বাংলা গানের ভাণ্ডারে অন্যতম সংবেদনশীল ও বেদনাময় সৃষ্টিগুলোর একটি হলো কাজী নজরুল ইসলামের “কেন আসে কেন তারা চলে যায়“। এই গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর ‘চন্দ্রবিন্দু‘ গ্রন্থে, যা প্রকাশিত হয় ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে (১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর)।
গ্রন্থের প্রকাশনা সংক্রান্ত তথ্য:
- প্রকাশনা উৎস: ডি. এম. লাইব্রেরি
- মূল্য: ২ টাকা
- উৎসর্গপত্র:
“পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীমদ্দাঠাকুর শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র পণ্ডিত মহাশয়ের শ্রীচরণকমলে”
কেন আসে কেন তারা চলে যায়
সৃষ্টির আবেগগত প্রেক্ষাপট
নজরুলের অকালপ্রয়াত পুত্র বুলবুল-এর মৃত্যুর পর তাঁর হৃদয় যে গভীর শোক ও বেদনায় আচ্ছন্ন হয়েছিল, সেই আবেগ থেকেই জন্ম নেয় চন্দ্রবিন্দু গ্রন্থের অধিকাংশ গান। যদিও গ্রন্থটি মূলত হাস্যরসাত্মক ও হালকা ধাঁচের সংগীতে ভরপুর, এই গানটি ব্যতিক্রম—এটি গভীর বেদনা, বিচ্ছেদ ও ক্ষণস্থায়ী সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
রাগ ও সুরের বিন্যাস
- রাগ: খাম্ভাজ (মধ্যমান)
- ভাবধারা: বেদনা ও প্রশ্নবোধকতা; অনিত্যতার দর্শন
- সুরের বৈশিষ্ট্য: ধীর লয়ে আবেগঘন পরিবেশনা, যা শ্রোতাকে বেদনার স্রোতে ডুবিয়ে দেয়
গানের কথা
কেন আসে কেন তারা চলে যায় –
ক্ষণেক তরে॥
কুসুম না ফুটিতে কেন ফুল-মালী
ছিঁড়িয়া সাজি ভরে কানন করে খালি,
কাঁটার স্মৃতি বেঁধে লতার বুকে হায়,
ব্যথা-ভরে॥
ছাড়িয়া স্নেহ-নীড় সুদূর বন-ছায়
বিহগশিশু কেন সহসা উড়ে যায়,
কাঁদে জননি তার ঝরা পালকখানি
বুকে ধরে॥
গানের মূল ভাব
এই গানে নজরুল জীবনের ক্ষণস্থায়ী আনন্দ, হঠাৎ আগমন ও অনিবার্য বিদায়ের বেদনা তুলে ধরেছেন।
- প্রথম স্তবক ফুলের না-ফোটা সত্ত্বেও তা ছিঁড়ে নেওয়ার চিত্রকল্প ব্যবহার করে অকালমৃত্যু ও অপূর্ণতার প্রতীক তৈরি করেছে।
- দ্বিতীয় স্তবক-এ মায়ের বাসা ছেড়ে বাচ্চা পাখির উড়ে যাওয়া—এটি বিচ্ছেদ ও হারানোর চিরন্তন মানবিক অনুভূতিকে ব্যক্ত করেছে।
সাহিত্যিক ও দার্শনিক তাৎপর্য
- অনিত্যতার দর্শন: জীবনের সব সুন্দর ও প্রিয় জিনিসই ক্ষণস্থায়ী।
- প্রকৃতির রূপক: ফুল, কাঁটা, পাখি ও বাসা—সবই জীবনের বাস্তবতা ও বেদনার প্রতীক।
- ব্যক্তিগত শোকের সার্বজনীন রূপ: বুলবুলের মৃত্যুশোক এখানে মানবজাতির চিরকালীন হারানোর অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়েছে।
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
- গানটি নজরুল সঙ্গীতের বেদনাময় ধারার এক অনন্য নিদর্শন।
- পরিবেশনার সময় এটি বিশেষভাবে হৃদয়স্পর্শী হয়ে ওঠে, কারণ এর পেছনে রয়েছে কবির ব্যক্তিগত জীবনযন্ত্রণার ছাপ।
- আজও এটি নজরুলসঙ্গীত শিল্পীদের ভাণ্ডারে একটি আবশ্যিক গান।
