কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী [ Kazi Nazrul Islam Biography ] : ক্ষণজন্মা কবি, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীতবিদ, সমাজকর্মী কাজী নজরুল ইসলামের কর্মজীবন সময়ের হিসেবে সংক্ষিপ্ত। তবে তার এই সংক্ষিপ্ত জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল। উত্থান, পতন, সৃষ্টি, প্রলয়ে ভরা তার জীবনটি ছিল তার কবিতার মতই গতিময়। তাকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে জানা বোঝা প্রায় অসম্ভব বলাই ভালো।
কাজী নজরুল ইসলামকে বিস্তারিত ভাবে জানতে হলেও কোন না কোন জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। তাই শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা কাজী নজরুল ইসলামের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশ করলাম। এর পর তার জীবনীর অনেক বিস্তারিত বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করবো। আপাতত এক নজরে দেখে আসি তার জীবনকাল।
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী [ সংক্ষিপ্ত ]
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম [ Birth of Kazi Nazrul Islam ] :
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীর প্রথম আলোচনায় আসে তার জন্মের বিষয়টি। কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে রোজ মঙ্গলবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
কাজী নজরুল ইসলামের বংশ পরিচয় [ Family History Genealogy of Kazi Nazrul Islam ] :
মোঘল রাজত্বকালে তার পূর্ব পুরুষ সেখানকার বিচারালয়ের কাজী ছিলেন। পরবর্তীতে বংশানুক্রমে কাজী পদবী অলংকৃত করলেও তাদের সার্বিক অবস্থা নিন্মমুখী হয়ে পড়ে। কাজী নজরুলের পিতামহ ও পিতা তাদের বাড়ি সংলগ্ন হাজী পাহলোয়ানের মাজার শরীফ এবং মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করে পরিবারের ভরনপোষন করতেন।
কাজী নজরুল ইসলামের পিতা-মাতার পরিচয় [ Fatehr-Mother of Kazi Nazrul Islam ] :
কাজী নজরুল ইসলামের পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন।
কাজী নজরুল ইসলামের শৈশব [ Chieldhood of Kazi Nazrul Islam ] :
কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর চারপুত্রের অকাল মৃত্যুর পর নজরুলের জন্ম হওয়ায় তার নাম রাখা হয়েছিল, দুখু মিয়া। সত্যি দুঃখের মধ্যেই কেটেছে তার সারাটি জীবনের বেশিরভাগ সময়। অতীব দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও শৈশবেই তার মধ্যে সঙ্গীত প্রতিভার স্ফুরণ পরিলক্ষিত হয়। যদিও পারিবারিক প্রেক্ষাপট ছিল এর সম্পূর্ণ অন্তরায়। নির্মম দারিদ্র্যতার চাপে শৈশব থেকেই নজরুল ছিল সংযমী ও পরিশ্রমী। ফলে, অন্যান্যদের মতো করে কাটেনি তার শৈশবের দিনগুলো। তথাপি সঙ্গীত এবং কাব্য প্রতিভা শৈশব থেকেই তার মধ্যে ফেলেছিল সজাগ দৃষ্টি।
পিতার মৃত্যু [ Father’s Death ] :
দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত যুদ্ধ করে কোনো রকম বয়ে চলা জীবনের উপর চরম আঘাত আসে ১৯০৮ সালে পিতার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে। তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর।
মক্তব ও নজরুল [ Maktab [ Informal School ] and Nazrul ]:
শৈশবেই পিতৃ বিয়োগের ফলে স্কুলে বিদ্যা অর্জন করা সম্ভব হয়নি দুখু মিয়ার। অত্যন্ত মেধাবী, দুরন্ত ও চঞ্চল নজরুল পড়াশোনা করেন মক্তবে। পারিবারিক দুঃসহ জীবন যাপনের ফলে মক্তব পাশ করে অর্থ উপার্জনের জন্য সেখানেই তাকে শিক্ষকতা করতে হয়। মসজিদের ইমামতি এবং মক্তবে শিক্ষকতার সামান্য আয় দিয়েই ৯ বছরের কিশোর বহন করে পিতৃহীন সংসারের ব্যায়ভার।
লেটোদল ও নজরুল :
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীর এই পর্যায়ে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। কাজী বজলে করিম এক পিতৃব্যের প্রভাবে নজরুল ইসলাম প্রথম ফারসী কবিতার রস আস্বাদন করেন এবং লেখায় তা আত্মনিয়োগ করেন। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে তাকে লেটো দলের বৈশিষ্ট্যানুযায়ী লেটো দলের গান রচনা, সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করতে হয়েছে। লেটো মুলত গ্রামীণ পর্যায়ের একটি সঙ্গীত ধারা হলেও প্রতিভাময় নজরুল সেখানে নিজেকে সংযুক্ত করবার প্রয়াস পান।
![কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী [ সংক্ষিপ্ত ] Kazi Nazrul Islam Biography [ Short ] 5 কাজী নজরুল ইসলাম](/wp-content/uploads/2000/01/Kazi-Nazrul-Islam-কাজী-নজরুল-ইসলাম-1.jpg)
কৈশরে নজরুল :
দারিদ্র্যতার ছায়ায় থাকার কারণে শৈশব-কৈশরের সুন্দর জীবন উপভোগ করার সৌভাগ্য নজরুলের হয়নি। তবে ছোটবেলা থেকেই রাজরোষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী সত্ত্বা গড়ে তোলা, পরাধীনতার শৃংখল হতে মুক্তির আকাংখা কাজী নজরুল ইসলামকে তাড়া করে ফিরছিল। ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব, জাগ্রত জনতার প্রতিনিধিত্ব সৃজনশীল কিছু করার, শ্রেণী সংগ্রামের বাণী ব্রিটিশদের কাছে পৌঁছে দেয়াই ছিল নজরুলের মূল লক্ষ্য। যা তিনি কৈশরেই লিপিবদ্ধ করেছিলেন নিজের অভ্যন্তরে।
কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষাজীবন :
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীর অত্যন্ত আশ্চর্যজনক অধ্যায় তার শিক্ষাজীবন। নজরুল লেটোদল পরিত্যাগ করে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার অজয় নদের তীরস্থ মাথরুন গ্রামে নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউটে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে সেখানে তার পড়া সম্ভব হয় নি। মাথরুন স্কুল ছাড়ার দুই বৎসর পরে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল পুলিশের কর্মকর্তা রফিজউল্লাহ সাহেবের গ্রামের বাড়ির নিকটবর্তী বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার অন্তর্গত দরিরামপুর হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন।
একই বৎসর ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম বা দ্বিতীয় হয়ে অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন এবং দেশে ফিরে যান। দেশে ফিরে তিনি রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করে প্রথমে ব্যর্থ হন এবং পরে হেড মাস্টারের সহযোগিতায় বেশ কয়েকটি সুবিধাসহ ভর্তি হন এবং দশম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন। (কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সাহিত্য, পৃষ্ঠা ১৪/১৬)।
সৈনিক নজরুল :
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীর এই পর্যায়ে আরেকটি বড় পরিবর্তন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায় নজরুল সেনাবহিনীতে যোগ দেন। এবং ৪৯ বাংলা রেজিমেন্টে যোগদান করে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য চলে যান কোলকাতা কোর্ট উইলিয়াম ট্রেন যোগে লাহোর হয়ে নওশেরা। নওশেরায় ৩ মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর নজরুল তার কোম্পানির সঙ্গে করাচী চলে যান।
সেখানে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সৈনিক বেশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাটেলিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদ লাভ করেন। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে ৪৯ বেঙ্গলী রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হলে তিনি করাচী থেকে কলতাকা চলে আসেন।
কবি নজরুলের আত্মপ্রকাশ :
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীর এই পর্যায়ে এসে আমাদের নজরুলের আত্মপ্রকাশ। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের সদ্যযুদ্ধ ফেরত নজরুল বাংলাসাহিত্যাঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করেন “মোসলেম ভারত’ পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯২০ সালের এপ্রিল মে মাসে তার রচিত কবিতা “মানিনী বধূর প্রতি” প্রকাশিত হয় “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য প্রত্রিকা” তে। করাচী থেকে সৈনিক নজরুলের পাঠানো গল্প, কবিতা, প্রকাশ করে এই প্রত্রিকাটি নজরুলকে বাংলাসাহিত্য প্রকাশের পথ করে দিয়েছিল।
সাহিত্যিক জীবনের প্রথম বর্ষে “মোসলেম ভারত” প্রত্রিকার প্রতি সংখ্যায় কবি নজরুলের কবিতা, গান, গল্প, অনুবাদ ছাপিয়ে বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে নজরুলকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল এক নতুন প্রতিভারূপে। অবশ্য প্রকাশনার প্রথম বছরে নজরুল রচনাবলী অবলম্বন করেই পত্রিকাটিও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
নজরুলের প্রথম গান :
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীর বিভিন্ন লেখকের তার প্রথম প্রকাশ বিষয়ে দ্বিমত আছে। তবে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে ১৯২০ সালে সওগাত দ্বিতীয় বর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যায় কবি রচিত প্রথম গান “উদ্বোধন” প্রকাশিত হয়।
নজরুলের প্রথম কবিতা :
১৯১৯ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় নজরুল রচিত প্রথম কবিতা “মুক্তি” প্রাশিত হয়। এই কবিতাটি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দালনের পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম গল্প :
নজরুলের প্রথম গল্প “বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী” প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালের মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকার প্রথম বর্ষের সপ্তম সংখ্যায় । নজরুল সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা : কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২২ সালের ১২, আগস্ট “ধূমকেতু” নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যার বিষয়বস্তু ও প্রকাশের লক্ষ্য নিখিল ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং অসাম্প্রদায়িকতার জন্যই ছিল নজরুলের “ধূমকেতু” পত্রিকার সম্পাদনা।
কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গীত শিক্ষা :
শৈশব থেকেই নজরুলের মধ্যে সঙ্গীত প্রতিভার স্বরূপ পরিলক্ষিত হলেও সঙ্গীতে তার প্রথম হাতেখড়ি হয় খুল্লতাত জনাব বজলে করিমের কাছে। এর পর তিনি দরিরামপুর হাইস্কুলে অধ্যায়নকালে সতীশ চন্দ্র কাঞ্চিলাল, প্রকৃতি গঙ্গোপাধ্যায়, ওস্তাদ মঞ্জু সাহেব, ওস্তাদ গোদা এবং জনাব জমির উদ্দিন খা-কেই তার সঙ্গীত পরিপক্কতার ক্ষেত্রে গুরু হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নজরুল এক অসাধারণ অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহা প্রতিভা।
ভারত-বর্ষে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং নজরুল ইসলাম :
নজরুল সঙ্গীতের প্রধান বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো ভারত-বর্ষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নজরুল সঙ্গীত ও কাব্যের আয়োজন। ১৯৪৭ সালে ভারত-বর্ষে এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষেত্রে নজরুলের বিদ্রোহী সত্ত্বায় রচিত গান ও কাব্য মুক্তিকামী মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। কারণ, কাজী নজরুল এর লেখনীতে ছিল-“বিদ্রোহ যদি করতে পার প্রলয় যদি আনতে পার তা হলে নিদ্রিত শির জাগবেই স্বাধীনতা আসবেই।”
সাহিত্য রচনার প্রেক্ষাপট ও উৎস : অভ্যন্তরীণ প্রতিভা কিছু সময় সুপ্ত অবস্থায় থাকলেও এর বিকাশ কোনো এক সময় ব্যাপকতায় বাহ্যিক রূপ লাভ করে। শৈশব থেকে সুফী-বাউল-সনাতন ধর্মের বিভিন্ন অবস্থানের পাশাপাশি বসবাসকারী বিভিন্ন প্রজাতীর কৃষ্টি, বৈপ্লবিক, মানসিকতা, হিন্দুস্থানী আদর্শ, ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব প্রভৃতি উপসর্গ নজরুলের সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। যার প্রতিফলন আজকের পরিপূর্ণ নজরুল সাহিত্য ভাণ্ডার।
বৈবাহিক অবস্থান :
কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম বিয়ে করেন ১৯২১ সালে কুমিল্লার দৌলতপুরে নার্গিস আনম খানকে এবং দ্বিতীয় বিয়ে করেন ১৯২৪ সালের গিরিবালা সেনগুপ্তের মেয়ে প্রমিলা সেনগুপ্তকে।
রাজরোষ ও কাজী নজরুল ইসলাম :
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীতে রাজরোষ তো থাকবেই। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে প্রাধান্য দিয়ে কাব্য ও সঙ্গীত রচনা করার জন্য নজরুলকে বাজরোষে পতিত হতে হয়েছে। কেননা, অসুন্দরকে পরিহার করে সুন্দর ও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নজরুল ইসলাম ভারতের স্বাধীবতার পক্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। সেখানে একত্রিত হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষ। অবশেষে অর্জিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা।
নজরুলের জীবনের সর্বাপেক্ষা কর্মবহুল সময় :
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সৃষ্টিশীল প্রতিভার বিকাশ নজরুলের শৈশব থেকে দেখা গেলেও এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে মূলত ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৫ সালের জুন পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে নজরুল রচনা করেছেন তার দীর্ঘ সঙ্গীতভাণ্ডার, গল্প, কবিতা, সাহিত্য, প্রবন্ধ ইত্যাদি। নজরুলের জীবনের কর্মবহুল সময় বলতে এই সময়কেই বোঝানো হয়ে থাকে ।
কাজী নজরুল ইসলামের সস্তান :
কাজী নজরুল ইসলামের কোনো মেয়ে ছিল না। তাঁর ছিল চার পুত্র। ১। আজাদ কামাল, ২। বুলবুল, ৩। সব্যসাচী, ও ৪। অনিরুদ্ধ
এইচ. এম. ভি. ও কাজী নজরুল ইসলাম :
কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গীত প্রতিভার পরিপূর্ণ প্রকাশ পেয়েছে H.M.V-এর মাধ্যমে। তৎকালীণ সময়ের রেকর্ডিং ব্যবস্থা এবং অডিও প্রকাশনার ক্ষেত্রে H.M.V-র অবদান অপরিসীম। H.M.V-র ট্রেইনার হিসেবে কাজ করেছিলেন নজরুল ইসলাম। ফলে তার সঙ্গীত প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বন্ধন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল H.M.V-র সাথে। আজকের নজরুল সঙ্গীতের আয়োজন, রেকর্ড প্রকাশনা, স্বরলিপি প্রণয়নের ভিত্তি, গান পরিবেশনের উৎস অনেকটা H.M.V কল্যাণেই সাধিত হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলামের শেষ ভাষণ :
১৯৪১ সালের ০৫ এপ্রিল কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে মুসলিম সাহিত্য পরিষদের জুবলী উৎসবে নজরুল তার জীবনের শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মুক্তি, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ইত্যাদির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। নিজের রচনা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছিলেন,
“বাংলাসাহিত্যের কাব্য, গল্প, প্রবন্ধে আমি কি দিতে পেরেছি জানি না। কিন্তু, বাংলাগানের বিবর্তনের ক্ষেত্রে আমার সঙ্গীতে এমন কিছু আমি দিয়ে যেতে পেরেছি যার জন্য এই ভারত বর্ষের মানুষ আমাকে একদিন মনে করবে।”
নজরুল প্রতিভাকে যারা সম্মানিত করেছেন :
ক) ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক “জগত্তারিণী” পদক।
খ) ১৯৬০ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ পদক।
গ) ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক “ডি.লিট” ডিগ্রি প্রদান।
ঘ) ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশে আগমন।
ঙ) ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক “ডিলিট ডিগ্রি” প্রদান।
চ) ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সরকার কর্তৃক “একুশে পদক” প্রদান।
গীতিকার ও সুরকার হিসেবে নজরুলের মূল্যায়ন :
গান রচনা এবং গান সুর করবার ক্ষেত্রে নজরুলের প্রতিভা বিরল। পর্যায় ভিত্তিক গান রচনা এবং পর্যায় ক্রমিক সুর সংযোজনের ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান বাংলাগান তথা বাংলাগানের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় বিষয়। মূল্যায়ন বা মূল্যবোধ দৃষ্টিতে সঠিকভাবে নজরুলের সুর ও গীত রচনা পরিমার্জিত রূপ বহন করে আছে। প্রমাণ ও অভিজ্ঞতার দৃষ্টিকোন থেকে বিচার বিশ্লেষণ করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে কাজী নজরুল ইসলাম একজন গীতিকার ও সুরকার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে কাজী নজরুলের মূল্যায়ন :
নজরুল প্রতিভার সমালোচনা শুরু থেকে অনেকেই করেছেন। নজরুলের কাব্য সঙ্গীত তৎকালীণ সময়ে ব্রিটিশ শাষনের বিরুদ্ধে ছিল একটি সোচ্চার প্রতিবাদ। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদের কারণে নজরুলের প্রতিভাকে অনেকেই মূল্যায়ন করেনি। কিন্তু কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর নজরুলকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে
“ওর কবিতা এবং গল্প-প্রবন্ধের কথা আমি বলিব না। কিন্তু সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম সকল শ্রেণীর মানুষের গান লিখে গেছে। যার কারণে ওর মূল্যায়ন সবার কাছে হওয়া উচিত। আমার গান সব মানুষের জন্য নয়। এজন্য আমি নজরুলকে আমার পক্ষ থেকে সাধুবাদ জানাইতেছি। ওর অনেক পূর্বেই ভারতীয় উপমহাদেশে আবির্ভাবের বেশ প্রয়োজন ছিল। ওর জন্য আমার আর্শীবাদ রইল।”
কাজী নজরুল ইসলামের মহাপ্রয়াণ :
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনীর শেষ পর্যায়ে আমরা চলে এসেছি। ১৯৪৫ সালের জুলাই থেকে অসুস্থ হবার পর অভ্যন্তরীণ তিক্ততা নজরুলকে প্রভাবিত করেছিল। কথা না বলতে পারার কারণে তার প্রতিভা বাহ্যিক রূপ লাভ করতে পারেনি। দীর্ঘ সময় অসুস্থ থাকায় ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। এখানে আসার পূর্বে ভারত সরকার ভারত বর্ষের বাইরেও নজরুলের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করেন।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে জাতীয়তা প্রদান করেন। অবশেষে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকা পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কক্ষে বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা ১০ মিনিটে এবং ভারতীয় সময় সকাল ০৯টা ৪০ মিনিটে মহান কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গনে বিকেল ০৫:৩০ মিনিটে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবিকে সমাহিত করা হয়।
বাংলা সাহিত্যাঙ্গণে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেও কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন মানবতার কবি। সময়ের দাবী মেটানোর কবি, সাম্যবাদের কবি, প্রেমের কবি, ছোটদের কবি, ইসলামি জাগরণের কবি, নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষের জন্য আত্মত্যাগের কবি, পরাধীন দেশ ও মানুষের মুক্তিকামী কবি। সর্বোপরি তিনি হলেন আমাদের জাতীয় কবি। আমাদের প্রাণের নিকটতম কবি।
ফটো গ্যালারী:
নজরুলের সংক্ষিপ্ত জীবনীর টাইমলাইন:
নজরুলের সংক্ষিপ্ত জীবনীর টাইমলাইন এখানে প্রস্তত করা হলো। এই কালক্রমে এক নজরে আপনি দেখতে পাবেন কোন সালে নজরুল কি কাজ করেছে বা তার সাথে কি ঘটেছে।
সাল | জীবন ও কর্ম |
---|---|
১৮৯৯ | ১৩০৬ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ, বুধবার, ২৪শে মে ১৮৯৯ সালে (১৩ মহর্রম ১৩১৭ হিজরি) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম। পিতামহ কাজী আমিনুল্লাহ। মাতামহ তোফায়েল আলী। পিতা কাজী ফকির আহমদ। মাতা জাহেদা খাতুন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কাজী সাহেবজান। কনিষ্ঠ ভ্রাতা কাজী আলী হোসেন। ভগ্নী উম্মে কুলসুম। নজরুলের ডাক-নাম ছিল দুখু মিয়া। ছেলেবেলায় তিনি ‘তারা ক্ষ্যাপা’ নামেও পরিচিত ছিলেন। পরে ‘নুরু’ নামও তিনি ব্যবহার করেছেন। অনেকে তাঁকে ‘নজরআলি’ নামেও ডাকতেন। |
১৯০৪ | বেনেপাড়ার বিনোদ চাটুজ্জের পাঠশালায় কিছুদিন পড়ে নজরুল গ্রামের মক্তবে লেখাপড়া শুরু করেন। এখানে তিনি কোরআন পাঠ আয়ত্ত করেন। মক্তবে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষার প্রথম পাঠ লাভ করেছিলেন মৌলবি কাজী ফজলে আলীর কাছে। পরে বিশেষ করে ফারসি শেখেন তাঁর চাচা কাজী বজলে করিমের (নজরুলের পিতামহ কাজী আমিনুল্লাহর কনিষ্ঠ ভ্রাতা কাজী নাজিবুল্লাহর পুত্র) কাছে। |
১৯০৮ | পিতা কাজী ফকির আহমদের মৃত্যু (১৩১৪ সালের ৭ই চৈত্র) |
১৯০৯ | গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাইমারি পাশ, মক্তবে শিক্ষকতা, মাজারের খাদেম, লেটো দলের সদস্য ও পালাগান ইত্যাদি রচনা। |
১৯১০ | রানিগঞ্জ সিয়ারশোল স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন। | সাহিত্যকৃতি : ‘চাষার সঙ’, ‘ঠাকুরের সঙ’, ‘রাজা যুধিষ্ঠিরের পালা’, ‘শকুনি বধ’, ‘মেঘনাদ বধ’, ‘দাতা কর্ণ’, ‘বিদ্যাভূতুম’, ‘রাজপুত্রের সঙ’, ‘কবি কালিদাস’, ‘আকবর বাদশা’ ইত্যাদি পালাগান রচনা। |
১৯১১ | বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার মাথ্রুন গ্রামে মাথরুন নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউশনে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি দুই বছর লেখাপড়া করেন। কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক ছিলেন এই স্কুলের শিক্ষক। | |
১৯১২ | স্কুল ত্যাগ, বাসুদেব কবিয়ালের কবিদলের সঙ্গে সম্পর্ক। |
১৯১২ – ১৩ | আসানসোল ছেড়ে ঘটনাচক্রে চলে আসেন প্রসাদপুরে। সেখানে বর্ধমানের অন্ডাল ব্রাঞ্চ রেলওয়ের বাঙালি খ্রিস্টান গার্ড সাহেবের খানসামা। পরে আসানসোলে এম. এ. বখ্শের চা রুটির দোকানে চাকুরি, আসানসোলে পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর ময়মনসিংহের কাজী রফিজউল্লাহ ও তাঁর পত্নী শামসুন্নেসা খানমের স্নেহ লাভ। |
১৯১৪ | কাজী রফিজউল্লাহর সহায়তায় ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের কাজীরসিমলা, দরিরামপুর গমন এবং দরিরামপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণির অবৈতনিক ছাত্র। সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে ময়মনসিংহ ত্যাগ করে চুরুলিয়ায় ফিরে যান। |
১৯১৫ – ১৭ | রাণিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব। পড়াশোনায় ভালো হওয়ার জন্য রাজবাড়ি থেকে মাসিক ৫টাকা বৃত্তি পান। এই স্কুলের শিক্ষক ও যুগান্তর দলের গোপন বিপ্লবী নিবারণচন্দ্র ঘটক নজরুলের মধ্যে স্বাধীনতা ও বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার করেছিলেন। প্রিটেস্ট পরীক্ষার আগে সেনাবাহিনীর ৪৯নং বাঙালি পল্টনে যোগদান। সেপ্টেম্বরে হাওড়া স্টেশন থেকে একটা বড় দলের সঙ্গে লাহোরের পথে যাত্রা করেন। সাহিত্যকৃতি : সিয়ারশোল রাজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৌলবি আবদুল গফুরের বিদায় উপলক্ষ্যে বিদায়-কাব্যবাণী রচনা করেন (১১ এপ্রিল ১৯১৬)। ‘করুণ গাথা’ নামে বিদায়-কাব্যবাণী রচনা করেন (১৩ জুলাই ১৯১৬) প্রবীণ শিক্ষক ভোলানাথ কর্মকারের বিদায় উপলক্ষ্যে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্থানীয়ভাবে জানা একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে ১০৬চরণের ‘ক্ষমা’ নামে দীর্ঘ কবিতা লেখেন (পরে মুজফ্ফর আহমদ ‘মুক্তি’ নামে সেটি প্রকাশ করেন ত্রৈমাসিক বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকায় ১৯১৯-এ; এটিই নজরুলের প্রথম প্রকাশিত কবিতা)। এই স্কুলে পড়ার সময়েই ‘চড়ুই পাখির ছানা’ কবিতাটিও রচনা করেন। চুরুলিয়ায় প্রচলিত লোককথা অবলম্বনে ‘রাজার গড়’ (পরে ‘ভগ্নস্তূপ’ নামে পল্লীশ্রী পত্রিকার আশ্বিন ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত) ও ‘রানির গড়’ নামে দুটি কবিতা লেখেন। |
১৯১৭ – ১৯ | সৈনিক জীবন, প্রধানত, করাচিতে গন্জা/গাজা বা আবিসিনিয়া লাইনে অতিবাহিত, ব্যাটালিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার পদে উন্নতি, সাহিত্যচর্চা। করাচিতে অবস্থানকালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার তদানীন্তন সহ-সম্পাদক মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে নজরুলের পত্রালাপ হয়। প্রাণচঞ্চল স্বভাবের জন্যও সেনাবাহিনীতে নজরুল ‘হৈ হৈ কাজী’ নামে পরিচিত ছিলেন। সাহিত্যকৃতি : ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ গল্প (সওগাত, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৬ সংখ্যা, মে ১৯১৯; পরে রিক্তের বেদন গল্পগ্রন্থে সংকলিত); ‘মুক্তি’ কবিতা (বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩২৬; পরে নির্ঝর কাব্যগ্রন্থে সংকলিত; এই কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পরে পত্রিকার সম্পাদককে নজরুল করাচি সেনানিবাস থেকে একটি চিঠি লেখেন যা সাপ্তাহিক সওগাত পত্রিকার ৭ অগ্রহায়ণ ১৩৩৫ সংখ্যায় ‘একখানি পুরাতন চিঠি’ শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়); ‘স্বামীহারা’ গল্প (সওগাত, ভাদ্র ১৩২৬; পরে রিক্তের বেদন গল্পগ্রন্থে সংকলিত), ‘কবিতা-সমাধি’ কবিতা (সওগাত, আশ্বিন ১৩২৬), ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা’ প্রবন্ধ (সওগাত, কার্তিক ১৩২৬), ‘হেনা’ গল্প (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, কার্তিক ১৩২৬; পরে ব্যথার দান গল্পগ্রন্থে সংকলিত), ‘আশায়’ কবিতা (হাফিজের কবিতার অনুবাদ; প্রবাসী, পৌষ ১৩২৬; পরে নির্ঝর কাব্যগ্রন্থে সংকলিত)। করাচিতে থাকার সময় ‘বাঁধনহারা’ পত্রোপন্যাসের অনেকটা অংশ লেখেন। |
১৯২০ | মার্চ মাসে সেনাবাহিনী থেকে প্রত্যাবর্তন, বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য-সমিতির ৩২নং কলেজ স্ট্রিটস্থ দফ্তরে মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে অবস্থান। কলকাতায় সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবন শুরু। সাংবাদিক জীবন, মে মাসে এ. কে. ফজলুল হকের সান্ধ্য-দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় যুগ্ম-সম্পাদক পদে যোগদান, নজরুল ও মুজফ্ফর আহ্মদের ৮-এ টার্নার স্ট্রিটে অবস্থান, সেপ্টেম্বর মাসে নবযুগ পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত এবং নজরুল ও মুজফ্ফর আহ্মদের বরিশাল ভ্রমণ, নবযুগ-এর চাকুরি পরিত্যাগ, বায়ু পরিবর্তনের জন্য দেওঘর গমন।
সাহিত্যকৃতি : ‘মেহের-নেগার’ গল্প (নূর, মাঘ ১৩২৬; পরে রিক্তের বেদন গল্পগ্রন্থে সংকলিত), ‘ব্যথার দান’ গল্প (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, মাঘ ১৩২৬; পরে ব্যথার দান গল্পগ্রন্থে সংকলিত), ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্প (নূর, ফাল্গুন-চৈত্র ১৩২৬; পরে ব্যথার দান গল্পগ্রন্থে সংকলিত), বাঁধনহারা উপন্যাসের ধারাবাহিক প্রকাশ শুরু শান্তিপুরের খ্যাতিমান কবি মোজাম্মেল হক সম্পাদিত মোসলেম ভারত পত্রিকায়, ‘রিক্তের বেদন’ গল্প (নূর, বৈশাখ ১৩২৭; পরে রিক্তের বেদন গল্পগ্রন্থে সংকলিত), ‘প্রিয়ার দেওয়া শরাব’ (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, বৈশাখ ১৩২৭), ‘মানিনী বধূর প্রতি’ কবিতা (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, বৈশাখ ১৩২৭; পরে ‘মানিনী’ শিরোনামে পূবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থে সংকলিত), ‘জননীদের প্রতি’, ‘পশুর খুঁটিনাটি বিশেষত্ব’ ও ‘জীবন-বিজ্ঞান’ প্রবন্ধ (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, বৈশাখ ১৩২৭), ‘উদ্বোধন’ গান (সওগাত, বৈশাখ ১৩২৭; পরে বিষের বাঁশী কাব্যগ্রন্থে সংকলিত), ‘চিঠি’ কবিতা (বঙ্গনূর, বৈশাখ ১৩২৭; পরে ঝিঙেফুল-এ সংকলিত), ‘কালোর উকিল’ (নূর, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৭), ‘বোধন’ গান (মোসলেম ভারত, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৭; পরে বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থে সংকলিত), মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় বিবিধ রচনা প্রকাশ। |
১৯২১ | দেওঘর থেকে প্রত্যাবর্তন, ‘মোসলেম ভারতের’ সম্পাদক আফজাল-উল-হকের সঙ্গে ৩২নং কলেজ স্ট্রিটে অবস্থান, পুনরায় ‘নবযুগে’ যোগদান। এপ্রিল মাসে আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লা গমন, কান্দির পাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ও বিরজাসুন্দরী দেবীর আতিথ্য গ্রহণ, আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুর গমন ও দুই মাস দৌলতপুর অবস্থান, আলী আকবর খানের ভাগিনেয়ী সৈয়দা খাতুনি ওরফে নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে ১৩২৮ সালের ২রা আষাঢ় তারিখে বিবাহ। কুমিল্লা থেকে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পরিবারের সকলের বিবাহে যোগদান, বিবাহের রাত্রেই নজরুলের দৌলতপুর ত্যাগ ও পরদিন কুমিল্লা গমন এবং অবস্থান। কলকাতায় বিবাহ-সংক্রান্ত গোলযোগের বার্তা প্রেরণ। জুলাই মাসে মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর হয়ে কলকাতা প্রত্যাবর্তন, ৩/৪সি তালতলা লেনের বাড়িতে অবস্থান, অক্টোবর মাসে অধ্যাপক (ডক্টর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সঙ্গে শান্তনিকেতন ভ্রমণ ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ। নভেম্বর মাসে পুনরায় কুমিল্লা গমন, অসহযোগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ। কলকাতায় প্রত্যাবর্তন। ডিসেম্বরের শেষ দিকে কলকাতায় তালতলা লেনের বাড়িতে বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ রচনা। ‘বিদ্রোহী’ সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ ও মাসিক ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ছাপা হলে প্রবল আলোড়ন। |
১৯২২ | চার মাস কুমিল্লা অবস্থান, আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলার সঙ্গে সম্পর্ক। মার্চ মাসে প্রথম গ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ প্রকাশ। ২৫শে জুন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যু, রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শোক সভায় যোগদান, সত্যেন দত্ত সম্পর্কে রচিত শোক-কবিতা পাঠ। দৈনিক ‘সেবকে’ যোগদান ও চাকুরি পরিত্যাগ। ১২ই আগস্ট অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ প্রকাশ, ধূমকেতুর জন্যও রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী, ২৬শে সেপ্টেম্বর, ধূমকেতুতে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা প্রকাশ, অক্টোবর মাসে ‘অগ্নিবীণা’ কাব্য ও ‘যুগবাণী’ প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ, ‘যুগবাণী’ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত, ধূমকেতুতে প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ বাজেয়াপ্ত, নভেম্বর মাসে নজরুলকে কুমিল্লায় গ্রেপ্তার ও কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলে আটক। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাতেই নজরুল প্রথম ভারতের জন্যও পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেছিলেন ১৩ই অক্টোবর ১৯২২ সংখ্যায়। সাহিত্যকৃতি : ব্যথার দান, অগ্নিবীণা |
১৯২৩ | জানুয়ারি মাসে বিচারকালে নজরুলের বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ আদালতে উপস্থাপন, এক বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড, আলিপুর জেলে স্থানান্তর, নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ গীতিনাটক উৎসর্গ, হুগলি জেলে স্থানান্তর, মে মাসে নজরুলের অনশন ধর্মঘট, শিলং থেকে রবীন্দ্রনাথের টেলিগ্রাম, ‘Give up hunger strike, our literature claims you’, বিরজাসুন্দরী দেবীর অনুরোধে অনশন ভঙ্গ, জুলাই মাসে বহরমপুর জেলে স্থানান্তর, ডিসেম্বরে মুক্তিলাভ। |
১৯২৪ | বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মেদিনীপুর শাখার একাদশ বার্ষিক অধিবেশনে যোগদান। মিসেস এম রহমানের উদ্যোগে এপ্রিলে প্রমীলার সঙ্গে বিবাহ, হুগলিতে নজরুলের সংসার স্থাপন, অগাস্টে ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গান’ প্রকাশ ও সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত, শনিবারের চিঠিতে নজরুল-বিরোধী প্রচারণা। হুগলিতে নজরুলের প্রথম পুত্র আজাদ কামালের জন্ম ও অকালমৃত্যু। |
১৯২৫ | মে মাসে কংগ্রেসের ফরিদপুর অধিবেশনে যোগদান। এই অধিবেশনের গুরুত্ব, মহাত্মা গান্ধি এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের যোগদান। জুলাই মাসে বাঁকুড়া সফর, ‘কল্লোল’ পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক, ডিসেম্বর মাসে নজরুল ইসলাম, হেমন্তকুমার সরকার, কুতুবউদ্দীন আহ্মদ ও শামসুদ্দিন হোসায়ন কর্তৃক ভারতীয় কংগ্রেসের অন্তর্গত, মজুর স্বরাজ পার্টি গঠন। ডিসেম্বরে শ্রমিক প্রজা স্বরাজ দলের মুখপত্র ‘লাঙ্গল’ প্রকাশ, প্রধান পরিচালক কাজী নজরুল ইসলাম। ‘লাঙ্গল’-এর জন্যেও রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী। ‘লাঙ্গল’ বাংলা ভাষায় প্রথম শ্রেণিসচেতন পত্রিকা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যু ১৬ই জুন। কবিতাসংকলন ‘চিত্তনামা’ প্রকাশ। |
১৯২৬ | জানুয়ারি থেকে কৃষ্ণনগরে বসবাস। মার্চ মাসে মাদারিপুর নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মেলনে যোগদান। এপ্রিল মাসে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত। এপ্রিলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা। রবীন্দ্রনাথকে ‘চল চঞ্চল বাণীর দুলাল’, ‘ধ্বংস পথের যাত্রীদল’ এবং ‘শিকল-পরা ছল’ গান শোনান। মে মাসে কৃষ্ণনগরে কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীত ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কিষাণ সভায় ‘কৃষাণের গান’ ও ‘শ্রমিকের গান’ এবং ছাত্র ও যুব সম্মেলনে ‘ছাত্রদলের গান’ পরিবেশন। জুলাই মাসে চট্টগ্রাম, অক্টোবর মাসে সিলেট এবং যশোর ও খুলনা সফর। সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় পুত্র বলবুলের জন্ম। আর্থিক অনটন। ‘দারিদ্র্য’ কবিতা রচনা। নভেম্বর মাসে পূর্ববঙ্গ থেকে কেন্দ্রীয় আইন সভার উচ্চ পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পরাজয় বরণ। ডিসেম্বর থেকে গজল রচনার সূত্রপাত, ‘বাগিচায় বুলবুলি’, ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’, ‘দুরন্ত বায়ু পুরবইয়াঁ’, ‘মৃদুল বায়ে বকুল ছায়ে’ ইত্যাদি রচনা। ‘খালেদ’ কবিতা রচনা। নজরুলের ক্রমাগত অসুস্থতা। |
১৯২৭ | ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সফর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান ও ‘খোশ আমদেদ’ গানটি পরিবেশন, ‘খালেদ’ কবিতা আবৃত্তি। বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্য নির্বাচিত। কৃষক ও শ্রমিক দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘গণবাণী’ (সম্পাদক মুজফ্ফর আহ্মদ)-র জন্যে এপ্রিল মাসে ‘ইন্টারন্যাশনাল’, ‘রেড ফ্লাগ’ ও শেলির ভাব অবলম্বনে যথাক্রমে ‘অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত’, ‘রক্ত-পতাকার গান’ ও ‘জাগর তূর্য’ রচনা। জুলাই মাসে ‘গণ-বাণী’ অফিসে পুলিশের হানা। আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কিত বাদ-প্রতিবাদ। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী, নজরুল, সজনীকান্ত দাস, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখ সাহিত্যিক এবং প্রবাসী, শনিবারের চিঠি, কল্লোল, কালিকলম প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় বিতর্ক। ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্সি কলেজে রবীন্দ্র পরিষদে রবীন্দ্রনাথের ভাষণ, ‘সাহিত্যে নবত্ব’ প্রবন্ধ এবং নজরুলের প্রবন্ধ ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’, ‘রক্ত’ অর্থে ‘খুন’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক। বিতর্কের অবসানে প্রমথ চৌধুরীর ‘বাংলা সাহিত্যে খুনের মামলা’ প্রবন্ধ। ‘ইসলাম দর্শন’, ‘মোসলেম দর্পণ’ প্রভৃতি রক্ষণশীল মুসলমান পত্রিকায় নজরুল সমালোচনা। ইব্রাহীম খান, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, আবুল হোসেনের নজরুল-সমর্থন। |
১৯২৮ | ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় মুসলমান সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদান, এই সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীতের জন্যে ‘নতুনের গান’ রচনা। ঢাকায় অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, মিস্ ফজিলতিন্নেসা, প্রতিভা সোম, উমা মৈত্র প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। মে মাসে নজরুলের মাতা জাহেদা খাতুনের এন্তেকাল। সেপ্টেম্বর মাসে কলিকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে শরৎ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দিলীপকুমার রায়, সাহানা দেবী ও নলিনীকান্তের সঙ্গে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশনা। অক্টোবরে ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশ। ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় নজরুল বিরোধিতা। ‘সওগাত’ পত্রিকার নজরুল সমর্থন। ডিসেম্বর মাসে নজরুলের রংপুর ও রাজশাহি সফর। কলকাতায় নিখিল ভারত কৃষক ও শ্রমিক দলের সম্মেলনে যোগদান। নেহেরুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কলকাতায় নিখিল ভারত সোশিয়ালিস্ট যুবক কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদান, কবি গোলাম মোস্তফার নজরুল-বিরোধিতা। ডিসেম্বরের শেষে কৃষ্ণনগর থেকে নজরুলের কলকাতা প্রত্যাবর্তন এবং প্রথমে ১১নং ওয়েলেস্লি স্ট্রিটে ‘সওগাত’ অফিস সংলগ্ন ভাড়া বাড়িতে ও পরে ৮/১ পান বাগান লেনে ভাড়া বাড়িতে বসবাস। নজরুলের সঙ্গে গ্রামোফোন কোম্পানির যোগাযোগ। |
১৯২৯ | জানুয়ারিতে এলবার্ট হলে নজরুলকে জাতীয় সম্বর্ধনা প্রদান, উদ্যোক্তা ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, হবীবুল্লাহ্ বাহার প্রমুখ। সংবর্ধনা সভায় সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রধান অতিথি সুভাষচন্দ্র বসু। |
১৯৩০ | ‘প্রলয়শিখা’ প্রকাশ ও কবির বিরুদ্ধে মামলা ও ছয় মাসের কারাদণ্ড। কিন্তু গান্ধি-আরউইন চুক্তির ফলে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ফলে কারাবাস থেকে মুক্তি। কবির প্রিয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যু। |
১৯৩১ | সিনেমা ও মঞ্চ-জগতের সঙ্গে যোগাযোগ। ‘আলেয়া’ গীতিনাট্য রঙ্গমঞ্চে মঞ্চস্থ। নজরুলের অভিনয়ে অংশগ্রহণ। |
১৯৩২ | নভেম্বরে সিরাজগঞ্জে ‘বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের’ সভাপতিত্ব। ডিসেম্বরে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের’ পঞ্চম অধিবেশনে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন। |
১৯৩৩ | গ্রীষ্মে ‘বর্ষবাণী’ সম্পাদিকা জাহান আরা চৌধুরীর সঙ্গে দার্জিলিং ভ্রমণ ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ। ‘ধ্রুব’ চিত্রে নারদের ভূমিকায় অভিনয়, সঙ্গীত পরিচালনা। |
১৯৩৪ | গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকান ‘কলগীতি’ প্রতিষ্ঠা। |
১৯৩৬ | ফরিদপুর ‘মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের কনফারেন্সে’ সভাপতিত্ব। |
১৯৩৮ | এপ্রিলে, কলকাতায় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে’ কাব্য শাখার সভাপতিত্ব। ছায়াচিত্র ‘বিদ্যাপতি’র কাহিনী রচনা। |
১৯৩৯ | ছায়াচিত্র ‘সাপুড়ে’র কাহিনী রচনা। |
১৯৪০ | কলকাতা বেতারে ‘হারামণি’, ‘নবরাগ মালিকা’ প্রভৃতি নিয়মিত সঙ্গীত অনুষ্ঠান প্রচার। লুপ্তরাগ রাগিণীর উদ্ধার ও নব রাগিণীর প্রচার অনুষ্ঠান দুটির বৈশিষ্ট্য। অক্টোবর মাসে, নব পর্যায়ে প্রকাশিত ‘নবযুগে’র প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত। ডিসেম্বরে কলকাতা মুসলিম ছাত্র সম্মেলনে ভাষণ। প্রমীলা নজরুল পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত। |
১৯৪১ | মার্চে, বনগাঁ সাহিত্য-সভার চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব। ৫ই ও ৬ই এপ্রিল নজরুলের সভাপতিত্বে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজত জুবিলি উৎসবে সভাপতিরূপে জীবনের শেষ ভাষণ দান, ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’। |
১৯৪২ | ১০ই জুলাই দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত। ১৯শে জুলাই, কবি জুলফিকার হায়দারের চেষ্টায়, ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আর্থিক সহায়তায় নজরুলের বায়ু পরিবর্তনের জন্য ডক্টর সরকারের সঙ্গে মধুপুর গমন। মধুপুরে অবস্থার অবনতি। ২১শে সেপ্টেম্বর মধুপুর থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ডা. গিরীন্দ্রশেখর বসুর ‘লুম্বিনী পার্কে’ চিকিৎসার জন্য ভর্তি। অবস্থার উন্নতি না ঘটায় তিন মাস পর বাড়িতে প্রত্যাবর্তন। কলকাতায় নজরুল সাহায্য কমিটি গঠন। সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ— ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায় যুগ্ম সম্পাদক— সজনীকান্ত দাস ও জুলফিকার হায়দার কার্যনির্বাহী কমিটির সভ্য— এ. এফ. রহমান তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিমলানন্দ তর্কতীর্থ সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার তুষারকান্তি ঘোষ চপলাকান্ত ভট্টাচার্য সৈয়দ বদরুদ্দোজা গোপাল হালদার এই সাহায্য কমিটি কর্তৃক পাঁচ মাস কবিকে মাসিক দুইশত টাকা করে সাহায্য প্রদান। |
১৯৪৪ | বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার ‘নজরুল-সংখ্যা’ (কার্তিক-পৌষ ১৩৫১) প্রকাশ। |
১৯৪৫ | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নজরুলকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ প্রদান। |
১৯৪৬ | নজরুল পরিবারের অভিভাবিকা নজরুলের শাশুড়ি গিরিবালা দেবী নিরুদ্দেশ। নজরুলের সৃষ্টিকর্ম মূল্যায়নে প্রথম গ্রন্থ কাজী আবদুল ওদুদ কৃত ‘নজরুল-প্রতিভা’ প্রকাশ। গ্রন্থের পরিশিষ্টে কবি আবদুল কাদির প্রণীত নজরুল-জীবনীর সংক্ষিপ্ত রূপরেখা সংযোজিত। |
১৯৫২ | ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’ গঠন। সম্পাদক কাজী আবদুল ওদুদ। জুলাই মাসে নজরুল ও তাঁর পত্নীকে রাঁচি মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ। চার মাস চিকিৎসা, সুফলের অভাবে কলকাতা আনয়ন। |
১৯৫৩ | মে মাসে কবি ও কবিপত্নীকে চিকিৎসার জন্যে লন্ডন প্রেরণ। মানসিক চিকিৎসক উইলিয়ম স্যারগন্ট, ই.এ. বেটন, ম্যাকসিক্ ও রাসেল ব্রেনের মধ্যে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ব্যাপারে মতভেদ, ডিসেম্বর মাসে নজরুলকে ভিয়েনাতে প্রেরণ। ভিয়েনায় বিখ্যাত স্নায়ুচিকিৎসক ডা. হ্যান্স হফ্ কর্তৃক সেরিব্রাল অ্যানজিওগ্রাফি পরীক্ষার ফল, নজরুল ‘পিকস ডিজিজ’ নামে মস্তিস্ক রোগে আক্রান্ত এবং তা চিকিৎসার বাইরে। ডিসেম্বর মাসে নজরুল ও তাঁর পত্নীকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। |
১৯৬০ | ভারত সরকার কর্তৃক নজরুলকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দান। |
১৯৬২ | ৩০শে জুন নজরুল-পত্নী প্রমীলা নজরুলের দীর্ঘ রোগ ভোগের পর পরলোক গমন। প্রমীলা নজরুলকে চুরুলিয়ায় দাফন। (নজরুলের দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ ইসলামের মৃত্যু যথাক্রমে ১৯৭৪ ও ১৯৭৯ সালে।) |
১৯৬৬ | কবি আবদুল কাদিরের সম্পাদনায় ঢাকার ‘কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড’ কর্তৃক ‘নজরুল-রচনাবলী’ প্রথম খণ্ড প্রকাশিত। |
১৯৬৯ | সম্বিতহারা কবির অসুস্থতার সপ্তবিংশ বৎসর পূর্ণ এবং সর্বত্র কবি কাজী নজরুল ইসলামের সপ্ততিতম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন। কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডি. লিট. উপাধি প্রদান। |
১৯৭১ | ২৫শে মে নজরুল জন্মবার্ষিকীর দিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নব পর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার শুরু। |
১৯৭২ | স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নজরুল-জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে নজরুলকে সপরিবার ঢাকায় আনয়ন, ধানমন্ডিতে কবিভবনে অবস্থান এবং সেখানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড্ডীন। স্বাধীন বাংলাদেশে কবির প্রথম জন্মবার্ষিকী কবিকে নিয়ে উদ্যাপন। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক কবিভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। |
১৯৭৪ | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডি. লিট. উপাধি প্রদান। কবিপুত্র কাজী সব্যসাচী ইসলামের মৃত্যু। |
১৯৭৫ | ২২শে জুলাই কবিকে পি. জি. হাসপাতালে স্থানান্তর, ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট মোট এক বছর এক মাস আট দিন পিজি হাসপাতালের ১৯৭নং কেবিনে নিঃসঙ্গ জীবন। |
১৯৭৬ | ২১শে ফেব্রুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘একুশে পদক’ প্রচলন ও নজরুলকে পদক প্রদান। ঐ বছরেই আগস্ট মাসে কবির স্বাস্থ্যের অবনতি। ২৭শে আগস্ট শুক্রবার বিকেল থেকে কবির শরীরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে, তিনি ব্রঙ্কো-নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। ২৯শে আগস্ট রবিবার সকালে কবির দেহের তাপমাত্রা আস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়ে ১০৫ ডিগ্রি অতিক্রম করে যায়। কবিকে অক্সিজেন দেওয়া হয় এবং সাক্শান এর সাহায্যে কবির ফুসফুস থেকে কফ ও কাশি বের করার চেষ্টা চলে। কিন্তু চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কবির অবস্থার উন্নতি হয় না—সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১২ই ভাদ্র ১৩৮৩ সাল মোতাবেক ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সকাল ১০টা ১০ মিনিটে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেতার এবং টেলিভিশনে কবির মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হলে পিজি হাসপাতালে শোকাহত মানুষের ঢল। কবির মরদেহ প্রথমে পিজি হাসপাতালের গাড়ি বারান্দার ওপরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি-র সামনে রাখা হয়। অবিরাম জনস্রোত কবির মরদেহে পষ্প দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। কবির নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় বাদ আসর সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানে। স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জানাজায় লক্ষ লক্ষ মানুষ শামিল হন। নামাজে জানাজা শেষে শোভাযাত্রা সহযোগে কবির জাতীয় পতাকা শোভিত মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। পরবর্তী কালে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা প্রদান করা হয় ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৯৮-২০০০ সাল বিশ্বব্যাপী মহাসমারোহে নজরুল-জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন। |
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী ও কর্ম সম্পর্কে আরও পড়ুন:
- উইকিপিডিয়া : কাজী নজরুল ইসলাম
- নজরুলের গান – রাগ নির্ভরতা
- নজরুলের গান – গায়কী