কাজী নজরুলের গানে দৃষ্টান্ত অলঙ্কারের প্রয়োগ : যে অলঙ্কারে (১) উপমেয় ও উপমান দুইটি স্বতন্ত্র বাক্যের অন্তর্গত হয়, (২) উপমেয় ও উপমানের সাধারণ ধর্ম থাকে, (৩) সাধারণ ধর্ম ভিন্ন হাওয়া সত্ত্বেরও তাদের মধ্যে একটা প্রণিধান গম্য ভাবগত সাদৃশ্য থাকে এ জন্য উপমেয় উপমানের এই সাধারণ ধর্মকে বিশ্ব প্রতিবিম্ব ভাবাপন্ন সাধারণ ধর্ম বলা হয় এবং (৪) তুলনাবাচক শব্দের প্রকাশ থাকে না, তাকে বলা হয় দৃষ্ঠান্ত অলঙ্কার।
কাজী নজরুলের গানে দৃষ্টান্ত অলঙ্কারের প্রয়োগ । নজরুলের ভাবনা
(১) এ আঁখিজল মোছপিয়া, ভো েলা ভোলো আমারে । মনে কে গো রাখ তারে ঝরে যে ফুল আঁধারে। (নজরুল-গীতিকা)
এই অংশটি প্রিয়ার প্রতি প্রেমিকের উক্তিতে বিবৃত হয়েছে। ‘আমারে’ বলতে প্রেমিককে বুঝানো হয়েছে। প্রেমিককে তুলনার বিষয় করা হয়েছে বলে প্রেমিক উপমেয়। প্রেমিকের সঙ্গে ঝরা ফুলের তুলনা করা হয়েছে বলে ঝরাফুল উপমান। উপমেয় ও উপমানের সাধারণ ধর্ম ভিন্ন হয়া সত্ত্বেও এদের মধ্যে ভাবগত দিক দিয়ে প্রাণিধানগম্য সাদৃশ্য (আঁখিজল মুছে প্রেমিককে ভুলে যাওয়ার উপদেশ এবং অন্ধকারে ঝরে-পড়া ফুলের বিষয় মনে রা রাখার কথা উল্লেখ আছে। এজন্য একে বলা হয় বিম্বপ্রতিবিঘ্ন ভােেবর সাধারণ ধর্ম। উপমেয়-উপমান দুইটি স্বতন্ত্র বাক্যে আছে, তুলনাবাচক শব্দেরও উল্লেখ নেই।
(২) আমায় নহে গো, ভালবাস শুধু, ভালবাস মোর গান । বনের পাখীরে কে চিনে রাখে গান হলে অবসান। (বুলবুল) এখানে ‘আমায় বলতে প্রমিককে বুঝানো হয়েছে। প্রেমিক এখানে উপমেয়। উপমেয় প্রমিকের সঙ্গে বনের পাখীর তুলনা করা হয়েছে। বনের পাখী তাই উপমান। উপমেয়ের সাধারণ ধর্ম- প্রেমিকের প্রতি ভালবাসা নয়, তার গানের প্রতি ভালবাসা, উপমানের সাধারণ ধর্ম- গান শেষ হওয়ার পরে বনের পাখী সম্পর্কে আগ্রহের অভাব। উপমেয় ও উপমানের সাধারণ ধর্ম ভিন্ন হলেও এদের মধ্যে এক প্রকার সূক্ষ্ম ভাবগত সাদৃশ্য আছে। উপমেয়-উপমান স্বতন্ত্র বাক্যের অন্তর্গত, – তুলনাবাচক শব্দের উল্লেখও নেই ।
(৩) নিও না গো মোর অপরাধ তোমার পানে চাই যদি বা ভুলে ।
দেখলে পরে পূর্ণিমা চান
চিরননিই সাগর ওঠে দুলে। (অখণ্ড নজরুল গীতি)
প্রেমিককে লক্ষ্য করে প্রিয়ার উক্তিতে অংশটি বিবৃত হয়েছে। উপমেয় এখানে প্রিয়া। প্রিয়ার সঙ্গে সাগরের তুলনা করা হয়েছে। সাগর তাই উপমান। উপমেয়ের সাধারণ ধর্ম হল প্রেমিক সম্পর্কে প্রিয়ার আগ্রহ ও উপমানের সাধারণ ধর্ম হল পূর্ণিমা চাঁদের আবির্ভাবে সাগরের প্রতিক্রিয়া।
উপমেয়-উপমানের সাধারণ ধর্ম ভিন্ন হলেও এদের মদ্যে একটা সূক্ষ্ম প্রণিধানগম্য ভাবগত সাদৃশ্য লক্ষণীয়। উপমেয় ও উপমান দুইটি স্বতন্ত্র বাক্যের অন্তর্গত ও তুলনাবাচক শব্দেরও উল্লেখ করা হয়নি।
(৪) মোর প্রথম মনের মুকুল ঝরে গেল হায় মনে, মিলনেরি ক্ষণে, কপোতীর মিনতি কপোত শুনিল না, উড়ে গেল গহন বনে। (,) ‘মোর’ বলতে প্রিয়াকে বুঝানো হয়েছে। প্রিয়া এখানে উপমেয়। কারণ প্রিয়াকে তুলনার বিষয় করা হয়েছে। প্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে কপোতীর কপোতী তাই উমপান। উপমেয় প্রিয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ ধর্ম হল প্রেমিকের সঙ্গে মিলনের পূর্বে সেই সম্ভাবনার অবসান ঘটা এবং উপমান কপোতীর ক্ষেত্রে সাধারণ ধর্ম হল মিলনের সম্ভাবনার পূর্বে কপোতের গহন বনে উড়ে যাওয়া। উপমেয় ও উপমানের এই সাধারণ ধর্ম ভিন্ন হলেও এদের মধ্যে ভাবগত দিক দিয়ে একটা সাদৃশ্য প্রাণিধানগম্য হয়ে ওঠে। উপমেয়-উপমান দুইটি স্বতন্ত্র বাক্যের অন্তর্গত, তুলনাবাচক শব্দেরও উল্লেখ নেই।
(৫) মনের কথা কি মুখে সব বলা যায়?
রাতের আঁধারে যত তারা ফোটে
আখি কি দেখিতে পায়? (…)
মনের কথাকে তুলনার বিষয় করা হয়েছে বলে মনের কথা উপমেয়। মনের কথার সঙ্গে অন্ধকার রাত্রির তারকারাজির তুলনা করা হয়েছে। অন্ধকার রাতের তারকারজি তাই উপমান। উপমেয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ ধর্ম- মনের সব কথা মুখে প্রকাশ করার অক্ষমতা, উপমানের ক্ষেত্রে সাধারণ ধর্ম অন্ধকার রাত্রির আকাশেরসমস্ত তারকারিজ দর্শনের অক্ষমতা। উভয় ক্ষেত্রে সাধারণ ধর্ম সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও এদের মধ্যে প্রণিধানগম্য এক প্রকার ভাবগত সাদৃশ্য আছে। উপমেয় ও উপমান স্বতন্ত্র বাক্যের অন্তর্গত এবং তুলনাবাচক শব্দের উল্লেখ নেই।
(৬) হৃদয় কেন চাহে হৃদয় আমি জানি মন জানে ।
জানে নদী কেন যে সে ছুটে যায় সাগর পানে। (“)
‘আমি’ বলতে বুঝানো হয়েছে প্রেমিককে; প্রেমিক এখানে উপমেয়। প্রেমিকের সঙ্গে নদীর তুলনা করা হয়েছে। নদী তাই উপমান। উপমেয় প্রেমিকের ক্ষেত্রে সাধারণ ধর্ম হল অন্য হৃদয়ের ভাবনা বুঝবার ক্ষমতা এবং উপমান নদীর ক্ষেত্রে সাধারণ ধর্ম হল সাগরের দিকে ধাবিত হওয়ার আগ্রহ। উপমেয়-উপমানের সাধারণ ধর্ম ভিন্ন হলেও এদের মধ্যে একটা ভাবগত প্রণিধানগম্য সাদৃশ্যের দিক আছে যেজন্য এই দুইটি সাধারণ ধর্মকে বিম্বপ্রতিবিম্ব ভাবের সাধারণ ধর্ম বলা যেতে পারে। উপমেয় ও উপমান স্বতন্ত্র বাক্যের অন্তর্গত এবং তুলনা বাচক শব্দেরও উল্লেখ করা হয় নি।
(৭) নাই চিনিলে আমারে তুমি রইব আধেক চেনা।
চাঁদ কি জানে কোথায় ফোটে চাঁদনী রাতে হেনা । (,,)
প্রিয়াকে লক্ষ্য করে প্রেমিকের উক্তিতে অংশটি বিবৃত হয়েছে। প্রেমিক এখানে উপমেয়। প্রেমিকের সঙ্গে চাঁদের তুলনা করা হয়েছে বলে চাঁদ উপমান। উপমেয় প্রেমিকের ক্ষেত্রে সাধারণ ধর্ম হল প্রিয়া তার কাছে “আধেক চেনা” থাকবে, উপমান চাঁদের ক্ষেত্রে সাধারণ ধর্ম হল চাঁদিনী রাতে হেনা ফুল ফোটার প্রসঙ্গে প্রকৃত তথ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। সাধারণ ধর্ম ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও এদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম প্রণিধানগম্য ভাবগত সাদৃশ্য আছে। তুলনাবাচক শব্দের উল্লেখ নেই এবং উপমেয়- উপমান দুইটি স্বতন্ত্র বাক্যে আছে।
(৮) দক্ষিণ সমীরণ কুসুম ফুটায় গো,
আমারি কাননে ফুল কেন ঝরে যায় গো-
জ্বলিল প্রদীপ সকলেরি ঘরে হায় ।
নিভে গেল মোর দীপ গোধূলি লগনে। (,,)
উপমেয় এখানে দক্ষিণ সমীরণ ও উপমান প্রদীপ। প্রিয়ার উকিতে অংশটি বিবৃত হয়েছে। দক্ষিণ সমীরণ সর্বত্র ফুল ফুটালেও প্রিয়ার কাননে ফুল ঝরে যাওয়ার কথা এবং সকলের ঘরে প্রদীপ জ্বললেও গোধূলির সময় প্রিয়ার দীপ নিভে যাওয়ার কথা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। উপমেয়-উপমানের সাধারণ ধর্ম ভিন্ন হলেও এদের মধ্যে আছে এক প্রকার সূক্ষ্ম প্রণিধান গম্য ভাবগত সাদৃশ্য। তাছাড়া তুলনাবাচক শব্দের উল্লেখ নেই, উপমেয়-উপমানও আছে দুইটি স্বতন্ত্র বাক্যে।
আরও দেখুনঃ