মুসলিম রেনেসাঁয় নজরুলের ভূমিকা । নজরুলের ভাবনা

মুসলিম রেনেসাঁয় নজরুলের ভূমিকাঃ  পাক-ভারত-বাংলাদেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবার পর থেকে এদেশের মুসলমানও নিরুৎসাহ, নিরুদ্যম, ভগ্নপ্রাণ হয়ে এক ভয়াবহ নির্জীবতার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। যদিও তার অধপতনের শুরু অনেক পূর্ব থেকেই।

 

মুসলিম রেনেসাঁয় নজরুলের ভূমিকা

 

মুসলিম রেনেসাঁয় নজরুলের ভূমিকা । নজরুলের ভাবনা

 

যে দিন মুসলমান সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী বিস্তৃত হলো এবং আল-কোরআনের পূর্ণ জীবনদর্শন ও তৌহিদের মূলমন্ত্র থেকে দূরে সরে এল সে দিন থেকে সে যে শুধু তার তখত-তাউস হারালো তাই নয়, তার চাইতেও বড় মানুষের চিন্তা-জগৎ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কারারী ও দিশারীর পথ থেকে বিতাড়িত হলো।

পাক-ভারতেরও এর অন্যথা ঘটলো না। বিশেষ করে সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে রাজরোষে পড়ে মুসলিম নির্যাতনের অন্ত রইল না। বঞ্চিত, অবহেলিত, উৎপীড়িত মুসলিম অক্ষম ক্ষোভে, রোখে বেদনায় জ্বলতে থাকলো, পুড়তে লাগলো। কিন্তু এই উৎপীড়ন ও অন্যায় আচরণ ও নিষ্ঠুর অবহেলা-ই বহন করে নিয়ে এল নতুন উত্থানের বীজ।

 

মুসলিম রেনেসাঁয় নজরুলের ভূমিকা

 

স্যার সৈয়দ আহমদ, নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখের কার্যাবলির মধ্য দিয়ে অসাড় মুসলিম সমাজে নবচেতনার সাড়া জাগলো। উনিশ শতকের শেষে এই আলোড়নের পটভূমিতেই নজরুল ইসলামের আবির্ভাব বাঙালি মুসলিম মানসে এই নব জাগরণের আহ্বান নিয়ে এলেন মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মীর মশাররফ হোসেন, লুৎফর রহমান, ইয়াকুব আলী চৌধুরী, কায়কোবাদ, কবি মোজাম্মেল হক প্রমুখ।

এঁদের সবার লেখাতেই বলতে গেলে মুসলমানের প্রাচীন গৌরবের কথা ধ্বনিত হলো, উচ্চারিত হলো তার বর্তমান অধপতিত জীবনের কথা এবং ইঙ্গিত থাকলো নব জাগরণের, নতুনভাবে নিজের কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে গড়ে তুলবার। কিন্তু এই সব কথা এত বেশি বক্তৃতার সুরে বলা হলো যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজচেতনার কাজ আংশিক সিদ্ধ হলেও, কালজয়ী শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচনার কাজ প্রায়াই-ই ব্যর্থ হলো। শুধু ব্যর্থ হলো না নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে।

 

মুসলিম রেনেসাঁয় নজরুলের ভূমিকা

 

ব্যর্থ হলো না বললে কম বলা হয়। আশ্চর্য রকমের সফল হলো নজরুলের লেখনীতে। যার ফলে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন ধারার প্রবর্তন হলো, একটি নতুন যুগের সৃষ্টি হলো। মুসলিম রেনেসাঁর মন্থর স্রোতাবেগকে একটি তরঙ্গ যেন উচ্ছল প্রাণবন্যায় রূপান্তরিত করল। বাংলা সাহিত্যের আকাশে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে। এবং সীজারের মতো তিনিও এলেন, দেখলেন ও জয় করলেন।

তাঁর এক একটি কবিতা বেরুতে লাগল “মোসলেম ভারতে” আর সমগ্র বাঙালি শিক্ষিত মানুষ। এক নতুন শিল্পীর আশ্চর্য বলিষ্ঠ প্রকাশভঙ্গি, অদ্ভূত ছন্দ-মাধুর্য এবং বিপ্লব ও আশার বাণীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে সচকিত হলো, সঞ্জীবিত হলো। এই প্রসঙ্গে একটি কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার। কোনো সত্যিকারের মহৎ শিল্পীই কোনো একটি সম্প্রদায়, জাতি কিংবা দেশের হন না।

মুসলিম রেনেসাঁয় নজরুলের ভূমিকা

রমা রোলা কি টলস্টয়, শেক্সপিয়ার কি গ্যোটে, রবীন্দ্রনাথ কি নজরুল ইসলাম কোনো বিশেষ বা সমাজের নন-তারা সমগ্র বিশ্বের এবং সমগ্র কালের মহৎ শিল্পী তাঁর রচনায় বহু ধারার সৃষ্টি করেন। তার সৃষ্টি বহু মানুষকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

যে ধারা থাকে যেমনভাবে প্রভাবান্বিত বা অনুপ্রাণিত করে তিনি সেই স্বীকৃতি প্রাধান্য পায়। কিন্তু পণ্ডিত বিচারে সাবধান না হলে, মূল্য বিকৃতির আশঙ্কা থাকে। বিভিন্ন ধারার সমন্বয়ে যে ঐক্যবদ্ধ সামগ্রিক রূপটিতে মহৎ শিল্পীর প্রাণ, তার সম্পর্কে নিঃসন্দিগ্ধ ও দ্বিধাহীন উপলব্ধির পরই আমরা খণ্ডিত বিচারের প্রশ্ন দিতে পারি।

মুসলিম রেনেসাঁয় নজরুলের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা এ তথ্য বিস্তৃত হলে এক দিকে যেমন নজরুলের মর্যাদা বৃদ্ধি না করে খর্ব করব, তেমনি অন্য দিকে সাহিত্যের মূল্য বিচারে নিজেদের মৃঢ়তার পরিচয় দেব। কারণ নজরুল সব কিছুর উপরে মানবতার কবি, অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কবি, নিপীড়িত মানবতার স্বপক্ষে মুক্তি-আন্দোলনের তুর্যবাদক অগ্রসেনানী ।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment