নজরুলের কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য ও রূপায়ন : ভাব ও বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে সমগ্র নজরুল কাব্যকে দুটো প্রধান ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক শ্রেণীতে পড়বে ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ফণী-মনসা’, জিঞ্জির’, ‘সন্ধ্যা’ ও ‘প্রলয়-শিখা’। ‘দোলন চাঁপা’, ছায়ানট’, ‘পুবের হাওয়া’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘চক্রবাক এগুলোর কাব্যধর্ম সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র পর্যায়ের।
নজরুলের কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য ও রূপায়ন । নজরুলের ভাবনা
নিজের দেশ-জাতি-ধর্ম সম্পর্কে কবি তাঁর আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ-হতাশা, রোষ-উল্লাসকে প্রকাশ করেছেন প্রথম পর্যায়ের রচনাবলিতে। এখানে আবেগের প্রখরতার সঙ্গে মত বা বক্তব্য প্রচারের তাগাদা প্রায় সম পরিমাণে মিশ্রিত। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাব্যগহনে প্রেমাশ্রিত অন্তরঙ্গ ব্যক্তিগত হৃদয়াবেগই সার্বভৌম।
নজরুলের উত্তরকাব্য ‘নতুন চাঁদ’ ও ‘শেষ সওগাতে’ উভয় ধর্মের কবিতাই সংকলিত হয়েছে। স্বভাবতই আমাদের আলোচনার প্রধান অবলম্বন হবে প্রথম ধারার কাব্যগ্রন্থসমূহ। এগুলোরই মধ্যে ‘অগ্নিবীণা’ই প্রধান। বাংলাকাব্যে মুসলিম ঐহিত্যের রূপায়ণে নজরুলের কৃতিত্ব এই গ্রন্থের সর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যক কবিতায় সর্বাপেক্ষা অধিক উজ্জ্বলতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার’, ‘শাত-ইল-আরব’, “খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মহররম’ সবই ‘অগ্নিবীণা’র কবিতা।
নজরুল কাব্যে ইসলামী অনুপ্রেরণার স্বরূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে আমরা আরো একটি তৃতীয় ধারার সীমানা নির্দেশ করতে পারি যার সবটাই সরাসরি ইসলাম-প্রীতিমূলক। যেমন- ‘কাব্য আমপারা’ (অনুবাদ), ‘মরু-ভাস্কর’ এবং তাঁর অজস্র ইসলামী গান। কবির ধর্মপ্রাণ সামাজিক সত্তা এই রচনাগুলোর মধ্যে আন্তরিক বিশ্বাসের প্রেরণায় বিকাশ লাভ করেছে। শিল্পমূল্য বিচারের কঠিন মানদণ্ড আরোপ করলে হয়তো এর সবটা চিরকালের জন্য উত্তীর্ণ হতে পারবে না, কিন্তু একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, মুসলিম গণমানসের ওপর এগুলোর প্রভাবই সর্বাপেক্ষা ব্যাপক এবং গভীর।
বাঙালি মুসলমানের স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধ এগুলোকে আশ্রয় করেই আত্মসচেতন হয়েছে। যে রাজনৈতিক প্রয়াস পরবর্তীকালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় পরিণতি লাভ করেছে, নজরুলের ইসলামী গান যেন প্রথম থেকেই হৃদয়ে হৃদয়ে তার আবহ সঙ্গীত রচনায় রত ছিল।

“অগ্নিবীণা’র কথায় ফিরে আসা যাক। এখানে মুসলিম ঐতিহ্যের রূপায়ণ উৎকৃষ্ট কাব্যমূল্যের মর্যাদা লাভ করেছে। প্রতিভার যে বিশিষ্ট চেতনা ও প্রক্রিয়ার ফলে বাংলাকাব্যে এই নতুন শক্তি সঞ্চারিত হলো তার মর্মাবাণী আজও আমাদের জন্য এক গভীর তাৎপর্য বহন করে।
আরও দেখুনঃ