নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত

নজরুলের শ্যামা সঙ্গীতগুলির সুরগত বিশেষত্ব সহজেই দৃষ্টিকোণ আকর্ষণ করে। বাঙলাদেশের মানুষের কানে ও মনে শ্যামা সঙ্গীতের একটি সুরগত ‘টাইপ’ বা ‘নক্শা’ বা ‘ঢঙ’ বাসা বেঁধে আছে। অথচ, নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতের সুরের সেই বিশেষ ‘টাইপ’ বা ‘ঢঙ’টি নেই। এগুলিতে রাগসঙ্গীত এবং মার্গসঙ্গীতের প্রভাব প্রবল এবং প্রবল বলেই প্রথম রেকর্ড করবার সময় প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী খোল না বাজিয়ে পাখোয়াজই বাজানো হয়েছিল। অবশ্যই খাঁটি শ্যামাসঙ্গীতের ঢংয়ে নজরুল যে সঙ্গীত রচনা করেন নি, এমনও নয়।

নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত

নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত

গানের রচনা রীতির দিক থেকে বিচার করলে কিন্তু নজরুলের শ্যামা সঙ্গীতকে রামপ্রসাদ-কমলাকান্তের কাছাকাছিই মনে হবে। শ্যামা-বিষয়ক সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন এবং তাঁর গানের সুরে রামপ্রসাদী রূপটি অবিকৃত এবং অক্ষুণ্ণ আছে। রবীন্দ্রনাথের “আমিই শুধু রইনু বাকী” কিংবা “বাল্মীকি প্রতিভা” তে গ্রথিত “শ্যামা”, এবার ছেড়ে চলেছি মা!” গানটির নাম ঐ বিষয়ে সকলেরই মনে হবে। নজরুল সুরের দিক থেকে রামপ্রসাদী রূপটিকে অক্ষুণ্ণ রাখেননি বটে, কিন্তু ছন্দ ও শব্দচয়নের দিক থেকে তিনি শ্যামা সঙ্গীতের ভাবগত দিকটিকে অবিকৃত রেখেছেন। শ্যামা-শ্যামা-উমাকে অবলম্বন করে তিনি ভক্তের আকুতি ও আবদারকে একদিকে যেমন ফুটিয়েছেন, অপরদিকে তাঁদের নামিয়ে এনেছেন পারিবারিক জীবনের মধুময় বন্ধনের ক্ষেত্রে। অপরদিকে তেমনি শব্দচয়নের বেলায় তিনি ঘরোয়া ও পরিচিত শব্দকেই প্রাধান্য দিয়েছেন; এমন কি, ছন্দের ক্ষেত্রেও তিনি বাঙালির প্রিয় ও পরিচিত শ্বাসাঘাত-প্রধান ছন্দকেই মুখ্য করে তুলেছেন।

নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত

 

হালিশহরের সাধক-কবি রামপ্রসাদ সেনের পরে নজরুলই একমাত্র কবি যিনি প্রায় ২৪৭টির মত শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন। অন্য এক সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও হিন্দুর আরাধ্যা একজন দেবীর গুণকীর্তণ করার জন্য কেন তিনি এত গান রচনা করলেন, জানতে কৌতুহল হয়। প্রতিটি গানের কী অসাধারণ শব্দবিন্যাস। ‘ভক্তি আমার ধুপের মত উর্দ্ধে ওঠে অবিরত’ বা ‘মার হাসি মুখ চিত্তে ভাসে চন্দ্রসম নীলাকাশে’। এই গানেরই আরও কয়েকটা লাইনের উল্লেখ করলে কাজী সাহেবের লেখনীর মধ্যে ভক্তিভাবের আভাস পাওয়া যাবে। ‘অন্তরলোক শুদ্ধ হল পবিত্র সেই ধুপসুবাসে (ইসলাম ধর্মে একমাত্র মৃত্যুর পরেই ধুপের ব্যবহার করা হয়) / সব কিছু মোর পুড়ে কবে চিরতরে ভষ্ম হবে, মার ললাটে আঁকব তিলক সেই ভষ্মবিভূতিতে’। শোনা যায়, তিনি ছিলেন কালীভক্ত।

পারিবারিক নানা প্রতিবন্ধকতা নজরুলকে আরও বেশি কালীনির্ভর করে তুলেছিল। স্ত্রী প্রমীলা কাজীর স্থায়ি আরোগ্য এবং পুত্র বুলবুলের মুত্যু তাঁর মনকে আরও দুর্বল করে তোলে। মুর্শিদাবাদে লালগোলা বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার বরদাচরণ মজুমদার ছিলেন তন্ত্রসাধক। তিনিও ছিলেন কালীভক্ত। তাঁর যোগবলে তিনি কাজী সাহেবের মৃত ছেলে বুলবুলকে দেখাতে পারবেন, এই কথা শোনার পরে নজরুল তাঁর কাছে দীক্ষা নেন। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কালীসাধনা করতেন। বিষয়টার মধ্যে কোনও হ্যালুশিনেসন ছিলো কিনা জানা যায় নি। স্ত্রীর শারীরিক সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য তিনি কোথায় না গেছেন? পীরের দরগা থেকে ওষুধ সংগ্রহ করেছেন, বিভিন্ন মন্দির থেকেও দৈব্ ওষুধ নিয়ে আসতেন। সেই কারণে একবার তিনি বিশিষ্ট কথা-সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (তারাশঙ্করও ছিলেন তন্ত্রসাধক) কাছে গিয়েও ওষুধ নিয়ে আসেন।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

কালীভক্ত এবং সাধক হওয়ার জন্য নজরুল বামাক্ষ্যাপার কাছেও গিয়েছিলেন। তবে শ্যামা মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও নির্ভশীলতা না থাকলে কিন্তু শুধুমাত্র বাহ্যিক ঘটনার প্রভাবে এমন আত্মনিবেদনের গান লেখা সহজ নয়। শ্যামাসংগীতের যে দর্শন, তা তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধী করেছিলেন। শুধু গান লিখেই থেমে থাকেননি। সেই সব গানে সুরারোপও করেছেন। ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’ গানটিতে কাজী সাহেব মালকোষ রাগাশ্রীত সুর করেছিলেন। কী অদ্ভুত দর্শন গানের প্রতিটি ছত্রে। ‘জ্বলিয়া মরিবি কে সংসার জ্বালায়, তাহারে ডাকিছে মা কোলে আয়, কোলে আয়, জীবনে শ্রান্ত ওরে ঘুম পাড়াইতে তোরে, কোলে তুলে নেয় মা মরণেরও ছলে।’

তাঁর সৃষ্টিতে তিনি দেবী কালীকাকে তিনরকমভাবে দেখেছিলেন। কন্যারূপে, মাতৃরূপে এবং অশুভনাশিনীরূপে। ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ গানটিতে শ্যামার কন্যারূপকেই প্রত্যয় করা যাবে। এই গানেরও একটি লাইনের উল্লেখ করতে ইচ্ছা করছে। ‘পাগলী মেয়ে এলোকেশী নীশিথিনির দুলিয়ে কেশ, নেচে বেড়ায় দিনের চিতায় লীলার যে তার নাইকো শেষ। / সিন্ধুতে মার বিন্দুখানিক ঠিখরে পড়ে রূপের মানিক, বিশ্বে মায়ের রূপ ধরেনা, মা আমার তাই দিগবসন’।

 

কাজী নজরুল ইসলাম

 

এই গানে কাজী সাহেব শ্যামা মায়ের কন্যা এবং মাতৃরূপকেই প্রকাশ করেছেন। তাঁর চেতনায় মাকে শুধুমাত্র দর্শন আর তত্ত্বের মধ্যে আটকে না রেখে করে তুলেছেন ঘরের মেয়ে। পারবারিক প্রতিবন্ধকতা আর অপার কালীভক্তি যে বিদ্রোহীকবিকে কখন কালীসাধকে পরিণত করেছিল তা বোধহয় তিনি নিজেও জানতে পারেননি। অবশ্য এই সব প্রসঙ্গ কি ১৯৭৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে উৎসাহী কিছু মানুষ প্রকাশ করেছিলেন না বাস্তবে ঘটেছিল সেই বিষয়ে কিছু বিতর্ক রয়ে গেছে কিন্তু ইসলামী সংগীত রচনার পাশাপাশি একাধিক বৈষ্ণবকীর্তণ, গজল, শ্যামাসংগীত যে রচনা করেছিলেন তা নিয়ে কোনও বিতর্ক থাকার কথা নয়। সেই সব শ্যামাসংগীত যে অত্যন্ত উঁচু দরের এবং উৎকৃষ্ট সে বিষয়ও কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment