমনে যায় আঁকি!... ফরহাদ-শিরী লায়লি-মজনুঁ মগজে করেছে ভিড়, মস্তানা শ্যামা দধিয়াল টানে বায়ু-বেয়ালার মিড়! আনমনা সাকি! অমনি আমরাও হৃদয়-পেয়ালা-কোণে কলঙ্ক-ফুল আনমনে সখী লিখো মুছো ক্ষণে ক্ষণে!

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।

সিন্ধু হিন্দোল কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ
- সিন্ধুঃ দ্বিতীয় তরঙ্গ
- সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ
- গোপন প্রিয়া
- অনামিকা
- বিদায় স্মরণে
- পথের স্মৃতি
- উন্মনা
- অতল পথের যাত্রী
- দারিদ্র্য
- বাসন্তি
- ফাল্গুনী
- মঙ্গলাচরণ
- বধু-বরণ
- অভিযান
- রাখী-বন্ধন
- চাঁদনী-রাতে
- মাধবী-প্রলাপ
- দ্বারে বাজে ঝঞ্জার জিঞ্জির