শাক্ত পদাবলী ও নজরুলের গান

শাক্ত পদাবলী বাংলাগানের বিবর্তনবাদের ইতিহাসে একটি মূল্যবান অধ্যায়। শ্যামা বা কালীকে কেন্দ্র করে এ গানের গঠনপ্রণালী রচিত হলেও এতে সংযুক্ত আছে উমা সম্বন্ধে আগমনী বা বিজয়ের গান। প্রণালীবদ্ধ সঙ্গীতের ধারাবাহিকতা এখানে উপস্থাপন না হলেও লঘুসঙ্গীত হিসাবে শাক্ত পদাবলীর বিস্তৃতি অনেক। সাঙ্গীতিক অবকাঠামো এবং সনাতন ধর্ম অবলম্বনে রচিত এ গান বাংলার জনমানসে গীতধারার নবদিগন্ত উন্মোচন করেছেন। শাক্তগীতি বা শাক্ত পদাবলীর সাঙ্গীতিক বিন্যাস তৎকালীণ সময়ে বাংলাগানে সৃষ্ট শুন্যতা মোচনেও সহায়ক হয় ।

শাক্ত পদাবলী

শাক্ত পদাবলী

 

শক্তিদেবী শ্যামা ও উমাকে নিয়ে রচিত পদ বা গানকে শাক্তগীতি বা শাক্ত পদাবলী বলে।

 

শাক্ত পদাবলীর উৎপত্তি:

অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে এই গীতধারার সূত্রপাত ঘটে। মঙ্গল কাব্যের আক্ষানগীতির ধারা ক্ষয় হয়ে আসলে এই পদসঙ্গীতের ধারা উচ্ছ্বাসিত হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচাৰ্য “বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস” গ্রন্থে উল্লেখ করেন “মঙ্গল কাব্যের ভিতর দিয়ে আখ্যায়িকা কাব্য রচনার ধারাই খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীয় শেষভাগ পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া গিয়া পরিনামে তাহা খণ্ড গীতিকাব্যে রচনার মধ্যে একেবারে লুপ্ত হইয়া যায়।

বৈষ্ণব গীতিকাব্যগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাবই এর একমাত্র কারণ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলা সাহিত্যের সকল বিভাগেই বৈষ্ণব গীতিকবিতার প্রভাব অব্যাহত হইয়া ওঠে। এমনকি সমসাময়িককালে রচিত ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল যদিও আখ্যায়িকামূলক কাব্য, তথাপি এর আভ্যন্তরীণ গীতিসুর প্রণেতার কথা অস্বীকার করিতে পারা যায় না।

সেই বুঝেই শাক্ত আখ্যানমূলক কাব্যগুলি এই সঙ্গীতের প্রভাবের বশবর্তী হয়। তার ফলেই সেই যুগে ইহাদের বিষয়বস্তুর কোনো কোনো অংশ লইয়া যুগোচিৎ কতকগুলি খণ্ডগীতি কবিতা রচিত হয় তাহাই শাক্ত পদাবলী নামে পরিচিত।

 

শাক্ত পদাবলীর দুটি ধারা:

শাক্ত পদাবলীর দুটি ধারা- একটাতে চণ্ডী কন্যারূপীনি উমাতে ও অপরটিতে মাতৃরূপিনী কালিকাতে পরিণতি লাভ করেছেন। সাধক কবি রামপ্রসাদ এই উভয় ধারারই প্রতিষ্ঠাতা হলেও তাঁর পরবর্তীকালে এই দুটি ধারা স্বতন্ত্রভাবে প্রবাহিত হতে থাকে। একটির মধ্যে গার্হস্থের সুর প্রবল হয়ে ওঠে আরেকটির মধ্যে আধাত্মিক সুরই প্রবলতর হয়। এর প্রথম ধারাটি আগমনী বিজয়ার গান এবং দ্বিতীয় ধারাটি শ্যামাসঙ্গীত নামে পরিচিত।

 

শাক্ত পদাবলী পর্যায়:

বাংলায় তন্ত্রসাধনা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ভক্তসাধক কবির মনে কালিমূর্তি প্রাধাণ্য লাভ করলো। শাক্ত পদাবলীর নামের মধ্যেই শক্তিভাবের ইঙ্গিত রয়েছে। শাক্তগীতির বিশেষ পর্যায়ের মধ্যে রয়েছে- মাতৃসঙ্গীত, কালীসঙ্গীত, চণ্ডীগীতি, মালসী গান,বিজয়া ও আগমনী।

 

শাক্ত পদাবলী

 

রামপ্রসাদ সেনের শাক্তগীতি:

রামপ্রসাদের প্রধানতম কীর্তি তাঁর শ্যামাসঙ্গীত। উমাসঙ্গীতও তাঁর বৈশিষ্ট্যময় সৃষ্টি এ দুটি ধারারই তিনি প্রবর্তক। এ ছাড়া শিব ও কৃষ্ণ বিষয়ক কিছু পদও তিনি রচনা করেন। বৈষ্ণবপদতাগণ যেমন: রাধাকৃষ্ণকাহিনীর অন্তরালবর্তী মাধুর্য থেকে বস সঞ্চয় করে তাঁদের সঙ্গীতকে সুন্দর করে তুলতে পেরেছিলেন। রামপ্রসাদের আরাধ্যা দেবীকাহিনীর অন্তরালে তেমন কোনো রস সঞ্চয় ছিল না। না কালীয় রূপাংকনে, না পৌরাণিক বিবরণে, না তন্ত্রসিদ্ধ সাধনপদ্ধতিতে কালীর সঙ্গে কোমলতার কোনো সংশ্রব ছিল না। রামপ্রসাদের অবদানের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। উল্লেখ করেছেন, “মঙ্গল কাব্যে শক্তিপূজার যে বিকৃত ঔদ্ধতা, যে অশোভন আত্মপ্রচার প্রবণতা দেখা যায়, রামপ্রসাদে তার বিশুদ্ধ অকৃত্রিম ভাবরূপটি পরিস্ফুট।

 

রামপ্রসাদ সেনের গানের সুরের আঙ্গিক:

রামপ্রসাদ সেনের এক অসামান্য অবদান তাঁর রামপ্রসাদী সুর। রামপ্রসাদ সেনকে অনেকে সাধক রামপ্রসাদও বলে থাকেন। রাগ সুরের সঙ্গে বাউল মিশিয়ে তিনি যে এই সুর ঢংটি গঠন করেছিলেন তা তাঁর নামানুসারে প্রসাদী সুর নামে খ্যাত হয়।

রামপ্রসাদ সেনের সঙ্গীত শিক্ষা রামপ্রসাদ সেনের সঙ্গীত শিক্ষা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। কিন্তু ব্যাপক রাগের ব্যবহার থেকে মনে হয় তিনি ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে’ বেশ পারদর্শী ছিলেন। ভরত চন্দ্রের একটা বিশেষ সুবিধা ছিল যে, তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের অতি সমৃদ্ধ সঙ্গীত দরবারে অবস্থান করেছিলেন। ফলে রাগসঙ্গীতের একটা আবহে তিনি দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। কিন্তু তেমন কোনো সুযোগও রামপ্রসাদের ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বিশেষ অধিকার অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

 

রামপ্রসাদের শাক্তগীতিতে ব্যবহৃত রাগ:

সাধক রামপ্রসাদ সেন তাঁর রচিত শাক্তগীতিতে যে সকল রাগের ব্যবহার করেছেন তা হলো জংলা, ললিত, ললিত-বিভাস, বেহাগ, সোহিনী বাহার, পিলু, পিলু-বাহার, বিভাস, গাৱা, ভৈরবী, মালব, মালবশ্রী, বসন্ত, বসন্ত-বাহার, মালকোষ, মূলতান, সোহিনী-ললিত, গৌরীগান্ধার, সিন্ধু, টোড়ি, জৌনপুরী ইমন, জয়-জয়ন্তী, ললিত-খাম্বাজ, ঝিঁঝিট, সিন্ধু কাফি, রামকেলী, মল্লার, ছায়ানট, খট-ভৈরবী, গৌরী ইত্যাদি।

 

রামপ্রসাদ সেনের গানে তাল প্রসঙ্গ:

তাল হিসাবে রামপ্রসাদ সেনের গানে রয়েছে একতাল, টিমা, জলদ ত্রিতাল, য‍ ঝাঁপতাল, আড়া, আড়াগেমটা, খয়রা, আন্ধা, ঠুংরী, রূপক, তিট প্রভৃতি।

 

শাক্ত গীতিতে কমলাকান্ত:

রামপ্রসাদ সেনের পর তার সৃষ্ট মাতৃভাববিগলিত শাক্তগীতিতে আবির্ভূত হন কমলাকান্ত (১৭৭২-১৮২৯)। কমলাকান্ত নামে ভনিতা দেয়ায় এই নামেই তিনি বিখ্যাত হন। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার অম্বিকা কালনা গ্রামে কমলাকান্তের জন্ম। কমলাকান্ত ছিলেন প্রতিভাবান কবি।

রামপ্রসাদ সেনের মতো কমলাকান্তও শ্যামা সাধনায় ব্রতী হন। সঙ্গীতকার রূপে কমলাকান্ত বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। কমলাকান্ত বেশ কিছু টপ্পা অঙ্গের শ্যামা রচনা করেছিলেন। এ পর্যায়ের গান রচনার ক্ষেত্রটি মূলত টপ্পা রচিয়তা কালী মির্জার কাছে থেকে তৈরি করেছিলেন ।

কারণ হিসাবে বলা যায় কমলাকান্ত যখন বর্ধমান রাজসভার সাথে যুক্ত তখন কালী মির্জাও সেখানে সঙ্গীতজ্ঞ রূপে অধিষ্ঠিত। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, শাক্তগীতিতে রামপ্রসাদের পর কমলাকান্তের স্থান। কমলাকান্তের বেশ কিছু গান ও কাব্য বলিষ্ঠতার দাবী রাখে। যেমন

(১) তুমি আপন সুখে আপনি নাচ

আপনি দেও মা করতালি। ।।

(২) আমার সাদ না মিটিল আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা।

কমলাকান্তের আগমনী গান

আগমনী শ্রেণীর গান রচনায় কমলাকান্ত বিশেষখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর একটি নবমী সঙ্গীত বিশেষ জনপ্রিয়তা অজর্ন করেছিল। পরবর্তীতে এ গানটি সঙ্গীত মহলে বেশ সারা জাগায়। তৎকালীণ সময় হতে কবিয়ালদের বিভিন্ন আসরেও গানটি পরিবেশন করা হতো।

কমলাকান্তের আগমনী গান- কেমনে কাল রঙে রাঙালে মা রাগ-পরজ-কালাংড়া, তাল-জলদ ত্রিতাল।

কমলাকান্তের গানে ব্যবহৃত রাগ কমলাকান্ত তার গানে যে সকল রাগের সংযোগ ঘটিয়েছেন তা হলো পরজখাম্বাজ, সুরট মল্লার, মল্লার ঝিঁঝিট, সিন্ধু, কালাংড়া, ললিত, ললিত-ঝিঁঝিট, ললিত-যোগিয়া, খটকানাড়া, কানাড়া-রাগেশ্রী, সিন্ধু, মূলতান, সিন্ধু-কাফি, নট বেলাবল, গৌরী, পুরবী, টোড়ি, বেহাগ, যোগীয়া, সোহিনী ভৈঁরো, পরজ-কালাংড়া, কেদার, বিভাস,যোগিয়া, খট যোগীয়া প্রভৃতি।

 

কমলাকান্তের গানে তালের প্রয়োগ:

কমলাকান্তের গানে তাল হিসাবে সংযুক্ত রয়েছে, একতাল, ত্রিতাল, যত্, আড়াখেমটা ঝাঁপতাল, রূপক খয়রা, আহ্মা কাওয়ালী, ঠুংরী প্রভৃতি।

 

রঘুনাথ রায়ের শাক্তগীতি:

দেওয়ান মহাশয় নামে খ্যাত রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬) শাক্ত পদাবলী রচনার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদান রাখেন। কথিত আছে রঘুনাথ ব্রত হিসাবে প্রতিদিন প্রভাতে একটি করে শ্যামাসঙ্গীত রচনা করতেন। তিনি বর্ধমান জেলার চুপী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দেওয়ান বজ্রকিশোর রায়। তিনি বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্রের দেওয়ান ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর রঘুনাথও বর্ধমান রাজ্যের দেওয়ান নিযুক্ত হন। সে কারণেই রঘুনাথবাবু দেওয়ান মহাশয় নামে খ্যাত হন। রঘুনাথের পিতা সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন। সঙ্গীত রচনায়ও বজ্রকিশোরের যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। সঙ্গীত রচয়িতারূপে রঘুনাথের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো তিনি বাংলা খেয়ালের গীতরচিয়তা ও খেয়াল গায়করূপে পথিকৃতের মর্যাদা লাভ করেন। খেয়ালশৈলীতে সঙ্গীত সাধনার ক্ষেত্রে রঘুনাথই আদি বাঙালি ।

রঘুনাথ শ্যামাসঙ্গীতের পাশাপাশি কিছু কৃষ্ণবিষয়ক গানও রচনা করেছেন। রঘুনাথ প্রবর্তিত একটি চারতুকের খেয়াল গান নিম্নে প্রদত্ত হলো ।

রাগ-বেহাগ, তাল একতাল
একি রূপ অনুপমা মা মহেশ মনোমোহিনী
কলঙ্করহিত পরিণত শতবিধু নিন্দিত বদনী।।
যে রূপ কিরণে হয় হীরকাদি রত্নভূষণে ভূষণী
মঞ্জীর চরণে বাজে রুনুঝুনু মনিমুকুতা গাঁথুনি ।।
দশকরা বিধিশাস্ত্রধরা, সদলে দুনজ বিনাশ করা
পদভরে কাঁপে ধরা দেবদেবী দেয় জয়ধ্বনী।।
আদ্যাশক্তি তুমি ভগবতী কি জানি মাতব স্তুতি
অকৃতি কুমতি অকিঞ্চন প্রতিসপ্রসীদ বিশ্বজননী।।

শাক্ত পদাবলী রচনার ক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাম রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত, রঘুনাথ রায় ছাড়া যারা শাক্তগীতি রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন তারা হলেন কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২), কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র শিবচন্দ্র, শম্ভুচন্দ্র, তারচন্দ্র, রাজানন্দকুমার রায়, (১৮২০-১৮৫৮), বর্ধমানের রাজা মহাতার চাঁদ (১৮২০-১৮৭৯), কলকাতা পাথুরিয়া ঘাটার রাজা যতীন্দ্র মোহন ঠাকুর (১৮৩১- ১৯০৯)), দেওয়ান রামদুলাল (১৭৮৫-১৮৫১) প্রমুখ।

 

শাক্ত পদাবলী

 

রসিক রায় এবং শাক্তগীতি:

রসিক রায় (১৮২০-১৮৯৩) দাশরথির মতোই বিখ্যাত হয়েছিলেন পাঁচালী রচিয়তারূপে। তবে শ্যামাসঙ্গীত রচনায়ও তিনি যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। “শ্যামসঙ্গীত” নামে তাঁর একটি গীতিসংকলণও প্রকাশিত হয়েছিল। রসিক রায় রচিত শ্যামার সাঙ্গীতিক অবকাঠামো মোটামুটি রামপ্রসাদ সেনের শ্যামার কাছাকাছি বলা যেতে পারে।

 

কবিয়াল রামবসু:

বরহ সঙ্গীতের রাজারূপে খ্যাত কবিয়াল রামবসু (১৭৮৬-১৮২৮) শাক্তসঙ্গীত রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। বিশেষ আগমনী পর্যায়ের গান রচনার ক্ষেত্রে রামবসুর কৃতিত্ব বহুমুখী প্রতিভার দাবী রাখে। স্বামী গৃহ থেকে আগত কন্যার দুঃখ দুদর্শায় আকুল বাঙালি গৃহকর্ত্রী মাতার হৃদয়যন্ত্রনার অসাধারণ রূপ ফুটে উঠেছে তার গানে ।

যেমন: কও দেখি উমা।
কেমন ছিলে মা।।

কাজী নজরুল ইসলাম এবং শ্যামাসঙ্গীত বাংলা ভক্তি সঙ্গীতে ব্রাহ্ম প্রভাবকে খর্ব করে সনাতন ধর্ম বিষয়ক সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে যিনি বিপুল ভূমিকা পালন করেন তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর রচিত শ্যামার গঠনপ্রণালী, সুরের ধারাবাহিকতা, বাক্য সমন্বয় বাণী বিন্যাসই তাঁকে সার্থক শাক্তগীতি রচিয়তা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিয়েছে।

তৎকালীণ সময় হতে আজ পর্যন্ত যারা শ্যামাসঙ্গীত রচনায় ব্রতী হয়েছেন তাদের মধ্যে একমাত্র নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতেই শ্রেষ্ঠ অবস্থানটি লক্ষ করা যায়। সুর লালিত্যে, এবং রাগের সার্থক সমন্বয়ের মাধ্যমে নজরুল শ্যামাসঙ্গীতকে সার্থকরূপ দিয়েছেন বলে অনেক সঙ্গীতজ্ঞ একমত।

যেমন : কে তোরে কি বলেছে মা
ঘুরে বেড়াস কালি মেখে।।
রাগ: মিশ্র বেহাগ, তাল: দাদরা

 

দেশাত্মবোধক শাক্তগীতি:

বাংলা দেশাত্মবোধক গানের একটি সার্থক রূপায়ণ শাক্তগীতিতে লক্ষ করা যায়। সে কারণে দেশাত্মবোধক গানের এই ধারাটিকে শাক্তসঙ্গীতের দেশাত্মবোধের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। প্রধানত বঙ্কিম চন্দ্ৰ চট্টোপাধ্যায়ের বন্দে মাতরম গানটি থেকেই এই ধারার সূত্রপাত। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্গত এই গানে জন্মভূমিকে দূর্গা, তারিণী, কমলা প্রভৃতি শক্তিদেবীর সঙ্গে উপমিত করেছেন।

সেখানে জন্মভূমি জন্মদায়িনীর সঙ্গে তুলনীয় না হয়ে মাতৃদেবীর সঙ্গে তুলনীয় হয়েছে। তা ছাড়া কবি গুরুরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত “আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি” গানটিতে বাংলাদেশের একটি দেবীরূপ অংকিত হয়েছে। এছাড়া বিপিনচন্দ্র পাল (১৮৫৮-১৯৩২) রচিত দেশাত্ববোধক গানেও দেশমাতৃকার শক্তি দেবীর রূপাভাস লক্ষ করা যায়। যেমন

আর সহে না সহে না জননী, এ যাতনা আর সহে না
আর নিশিদিন হয়ে শক্তিহীন পড়ে থাকি, প্রাণ চাহে না
তুমি মা অভয়া জননী যাহার কি ভয় কি ভয় এভাবে তাহার

দানবদলনী, ত্রিদিব-পালিনী করাল কৃপানী তুমি মা।। দেশমাতৃকার নামে শক্তিদেবীর উল্লেখে গীত রচনার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন মুকুন্দদাস (১৮৭৮-১৯৩৪)। চারণ কবিরূপে খ্যাত এই স্বদেশব্রতী কবি জন্মভূমির মাতৃরূপকে শক্তিদেবীর রূপের সঙ্গে একাত্ম করে বেশ কিছু দেশাত্ববোধক গান রচনা করেছেন।

তিনি ইংরেজী বিরোধী সংগ্রামকে দেবতাদের অসুর বিরোধী সংগ্রামের সাথে তুলনা করেছেন। “চারণ কবি মুকুন্দদাস নামে অভিহিত মুকুন্দদাস রচনাবলীর সম্পাদক ডঃ জয় গুরু গোস্বামী “ভয় কি মরণে” গানটি সম্পর্কে বলেছেন “১৩১৩ বঙ্গাব্দে স্বদেশী আন্দোলনের মরা গাঙে বান ডাকিল” বৈষ্ণব মুকুন্দের হৃদয়তন্ত্রী মাতৃমন্ত্রে ঝংকৃত হয়ে উঠল-দেশকে জড় না ভাবিয়া বাংলার আরাধ্যা চৈতন্যময়ীকে কালী দূর্গা মূর্তিতে অঙ্কিত করিয়া তাঁহারই উদ্দেশ্যে জাতিকে মাতৃমন্ত্রে দীক্ষা লাভের জন্য আহবান জানাইলেন।

মুকুন্দ দাস দেশমাতৃকার মুক্তির প্রশ্নে শক্তিদেবী ভাবাত্মক দেশপ্রেমের গানে পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানাতে হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে একটি বিন্দুতে আসার জন্য আহবান। জানিয়েছিলেন।

যেমন :

ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে
মাতঙি মেতেছে আজ সমর রঙে।।

 

শাক্ত পদাবলীর বিষয়:

শাক্তগীতির মূল বিষয়বস্তু কালি বিষয়ক। এছাড়াও দূর্গা, পার্বতী, মেনকা প্রভৃতি বিষয় ভিত্তিক রচনা শাক্তগীতিতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রচয়িতাগণ শাক্তগীতির আঙ্গিককে বিভিন্নভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

 

শাক্তগীতির বাক্য সমন্বয়:

শাক্তগীতির বাক্য সমন্বয় লঘুপ্রকৃতির হলেও শব্দের গাঁথুনি, বাক্য নির্বাচন নান্দনিকতার দাবী রাখে। মমতাময়ী শ্যামার বিভিন্ন গুণাবলি ভক্তিরসাত্বক বাণীর মাধ্যমে লঘুসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্যকে সার্থক রূপ দিয়ে গঠন প্রণালী বর্ণিত হয়েছে এ গীতধারায়। সহজ শব্দ চয়নের ফলে খুব সহজেই মানবপ্রেমে এ পর্যায়ের গান ধরা দিয়েছে। বাক্য গঠনের সাথে রয়েছে মানব দর্শনের প্রতিফলন, ফলে শ্যামাসঙ্গীত বাক্যসমন্বয়ে দিক দিয়ে পরিপূর্ণতা পেয়েছে।

রামপ্রসাদ সেনের পালা রচনা রামপ্রসাদ সেন শ্যামাসঙ্গীত, আগমনী বিজয়ার গান ব্যতীত অনেকগুলো পালাও রচনা করেছেন।

সেগুলো হলো-বিদ্যাসুন্দর, কালিকামঙ্গল ও কালীকীর্তন।

 

শাক্তগীতিতে মানবদর্শন:

শাক্তগীতি রচনার ক্ষেত্রে যারা ব্রতী হয়েছিলেন তারা মূলত শক্তিদেবীর প্রতি বিভিন্নভাবে মানব দর্শনের ভক্তিভাবাপন্ন বাণীকে গীতরূপে উপস্থাপন করেছেন। তাতে মানব জীবনের আধ্যাত্মিকতার বিষয়টি গীতে প্রকাশ পেয়েছে। এটি মূলত কালী বিষয়ক ভক্তিমূলক গান হলেও এতে রয়েছে বৈচিত্র্যমুখী আরাধনা।

যে আরাধনার মাধ্যমে মানবকুল তথা দেশমাতৃকার মুক্তি ঘটবে। দর্শনতাত্ত্বিক আলোচনার ক্ষেত্রে গীত রচনার প্রেক্ষাপট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যা কেবল রচয়িতার উপর নির্ভর করে। বিভিন্ন আলোচনার ভিত্তিতে মানবদর্শন সম্পর্কে একটি বাক্য উপস্থাপন করা যায় তা হলো ” শাক্তগীতি মূলত শ্যামা বিষয়ক ভক্তিগীতি, যাতে রয়েছে সুর সংযোজিত উপাসনা যা মানব জগতের ভক্তিরসাত্বক অনুভূতি।।

উপরিভাগে যে আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে তাতে এটা প্রতীয়মান হয় যে, “শাক্তগীতি” বাংলাগানের বিবর্তনের একটি ধারা। বিভিন্ন রচয়িতা এ পর্যায়ের গান রচনা করলেও শাক্ত পদাবলীর ধারা কবিয়াল, পাঁচালীকার, রবীন্দ্রনাথ, গিরিশচন্দ্র, ক্ষীরদাপ্রসাদ প্রভৃতি আধুনিক কবি ও নাট্যকারের কল্পনাকে প্রবাহিত করে শেষপর্যন্ত অতি আধুনিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় এসে পরিণতি লাভ করেছে। এখানেই শাক্তগীতি সার্থক ও গীতিময়।

Leave a Comment