নজরুল সঙ্গীত প্রসঙ্গ – মুহাম্মদ মাহবুব উল হক [ বই রিভিউ ]

বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সৃষ্টিগুলো যেমন ভাষা ও সাহিত্যে নবজাগরণের সঞ্চার করেছে, তেমনই বাংলা সঙ্গীতে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা, নতুন ব্যাকরণ, নতুন প্রাণ। এই বিশাল ও বহুমাত্রিক সৃষ্টিকর্মকে কেন্দ্র করেই মুহাম্মদ মাহবুব উল হক রচিত প্রবন্ধগ্রন্থ “নজরুল সঙ্গীত প্রসঙ্গ”—যা নজরুলসঙ্গীতের তাত্ত্বিক ভিত্তি, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যকে অত্যন্ত নিপুণ গবেষণাভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করে।

 

নজরুল সঙ্গীত প্রসঙ্গ সূচিপত্র

বইয়ের নাম: নজরুল সঙ্গীত প্রসঙ্গ
সম্পাদনা ও সংকলন: মুহাম্মদ মাহবুব উল হক
প্রকাশক: বাংলা একাডেমি (ঢাকা)
প্রথম প্রকাশ: বাংলা একাডেমির উদ্যোগে, সাধারণত নজরুল জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে

গ্রন্থের মূল ভাবনা: নজরুল সঙ্গীতকে বোঝার এক দর্পণ

“নজরুল সঙ্গীত প্রসঙ্গ” বাংলা সঙ্গীতের শিক্ষার্থী, নজরুল গবেষক, সঙ্গীতশিল্পী এবং সংস্কৃতিবিষয়ক পাঠকের জন্য এক অনন্য রেফারেন্স-গ্রন্থ। লেখক নজরুলের সৃষ্টিকে শুধু সুরবদ্ধ গান হিসেবে দেখেননি; বরং তাঁর গানগুলোর পিছনে থাকা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে পাঠকের সামনে এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যা নজরুল সঙ্গীতকে নতুন আলোয় উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।

লেখকের বিশ্লেষণ নজরুলের সৃষ্টিকে একটি পরিপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারক হিসেবে ব্যাখ্যা করে—যেখানে বিদ্রোহ, প্রেম, মানবতা, সাম্য, ধর্মীয় ভাবধারা, বাঙালির লোকসংস্কৃতি এবং প্রাচ্য সংগীতশাস্ত্রের সমন্বয় বিস্ময়করভাবে মিশেছে।

বইটিতে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো

১. নজরুলের রাগ-রাগিণী ব্যবহার

গ্রন্থে নজরুলের সুরারোপের রাগভিত্তি বিশেষ বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। তিনি কীভাবে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কাঠামো ব্যবহার করে বাংলা গানকে একটি নতুন শিল্পরূপে উন্নীত করেছিলেন—লেখক তার শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
নজরুলের সৃষ্টিতে রাগভিত্তিক গান যেমন: ভৈরবী, কল্যাণ, ইয়ামন, বেহাগ, খাম্বাজ ইত্যাদির নান্দনিক মেলবন্ধন তুলে ধরা হয়েছে উদাহরণসহ।

২. তালের কাঠামো ও সুরের গঠন

লেখক তালের দৃষ্টিকোণ থেকে নজরুলকে দেখিয়েছেন এক সাহসী পরীক্ষক। ট্রিতাল, দাদরা, কাহারবা, ঝাঁপতাল—বিভিন্ন তালের ওপর নজরুলের সুরারোপের স্বতন্ত্রতা বইটিতে বিশ্লেষিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নজরুল প্রচলিত তালের ভেতর নতুন অঙ্গসঞ্চার করেছিলেন—যা তাঁকে “সুরশিল্পী” হিসেবে আরও অনন্য করে তুলে।

৩. বাণীর শিল্পরূপ

নজরুলের গানে বাণী ও সুর একে অন্যের পরিপূরক। লেখক এখানে বর্ণনা করেছেন—

  • কীভাবে নজরুল তাঁর কবিতার ভাবকে সঙ্গীতে পরিণত করেছেন,
  • কীভাবে শব্দচয়ন, অলংকার, ছন্দ ও ধ্বনির সমন্বয়ে সুর-বাণীর সমন্বিত আবেদন তৈরি হয়েছে,
  • এবং কেন তাঁর গানের শাব্দিক ও সুরগত সৌন্দর্য আজও অপরিবর্তনীয় মর্যাদায় উজ্জ্বল।

লেখক গানের লাইন উদ্ধৃত করে পাঠককে সুরের ভেতর বাণীর গভীরতা অনুভব করাতে সক্ষম হয়েছেন।

৪. নজরুলের সৃষ্টির প্রেক্ষাপট—রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি

এই অধ্যায়গুলো বইটিকে আরও গুরুত্ববহ ও গবেষণামূল্য করে তুলেছে। নজরুলের গান শুধু নান্দনিক সাধনার জন্য লেখা হয়নি; সেগুলো সমসাময়িক রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, উপনিবেশবিরোধী মনোভাব এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে উচ্চারিত প্রতিবাদী কণ্ঠও বটে।
লেখক বিশ্লেষণ করেছেন—

  • কীভাবে ‘বিদ্রোহী কবি’ পরিচয় তাঁর সংগীতে প্রতিফলিত হয়েছে,

  • কেন তাঁর গান হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজে সমান জনপ্রিয়,

  • এবং কীভাবে উপমহাদেশের লোকসংস্কৃতি তাঁর সৃষ্টিকে আরও মাটির কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।

৫. নজরুল সঙ্গীতের উত্তরাধিকার ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা

বইটির আরেকটি মূল্যবান অংশ হলো—নজরুল সঙ্গীতের সংরক্ষণ, প্রচার ও বর্তমান অবস্থান নিয়ে আলোচনা। লেখক উল্লেখ করেছেন, নজরুলের সৃষ্টিকে সঠিক সুরে ও শুদ্ধ রূপে পরিবেশন করা এখনও কতটা প্রয়োজন। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে বইটি ইতিহাসচর্চার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি একটি দায়িত্ববোধও তুলে ধরে।

ভাষাশৈলী ও উপস্থাপন—স্বচ্ছতা, সহজতা ও গবেষণার দৃঢ়তা

এই বইয়ের অন্যতম শক্তি হলো ভাষার স্বচ্ছতা। যদিও বইটিতে সংগীততত্ত্ব, রাগ-তাল, সুরের জটিল কাঠামো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে, লেখক কখনোই পাঠককে বিভ্রান্ত বা চাপে ফেলেননি। জটিল বিষয়কে সহজ ভাষায়, ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা বইটিকে সব পাঠকের জন্য উন্মুক্ত করে তুলেছে—নতুন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে পণ্ডিত গবেষক পর্যন্ত।

উদ্ধৃতি, উদাহরণ এবং প্রেক্ষাপটভিত্তিক বিশ্লেষণের কারণে বইটি শুধু তত্ত্বসমৃদ্ধ নয়, বরং পাঠযোগ্যতাতেও অনন্য।

সমগ্র মূল্যায়ন: নজরুল সঙ্গীত গবেষণার এক মূল্যবান দলিল

“নজরুল সঙ্গীত প্রসঙ্গ” বইটি নজরুলের সঙ্গীতভাণ্ডারের ওপর নির্মিত একটি সুসমন্বিত, তাত্ত্বিক ও গভীর গবেষণাপূর্ণ প্রবন্ধগ্রন্থ।
এটি—

  • নজরুলসঙ্গীতের ইতিহাস,
  • তার শাস্ত্রীয় ভিত্তি,
  • তার নান্দনিক ঐশ্বর্য,
  • এবং উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে তার সম্পর্ক—
    সবকিছুই সুবিন্যস্তভাবে তুলে ধরে।

বাংলা সঙ্গীতচর্চার ধারায় নজরুলকে কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত, তাঁর গান কীভাবে সংরক্ষণ করা উচিত—এসব প্রশ্নেরও স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় এই গ্রন্থে।

যাঁরা নজরুলের গানকে শুধু শুনে উপভোগই নয়, বুঝতে এবং গভীরভাবে অনুধাবন করতে চান, তাঁদের কাছে এই বইটি একটি অপরিহার্য সম্পদ, এক সত্যিকার মণিমুক্তা

Leave a Comment