শাস্ত্রীয় ধ্রুপদ ও নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদের তুলনামূলক আলোচনা । নজরুলের ভাবনা

শাস্ত্রীয় ধ্রুপদ ও নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদের তুলনামূলক আলোচনাঃ ধ্রুপদ থেকে ধ্রুপদ গানের উৎপত্তি। ধ্রুপদ গানকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং প্রাচীন গীতিরীতি হিসেবে ধরে নেয়া হয়। যাকে কবি কাজী নজরুল ইসলামও তার গীতিধারায় সঠিক সম্মান দিয়েছেন।

 

শাস্ত্রীয় ধ্রুপদ ও নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদের তুলনামূলক আলোচনা

 

শাস্ত্রীয় ধ্রুপদ ও নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদের তুলনামূলক আলোচনা

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিল যে, ধ্রুপদ গানই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও প্রাচীন গীতিরীতি। লঘু সঙ্গীতে ধ্রুপদ পর্যায়ের সাঙ্গীতিক দর্শনতত্ত্ব এবং শাস্ত্রীয় ধ্রুপদে দর্শন নজরুল ইসলাম ধ্রুপদ গান রচনার মাধ্যমে বাংলা গানে নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছিলেন।

মন্তব্য

(ক) নজরুলসঙ্গীতে গ্রুপদের অবস্থান রূপায়ণে অনেক মন্তব্য প্রচলিত। ধ্রুপদ গান শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠতম সঙ্গীত হলেও “শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং নজরুলসঙ্গীত বিভিন্ন দিক দিয়ে কাছাকাছি হলেও গ্রুপদ গানের পরিবেশনা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী।”

(১) নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদ এবং শাস্ত্রীয় ধ্রুপদের বিষয়বস্তু :

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদ এবং নজরুলসঙ্গীতের ধ্রুপদের বিষয়বস্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেবদেবতাদের স্তুতি বর্ণনা। সনাতন ধর্মের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ধ্রুপদ রচয়িতাগণ লিপিবদ্ধ করেছেন।

(২) সুরের বৈচিত্র্যতা :

ধ্রুপদ গান সবসময়ই কোনো-না-কোনো রাগের আদলে রচিত। সুরের বৈচিত্র্যতা রাগের ব্যবহার হিসেবেই বিন্যস্ত। যাকে বিভিন্ন তালের সীমাবদ্ধ অনুসারে বাঁধা হয়েছে।

(৩) শব্দ সমন্বয় :

ধ্রুপদ গানের শব্দ সমন্বয় যথাযথভাবে শাস্ত্রীয়। লঘু সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় যেটা ধারণ করে আছে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদ পর্যায়ের গান। আসলে বাংলা গানের ভাণ্ডারকে সঠিক এবং সুদৃঢ় করবার জন্যে বাংলা ধ্রুপদ রচনা। শব্দের গাঁথুনি অনেক ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় ধ্রুপদ থেকে হালকা প্রকৃতির তবুও বাংলা শব্দের ব্যাকরণ, নির্দেশনাবলি সম্পূর্ণ রেখে নজরুল তার ধ্রুপদ গানে শব্দসংযুক্ত করেছেন।

 

শাস্ত্রীয় ধ্রুপদ ও নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদের তুলনামূলক আলোচনা

 

(৪) বাক্য সমন্বয় :

ধ্রুপদ যেহেতু ধ্রুপদ গানের আধার বা প্রাণ সেহেতু বাক্য সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ধ্রুপদের নন্দন হার-ই ধ্রুপদ গানের বাক্য সমন্বয়। যার অবস্থান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নজরুলসঙ্গীতে সমান।

(৫) নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদ ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদের অবয়ব :

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদের ক্ষেত্রে দুই ধরনের অবয়ব লক্ষ করা যায়। প্রথম হলো, স্থায়ী, অন্তরা এবং দ্বিতীয় হলো স্থায়ীর পরে একাধিক অন্তরার সমন্বয় লক্ষ করা যায়। কিন্তু নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, আভোগের সমন্বয় দেখা যায় ।

(৬) রাগ-রাগীনির ব্যবহার :

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদ কোনো-না-কোনো রাগের উপর নির্ভর করে রচিত। কাজী নজরুল ইসলাম তার রচিত ধ্রুপদে নিজস্ব রাগ সৃষ্টি ও শাস্ত্রীয় রাগের সমন্বয় দেখিয়েছেন।

যেমন : শাস্ত্রীয় ধ্রুপদ-জাগো মেরে ভাগো
রাগ-কাফী নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদ (১) এস শংকর ক্রোধাগ্নি হে প্রলয়ংকর
রাগ- রুদ্র ভৈরব

(৭) তালের ব্যবহার :

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদের ক্ষেত্রে তালের ব্যবহার বেশি। বৈচিত্ৰ্যাগত দিক দিয়ে বিভিন্ন তালের সমাবেশ ঘটেছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদে। যেমন চৌতাল, ঝাঁপতাল, তেওড়া, সুরফাঁক ইত্যাদি। কিন্তু নজরুলসঙ্গীতে আমরা যে কয়েকটি ধ্রুপদ প্রমাণিতভাবে পেয়েছি সেখানে শুধু সুরফাক তালের ব্যবহারই দেখা যায়।

(৮) গীতিশৈলী :

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদের মতো নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদে 1 গীতিশৈলীর প্রারম্ভিক পর্যায়ে নোম, তোম দিয়ে (অর্থবিহীন শব্দ) দ্বারা আলাপ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় না। রাগের শাস্ত্রীয় নিয়ম অনুসারে নজরুলের ধ্রুপদে সামান্য আলাপের পরিবেশনা লক্ষ্য করা যায়। যেটা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগের পরিধি বেশ সময় ধরে অর্থবিহীন শব্দ দ্বারা গায়কের দক্ষতা হিসেবে সম্পন্ন হয়। পরবর্তী পর্যায়ে বন্দিশ লয়কারীর বিভিন্ন অবস্থান শিল্পী পরিবেশন করে। নজরুলের ধ্রুপদে লয়কারীর প্রভাব নেই বললেই চলে। শুধু ধ্রুপদের বৈশিষ্ট্য রক্ষার কারণেই সামান্য লয়কারীর অবস্থান লক্ষ করা যায়।

(৯) ধ্রুপদ গানের নন্দন-তাত্ত্বিক ধারা :

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদের মতো নজরুলসঙ্গীতের ধ্রুপদ শাস্ত্রীয়ভাবে সমাদৃত নয়। নন্দনতত্ত্বের সংজ্ঞা অনুসারে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত তার বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে নজরুলের ধ্রুপদের চেয়েও অনেকাংশে রূপায়িত নান্দনিক ভাবধারাকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সংযোগের কারণে নজরুল তার গানের বৈচিত্র্য সাধনে ধ্রুপদ গান রচনায় সামান্য হলেও তার সঙ্গীত প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন যা কিছু সংখ্যক সুধীজনের কাছে এবং শিল্পীর কাছে নান্দনিক রূপ লাভ করেছে।

(১০) উপমা প্রসঙ্গ :

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদ এবং নজরুলসঙ্গীতের ধ্রুপদ উভয় ক্ষেত্রেই উপমা প্রসঙ্গ বিদ্যমান। শাস্ত্রীয় ধ্রুপদের বন্ধিশ এবং নজরুলসঙ্গীতের ধ্রুপদের বন্ধিশের উপমা সাধারণত সনাতন ধর্ম অনুসারে সংযোজিত। গানের ভাবদর্শন এবং বিষয়বস্তুতে দেবদেবিদের বিভিন্ন আঙ্গিক সাধারণরূপে প্রকাশ পেয়েছে। উপমা উপস্থাপনের সার্বিকক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় ধ্রুপদ ও নজরুল ধ্রুপদ একই পর্যায়ের। যেমন – নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদ- হে প্রবল দর্পহারী কৃষ্ণমুরারী।

 

শাস্ত্রীয় ধ্রুপদ ও নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদের তুলনামূলক আলোচনা

 

তাল-সুরফাঁক
(১১) লয়কারী প্রসঙ্গ :

লয়কারীর ব্যবহার ধ্রুপদ গানে বেশ প্রচলিত। নির্দিষ্ট লয়ের বন্ধনে লয়কারী প্রদর্শিত হয়ে থাকে যা গায়কের দক্ষতার উপর নির্ভরশীল । নজরুলের ধ্রুপদ পরিবেশনায় সামান্য হলেও লয়কারীর প্রভাব লক্ষ্যণীয়।

(১২) ধ্রুপদ গানে ছন্দের ব্যবহার :

কাব্য এবং সঙ্গীত উভয় ক্ষেত্রেই রচনার প্রেক্ষাপটে যেমন ছন্দের প্রকরণ ব্যবহৃত হয় ঠিক তেমনি ধ্রুপদ গানেও বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ছন্দ ব্যবহৃত হয়। শাব্দিক এবং অক্ষরগত ছন্দের সংযোগ বেশ। সুরের বৈচিত্র্যের কারণে অনেক সময় ছন্দের অমিল প্রতিফলিত হয়ে থাকে।

(১৩) যন্ত্রের ব্যবহার :

ধ্রুপদ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধার। সে কারণে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যবহৃত যন্ত্রই ধ্রুপদ গানে ব্যবহৃত হয়। ধ্রুপদ গানের পারদর্শীতা অর্জনে সক্ষম ব্যক্তি অবশ্যই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শী। শুধু ধ্রুপদে ভিন্নধর্মী তাল যন্ত্র হিসেবে পাখোয়াজ ব্যবহৃত হয়। নজরুল সৃষ্ট ধ্রুপদ যদিও ধ্রুপদ হিসেবে বিবেচিত তবুও সেটা লঘু সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত। নজরুলের ধ্রুপদ পরিবেশনায় লঘু সঙ্গীতে ব্যবহৃত যন্ত্রই বেশ ব্যবহৃত হয়।

 

google news logo

 

উপসংহার –

ধ্রুপদ গান মূলত আধ্যাত্মিক চিন্তার বাহ্যিক প্রকাশ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, ধ্রুপদ গানই সর্বপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও প্রাচীন গীতরীতি। নজরুল ইসলাম মূলত সঙ্গীতের কোনো অধ্যায় বাপ রেখে যেতে চাননি আর সেজন্যই তার ধ্রুপদ গান রচনা। সঙ্গীতের সকল ক্ষেত্রেই তার বিচরণ ছিল। যদিও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধ্রুপদের মতো নজরুলসঙ্গীতের ধ্রুপদ শাস্ত্রীয়ভাবে সমাদৃত নয়। তবুও নজরুল ইসলাম ধ্রুপদ গান রচনার মাধ্যমে তার গানের বৈচিত্র্যতা ও বাংলা গানে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছিলেন যা সুধীজনের কাছে এবং শিল্পীর কাছে নান্দিক রূপ লাভ করেছে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment