কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ তালিকা নিয়ে আজকের আলোচনা। কাব্য গ্রন্থের তালিকার পাশাপাশি প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে সাধারণ তথ্যগুলো তুলে ধরা হবে এবং প্রতিটি কাব্যের সাথে লিংক করে দেয়া হবে।
কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যগ্রন্থ তালিকা
অগ্নিবীণা [ ১৯২২ ]
অগ্নিবীণা বাংলা সাহিত্যের বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ, যা কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত কাব্যসংগ্রহ। এটি ১৩২৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে (অক্টোবর, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ) প্রকাশিত হয়। অগ্নিবীণায় মোট বারোটি কবিতা সংকলিত রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো — ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’, ‘আগমণী’, ‘ধূমকেতু’, ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার’, ‘রণভেরী’, ‘শাত-ইল-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’ ও ‘মোহররম’। এই কবিতাগুলোতে নজরুলের বিদ্রোহী, প্রগতিশীল ও বিপ্লবী চিন্তাধারা স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়।
গ্রন্থের শুরুতেই রয়েছে বিপ্লবী নেতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে উৎসর্গ করা একটি উৎসর্গ কবিতা। বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ছিলেন বাংলা ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী নেতা। কাজী নজরুল ইসলাম নিজেকে তাঁর ‘মহিমান্বিত শিষ্য’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং তাই এই কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছেন তাঁকে, যা তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের প্রতিফলন।
অগ্নিবীণার প্রচ্ছদপটের নকশা করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এঁকেছিলেন তরুণ চিত্রশিল্পী বীরেশ্বর সেন। এই গ্রন্থটি কলকাতার ৭ নং প্রতাপ চ্যাটার্জি লেন থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। প্রকাশক হিসেবে উল্লেখ ছিল ‘আর্য পাবলিশিং হাউস, কলেজ স্ট্রিট, মার্কেট (দোতলায়)’ এবং বইটি মেটকাফ প্রেস, ৭৯ নং বলরাম দে স্ট্রিট, কলকাতা থেকে ছাপা হয়। প্রকাশনার সময় গ্রন্থটির মূল্য ছিল এক টাকা, যা তখনকার পাঠকদের জন্য সহজলভ্য ছিল।
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা করে, যেখানে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী মনোভাব ও সাহসিকতা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। এই গ্রন্থটি বাংলা কবিতায় আধুনিকতা ও বিপ্লবী ভাবনার এক নতুন মাত্রা যোগ করে, যা তাকে বাঙালির জাতীয় কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের কবিতার তালিকা:
- প্রলয়োল্লাস
- বিদ্রোহী
- রক্তাম্বর-ধারিণী মা
- আগমণী
- ধূমকেতু
- কামাল পাশা
- আনোয়ার
- রণভেরী
- শাত-ইল-আরব
- খেয়াপারের তরণী
- কোরবানি
- মোহররম
দোলনচাঁপা [ ১৯২৩ ]
দোলনচাঁপা বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের সর্বাধিক জনপ্রিয় বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এটি ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে (আশ্বিন, ১৩৩০ বঙ্গাব্দ) আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি কবির জীবনের এক সংবেদনশীল ও সংগ্রামী অধ্যায়ের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত।
১৯২২ সালের দুর্গাপূজার আগমুহূর্তে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ধুমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তাকে রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি কবিকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী রাখা হয়। কারাবাসের কঠোর পরিবেশে সত্ত্বেও কবি দমে যাননি; বরং জেলেই তিনি ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যের অধিকাংশ কবিতা রচনা করেন।
জেল কর্তৃপক্ষের অগোচরে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ওয়ার্ডারদের সাহায্যে কবির এই কবিতাগুলো বাহিরে নিয়ে আসা হয়। নজরুলের নির্দেশমতো আর্য পাবলিশিং হাউস এসব কবিতা সংগ্রহ করে প্রথম সংস্করণ হিসেবে ‘দোলনচাঁপা’ প্রকাশ করে। প্রথম সংস্করণে মোট ১৯টি কবিতা ছিল। এছাড়া সূচিপত্রের আগে মুখবন্ধেরূপে সংযোজিত “আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে” কবিতাটি ১৩৩০ বঙ্গাব্দের (১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ) জ্যৈষ্ঠ মাসে কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে কবিতাগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৫০টি কবিতা পর্যন্ত পৌঁছায়। এই গ্রন্থের কবিতাগুলোতে বিপ্লবী আবেগ, মানবতাবাদ, প্রেম, বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার তেজস্বী সুর বিদ্যমান। দোলনচাঁপা গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে নজরুলের সৃষ্টিশীলতার এক মহৎ অধ্যায় হিসেবে গণ্য হয়, যেখানে তিনি কারাবাসের সীমাবদ্ধতাকে জয় করে স্বাধীনতার দীপ্তিময় কবিতা রচনা করেছেন।
দোলনচাঁপার তাৎপর্য:
এটি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা’র পর প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।
কারাবাসের পীড়িত পরিবেশেও কবির অটুট সৃষ্টিশীলতা ও প্রতিরোধের উদাহরণ।
কবিতাগুলোতে বিদ্রোহী চেতনা ও নতুন সমাজের স্বপ্ন ফুটে উঠেছে।
বাংলা সাহিত্যে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি যুগেই পাঠকের হৃদয়ে প্রেরণার দ্যুতি জাগিয়ে রাখে এবং কাজী নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠ রচনার অন্যতম অংশ হিসেবে অম্লান হয়ে রয়েছে।
প্রথম সংস্করণের কবিতাঃ
দোলনচাঁপা কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণে ১৯টি কবিতা পত্রস্থ হয়েছিল, সেগুলো হলো :
আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে (সূচিপত্রে ছিল না, সূচিপত্রের আগে মুখবন্ধরূপে ছিল)
- দোদুল্ দুল্
- বেলাশেষে
- পউষ
- পথহারা
- ব্যথা গরব
- উপেক্ষিত
- সমর্পণ
- পুবের চাতক
- অবেলার ডাক
- চপল-সাথী
- পূজারিণী
- অভিশাপ
- আশান্বিতা
- পিছু-ডাক
- মুখরা
- সাধের ভিখারিণী
- কবি-রাণী
- আশা
- শেষ প্রার্থনা
“দুটি কথা” শিরোনামে এ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়।
পরবর্তী সংস্করণঃ
দোলনচাঁপা কাব্যগ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণে ( শ্রাবণ ১৩৬১ বঙ্গাব্দ ) কবিতার অদলবদল করা হয়েছে।
প্রথম সংস্করণের পউষ, পথহারা, অবেলার ডাক, পূজারিণী, অভিশাপ, পিছু-ডাক, কবি-রাণী কবিতাগুলি বাদ দিয়ে হংসদূতী, সে যে চাতকই জানে তার মেঘ এত কি, লাল নটের ক্ষেতে, মদালস ময়ূর-বীণা কার বাজে গান, না মিটিতে সাধ মোর বেণুকা, তোমার ফুলের মত মন, বরষা, ঐ নীল গগনের নয়ন-পাতায়, মাত্লা-হাওয়া, সবুজ শোভার ঢেউ খেলে যায়, বনমালি, বেদনা-অভিমান, নিশীথ-প্রতিম, অ-বেলায়, হার-মানা-হার, বেদনা-মণি, পরণ-পূজা, অনাদৃতা, নীলপরী, ¯েœহ-ভীতু, অকরুণপিয়া, মরমী, মুক্তি-বার, বিরাগিনী, হারামণি, প্রিয়ার রূপ, পাপড়ি-খোলা, বিধুরা পথিক, প্রিয়া, প্রতিবেশিনী, বাদল-দিনে, মনের মানুষ, কার বাঁশি বাজিল, দহনমালা, দুপুর-অভিসার, শেষের গান, রৌদ্র-দগ্ধের গান, আলতা-স্মৃতি কবিতাগুলি সংযেজিত করা হয়েছে।
এই কবিতাগুলি “ছায়ানটে”র অন্তর্গত ছিল।

সাম্যবাদী [ ১৯২৫ ]
“সাম্যবাদী” কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক রচনা। এটি ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে, বাংলা সনের ১৩৩২ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থে মূলত সমাজতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী দর্শনের উপর ভিত্তি করে লেখা একাধিক কবিতা সংকলিত হয়েছে।
নজরুল ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান – জাত, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি বা লিঙ্গের কোনো ভেদাভেদ থাকা উচিত নয়। এই মৌল আদর্শই “সাম্যবাদী” কাব্যগ্রন্থের মূল সুর। তখনকার উপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারত, সামন্তবাদী শোষণ, সামাজিক বৈষম্য ও ধর্মীয় কুসংস্কারের প্রেক্ষাপটে নজরুলের এই কাব্যগ্রন্থ ছিল সাহসী ও বিপ্লবী চেতনার প্রতিফলন।
📜 গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলোর বৈশিষ্ট্য:
১. মানবতাবাদ: প্রতিটি কবিতায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে সাম্যের জয়গান গাওয়া হয়েছে।
২. বিদ্রোহ ও প্রতিবাদ: শোষণ, অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর।
৩. ধর্মনিরপেক্ষতা: কবিতাগুলোতে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সকল ধর্মাবলম্বীর প্রতি সম্মান ও সমতার বাণী উচ্চারিত হয়েছে।
4. আন্তর্জাতিকতা: নজরুল শুধু বাংলা বা ভারত নয়, সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত মানবজাতিকে কবিতার মাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছেন একসাথে এগিয়ে চলার।
🖋️ গুরুত্বপূর্ণ কবিতাগুলোর কিছু বিষয়বস্তু:
“সাম্যবাদী” কবিতা, যা এই গ্রন্থের নামও বটে, তাতে কবি নিজেকে কখনো হিন্দু, কখনো মুসলমান, কখনো বৌদ্ধ, কখনো কৃষক, কখনো দাস, কখনো শ্রমিক, কখনো রাজা—সব রূপে কল্পনা করেন। এতে তিনি ঘোষণার মতো বলেন:
“আমি চিরদাস, চিরক্রীতদাস, চিরদুর্বলের আমি গান গাহি।”
“আমি তোমাদেরই লোক, আমি সাম্যবাদী।”অন্যান্য কবিতাগুলোতেও কবি বারবার সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত ও প্রান্তিক মানুষদের পক্ষে কথা বলেছেন।
🏛️ প্রাসঙ্গিকতা ও প্রভাব:
“সাম্যবাদী” ছিল নজরুলের কাব্যিক বিপ্লবের আরেকটি ধাপ, যেখানে তিনি রাজনীতিকে ছুঁয়ে হলেও তার কবিতাকে মানবতার কথা বলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
এই গ্রন্থটি প্রকাশের সময় ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ছিল অত্যন্ত সংকটময় — সাম্রাজ্যবাদ, জমিদারি প্রথা, শ্রেণি বৈষম্য ও জাতপাতের শৃঙ্খল মানুষের জীবনে তীব্র যন্ত্রণা তৈরি করছিল।
নজরুলের এই কবিতা সংগ্রহ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মাঝেও উৎসাহ জুগিয়েছিল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যেও সাম্যবাদের বোধ জাগিয়ে তুলেছিল।
“সাম্যবাদী” কাব্যগ্রন্থটি শুধু একটি সাহিত্য রচনা নয়; এটি একটি সমাজ দর্শনের কাব্যিক প্রতিফলন। এখানে নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, দার্শনিক, বিদ্রোহী এবং মানবতার পূজারী। তাঁর এই কাব্যগ্রন্থ আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, যখনই সমাজে অসাম্য, শোষণ ও বর্ণবাদের রূপ দেখা দেয়। “সাম্যবাদী” কাব্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যকে একটি নতুন আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিয়েছে – সাম্যের কবিতা, সাম্যের কাব্যনবী কাজী নজরুল ইসলামের অমর সৃষ্টি।
সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের কবিতার তালিকা
- সাম্যবাদী
- ঈশ্বর
- মানুষ
- পাপ
- চোর-ডাকাত
- বারাঙ্গনা
- মিথ্যাবাদী
- নারী
- রাজা-প্রজা
- সাম্য
- কুলিমজুর
ঝিঙে ফুল [ ১৯২৬ ]
‘ঝিঙে ফুল’ বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি অনন্য শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ, যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৬ সালে। এটি মূলত ছোটদের জন্য লেখা কবিতা সংকলন এবং নজরুলের সাহিত্যজীবনের এক কোমল, সরস, আনন্দময় দিকের পরিচয় বহন করে। এই গ্রন্থটি বাংলা শিশু-কবিতার ধারায় এক বিশেষ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত।
📚 গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব:
গ্রন্থের নাম: ঝিঙে ফুল
প্রকাশকাল: ১৯২৬
রচয়িতা: কাজী নজরুল ইসলাম
কবিতার সংখ্যা: মোট ১৪টি
ধরন: শিশুতোষ কবিতা (ছড়া ও কল্পনানির্ভর রচনা)
উদ্দেশ্য: শিশুদের বিনোদন ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান, এবং কল্পনার জগতে প্রবেশাধিকার দেওয়া।
🌸 ‘ঝিঙে ফুল’ গ্রন্থের বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
শিশুদের ভাষায় লেখা: সরল, কাব্যিক ছন্দে গাঁথা, সহজবোধ্য শব্দচয়ন।
প্রাণিজগৎ ও প্রকৃতিনির্ভর চিত্র: কবিতাগুলোতে পোকামাকড়, গাছপালা, প্রাণী ও শিশুদের কল্পনার রঙিন চিত্র ফুটে উঠেছে।
শিক্ষামূলক দিক: রম্যরস, কল্পনা, সজীবতা ও সমাজিক বার্তা মিশ্রিত করে শিশুদের জন্য আনন্দদায়ক শিক্ষাদান।
গান ও ছড়ার মিলন: অনেক কবিতা পাঠ্য ছড়ার মতোই গীতযোগ্য।
ঝিঙে ফুল কাব্যগ্রন্থের কবিতার তালিকা
- খাঁদু-দাদু
- খুকি ও কাঠবেড়ালি
- খোকার খুশি
- খোকার গপ্প বলা
- খোকার বুদ্ধি
- চিঠি
- ঝিঙে ফুল
- ঠ্যাং-ফুলি
- দিদির বে-তে খোকা
- পিলে-পটকা
- প্রভাতি
- মা
- লিচু চোর
- হোঁদলকুতকুতের বিজ্ঞাপন
সিন্ধু হিন্দোল [ ১৯২৮ ]
“সিন্ধু হিন্দোল” বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ, যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। এই কাব্যগ্রন্থটি কবির এক গভীর সৃষ্টিশীল অধ্যায়ের পরিচায়ক। গ্রন্থটির শিরোনাম “সিন্ধু হিন্দোল” নামেই তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য, গম্ভীরতা ও সৃজনশীল আবেগের পরিচয় বহন করে। ‘সিন্ধু’ অর্থ সমুদ্র এবং ‘হিন্দোল’ অর্থ দোলন বা তরঙ্গ—এই নামের মধ্য দিয়েই কবি তাঁর কাব্যিক বিচরণকে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বিশাল ও গতিশীল করে তুলেছেন।
এই গ্রন্থে মোট ১৯টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। প্রতিটি কবিতাই গভীর ভাবনা, দার্শনিক উপলব্ধি ও চেতনার অনন্য বহিঃপ্রকাশ। ‘সিন্ধু হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থে নজরুল তাঁর আত্মিক, সৃজনশীল এবং রোমান্টিক চেতনাকে উপস্থাপন করেছেন এক ভিন্ন মাত্রায়। এই গ্রন্থে তিনি মানবতার জয়গান, প্রেম ও প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক ভাবনাকে মিলিয়ে এক অনুপম কবিতার জগৎ তৈরি করেছেন।
নজরুল এই কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন –
“বাহার ও নাহার”, অর্থাৎ হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও শামসুন নাহার চৌধুরীকে।
এই উৎসর্গের মধ্য দিয়ে নজরুল তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন, যারা সমাজসেবক, লেখক ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সিন্ধু হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থটি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মের একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করে। বিদ্রোহী ও সংগ্রামী রচনার পাশাপাশি, এই কাব্যগ্রন্থে রয়েছে সূক্ষ্ম রোমান্টিকতা, আত্মিক অভিজ্ঞান এবং সাহিত্যিক পরিপক্বতা। এটি তাঁর ভাবপ্রবণ ও ধ্যানমগ্ন দিকের পরিচয় দেয়, যেখানে প্রেম, প্রকৃতি, আধ্যাত্মিকতা ও বিশ্বচেতনা একত্রিত হয়ে কাব্যিক রূপ লাভ করেছে।
‘সিন্ধু হিন্দোল’ বাংলা সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ। এটি শুধু নজরুলপ্রেমীদের জন্য নয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চাকারীদের কাছেও এক দুর্লভ কবিতার সংগ্রহ। কাজী নজরুল ইসলামের বহুমাত্রিক সৃষ্টির মধ্যে এটি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
ঝিঙে ফুল কাব্যগ্রন্থের কবিতার তালিকা
- সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ
- সিন্ধুঃ দ্বিতীয় তরঙ্গ
- সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ
- গোপন প্রিয়া
- অনামিকা
- বিদায় স্মরণে
- পথের স্মৃতি
- উন্মনা
- অতল পথের যাত্রী
- দারিদ্র্য
- বাসন্তি
- ফাল্গুনী
- মঙ্গলাচরণ
- বধু-বরণ
- অভিযান
- রাখী-বন্ধন
- চাঁদনী-রাতে
- মাধবী-প্রলাপ
- দ্বারে বাজে ঝঞ্জার জিঞ্জির

চক্রবাক [ ১৯২৯ ]
“চক্রবাক” কবিতার সংকলনটি বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর এক অনন্য কাব্যগ্রন্থ, যা ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি কবির তৎকালীন মানসিক ও আবেগগত অবস্থার এক সংবেদনশীল প্রতিফলন। এই গ্রন্থে মোট ১৯টি কবিতা সংকলিত হয়েছে।
“চক্রবাক” কাব্যগ্রন্থে নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা, অন্তরদহন ও বেদনাবোধ গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কাব্যের মূল সুরে রয়েছে বিষণ্ণতা ও বিচ্ছেদ, যা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে। কবিতাগুলিতে রয়েছে প্রেমের আবেগময়তা, হারানোর যন্ত্রণা, এবং অতীত সুখের স্মৃতিচারণা। চক্রবাক পাখির প্রতীকের মতো নজরুল নিজেকেও একজন বিরহী প্রেমিক হিসেবে কল্পনা করেছেন, যিনি চিরদিন প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা করেন। নজরুল এই কাব্যে চিত্রকল্প, প্রতীক, এবং সুরেলাভাবে সংবেদনশীল শব্দচয়ন ব্যবহার করেছেন। তাঁর কাব্যের ভাষা কোমল, গীতল এবং হৃদয়গ্রাহী, যা পাঠককে গভীর আবেগে নিমজ্জিত করে।
“চক্রবাক” হল একটি জলপাখি, যার নাম থেকেই এই কাব্যের নাম। পৌরাণিক কাহিনিতে এই পাখির পুরুষ ও স্ত্রী প্রজাতিরা রাতের বেলায় একে অপর থেকে পৃথক অবস্থানে থাকে। কবি এই বিরহ ও অপেক্ষার প্রতীক হিসেবেই “চক্রবাক” নামটি গ্রহণ করেছেন।
চক্রবাক কাব্যগ্রন্থটি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী ও সংগ্রামী সত্তার বাইরে তাঁর মানবিক ও প্রেমাসক্ত কবিরূপকে প্রকাশ করে। এটি তাঁর বিষণ্ণ রোমান্টিক চেতনা এবং নিস্তব্ধ অনুভূতির নিঃশব্দ চিত্রায়ন। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে প্রেম ও বেদনার সংমিশ্রণে একটি অনবদ্য অবদান।
চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের কবিতার তালিকা
- তোমারে পড়িছে মনে
- বাদল-রাতের পাখি
- স্তব্ধ রাতে
- বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি
- কর্ণফুলী
- শীতের সিন্ধু
- পথচারী
- মিলন-মোহনায়
- গানের আড়াল
- তুমি মরে ভুলিয়াছ
- হিংসাতুর
- বর্ষা-বিদায়
- সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে
- অপরাধ শুধু মনে থাক
- আড়াল
- নদীপারের মেয়ে
- ১৪০০ সাল
- চক্রবাক
- কুহেলিকা
নতুন চাঁদ [ ১৯৪৫ ]
কাজী নজরুল ইসলামের রচিত “নতুন চাঁদ” কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সংগৃহীত কব্যকৃতি। এই গ্রন্থে নজরুলের ১৯টি অনন্য কবিতা অন্তর্ভুক্ত, যা তাঁর বিপ্লবী চেতনা, প্রেম, মানবতা ও সাম্যবাদের বিষয়বস্তু ও ভাবধারাকে প্রকাশ করে। প্রথম প্রকাশের তথ্য অনুযায়ী, এই গ্রন্থটি ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ছদরুল আনাম খানের তত্বাবধানে মোহাম্মদী বুক এজেন্সী, ৮৬এ, লোয়ার সার্কুলার রোড, কলকাতা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়।
গ্রন্থটির প্রকাশকালীন সময় চরিত্রে নজরুলের সাহিত্যকর্মে নতুন উদ্যমের সন্ধান মেলে। তাঁর কাব্য রচনায় বিদ্রোহী চেতনা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও নতুন যুগের স্বপ্ন স্পষ্টভাবে আবির্ভূত হয়। “নতুন চাঁদ” তাঁর সেই সৃষ্টিশীলতার প্রতিফলন, যেখানে সে নতুন আলোকে আবির্ভূত হওয়া ও পুরাতন বাঁধন থেকে মুক্তি লাভের কথা বলে।
অনেক পাঠক এই গ্রন্থকে নজরুলের রূপক ও বাগধারার এক চমৎকার প্রদর্শনী হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। “নতুন চাঁদ চৈত্র” বা “নতুন চাঁদ” নামে পরিচিত এই গ্রন্থটি পরবর্তীকালে সংশোধিত বা পুনঃপ্রকাশিত হতে থাকলেও, মূল প্রকাশনার ভাব ও সুর আজও নতুন প্রজন্মের মাঝে একই আগ্রহ ও অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে।
নতুন চাঁদ কাব্যগ্রন্থের কবিতার তালিকা
- নতুন চাঁদ
- চির-জনমের প্রিয়া
- আমার কবিতা তুমি
- নিরুক্ত
- সে যে আমি
- অভেদম্
- অভয় সুন্দর
- অশ্রু-পুস্পাঞ্জলী
- কিশোর রবি
- কেন জাগাইলি তোরা
- দুর্বার যৌবন
- আর কতদিন
- ওঠ রে চাষী
- মোবারকবাদ
- কৃষকের ঈদ
- চাষীর ঈদ
- আজাদ
- ঈদের চাঁদ
- চাঁদনী রাতে
মরুভাস্কর [ ১৯৫১ ]
“মরুভাস্কর” হল বাংলা সাহিত্যের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি অনন্য ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক কাব্যগ্রন্থ। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে, এবং এটি ইসলামের সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবন ও কর্ম অবলম্বনে রচিত।
মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থটি চারটি সর্গ বা অধ্যায়ে বিভক্ত। এই চারটি সর্গে মোট ১৮টি খণ্ড–কবিতা সংকলিত আছে। প্রতিটি সর্গে কবি নবীজীর জীবনের ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায় ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলিকে শিল্পিতভাবে উপস্থাপন করেছেন। এটি মূলত আধ্যাত্মিক, ঐতিহাসিক ও প্রেরণামূলক কাব্য হিসেবে রচিত।
“মরুভাস্কর” গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য হল – হজরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনচরিত। তার জন্ম, নবুয়ত লাভ, দ্বীনের প্রচার, হিজরত, যুদ্ধ, মক্কা বিজয় এবং ইসলামের বিস্তার ইত্যাদি। কাব্যে মুহাম্মদ (সঃ)-এর নৈতিকতা, দয়া, করুণা, ও নেতৃত্বগুণ তুলে ধরা হয়েছে। কাব্যটিতে ইসলামি আদর্শে জীবনযাপনের আহ্বান এবং দুনিয়াবি লোভ থেকে বিমুক্ত থাকার বাণী প্রতিফলিত।
কাব্যগ্রন্থটি নজরুলের স্বভাবসিদ্ধ সাহসী, প্রখর, ও আবেগপূর্ণ ভাষায় রচিত। ইসলামী ভাবধারার সাথে মিল রেখে রয়েছে আরবি ও ফারসি শব্দের ব্যবহার, যা কবিতাগুলোর ভাবগাম্ভীর্য ও আবহ বৃদ্ধি করেছে। শৈলীতে রয়েছে গীতিকাব্য ও মহাকাব্যের সংমিশ্রণ— যা কাব্যটিকে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ধর্মীয় মহাকাব্যের মর্যাদা দিয়েছে।
এটি কাজী নজরুল ইসলামের অন্যতম সর্বশেষ পর্যায়ের রচনা। ধর্ম ও সাহিত্যকে সমন্বিত করে তিনি দেখিয়েছেন যে সাহিত্য শুধু প্রতিবাদ বা প্রেম নয়, বরং তা হতে পারে আধ্যাত্মিক জাগরণের মাধ্যম। মুসলিম পাঠকমাত্রের জন্য এটি এক অমূল্য সম্পদ এবং নবীপ্রেমে উদ্বুদ্ধ একটি অনন্য সাহিত্যিক প্রকাশ।
“মরুভাস্কর” শুধু একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক মহাকাব্য, যেখানে কবি নজরুল ইসলাম তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও সাহিত্যের অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এটি বাংলা সাহিত্য ও ইসলামি সাহিত্যের অঙ্গনে এক ঐতিহাসিক দলিল ও অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।
মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থের কবিতার তালিকা
প্রথম সর্গ
- অবতরণিকা
- অনাগত
- অভ্যূদয়
- স্বপ্ন
- আলো-আঁধারি
- দাদা
- পরভৃত
দ্বিতীয় সর্গ
- শৈশব-লীলা
- প্রত্যাবর্তন
- “সাক্কুস সাদ্র” (হৃদয় উন্মোচন)
- সর্বহারা
তৃতীয় সর্গ
- কৈশোর
- সত্যাগ্রহী মোহাম্মদ
চতুর্থ সর্গ
- শাদী মোবারক
- খদিজা
- সম্প্রদান
- নও কাবা
- সাম্যবাদী
আরও দেখুন: