বাংলা লোকসঙ্গীতে পঞ্চ গীতিকবির রচিত লোকসঙ্গীতের প্রভাব : লোকসঙ্গীতের আদি ও প্রাচীনতম এক প্রকার গীতরীতি হচ্ছে বাংলা লোকসঙ্গীত। প্রচীনতম সঙ্গীতকে কালের বিবর্তনে অনেকেই রূপান্তরিত করেছেন বিভিন্নভাবে। যাদের মধ্যে দিজেন্দ্রলাল রায়, রজনী কান্ত সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুল প্রসাদ সেন, কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম।
বাংলা লোকসঙ্গীতে পঞ্চ গীতিকবির রচিত লোকসঙ্গীতের প্রভাব । নজরুলের ভাবনা
এই পঞ্চ গীতিকবির গীত রচনার প্রেক্ষাপট, সুর বিহারে আরোহন, সাঙ্গীতিক উপকরণ, পর্যায়ক্রমিক গীত রচনা, পরিবেশনা, সাঙ্গীতিক মূল্যায়ন বিশ্লেষণ করলে বাংলা লোকসঙ্গীতে তাদের অবদান প্রমাণিকভাবে উপস্থাপন করতে পারব তেমনটি আশা করি ।
মন্তব্য : পঞ্চ-রত্ন সঙ্গীতের ভাষা বিন্যাস ও সুর সংযোজনের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী ভূমিকা পালন করেছে যা প্রাদেশিক সঙ্গীত হিসাবেও খ্যাতি লাভ করেছে।
-রাখাল বন্দ্যেপাধ্যায়-এর মতে,
গ্রন্থ : বাংলা লোকসঙ্গীত ও বাংলাকীর্তন
বাংলা লোকসঙ্গীতে দিজেন্দ্রলাল রায় :
দিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের পর্যায় বিভিন্ন হলেও লোকসঙ্গীতে একটি স্থান দখল করে আছে। কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার সবাই কোনো-না কোনোভাবে তাঁদের সৃষ্টিতে লোকসঙ্গীতকে সংযুক্ত করেছে। ডি, এল, রায়ের সঙ্গীত নানা ভূমিকা পালন করলেও লোকসঙ্গীতের আবেশ তাকে সাঙ্গীতিক পরিপূর্ণতা দিয়েছে।
অতুল প্রসাদ সেন ও বাংলা লোকসঙ্গীত :
অতুল প্রসাদ সেনের গানে প্রকৃতিগত বর্ণনা, মানব দর্শনের গতি-প্রকৃতি, জাগতিক উপাখ্যান, আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতি বিশেষ স্থান পেয়েছে। প্রাচীনতম সঙ্গীত হিসাবে লোকসঙ্গীতের প্রানবন্ত বিষয়টিকে তিনি সুন্দরভাবে উপস্থান করেছেন তার গানে ।
রজনীকান্ত সেন ও বাংলা লোকসঙ্গীত :
গান রচনার আঙ্গিক বিভিন্নতা অবলম্বন করলেও সকল রচনাই চর্যাপদ অনুসারী। সঙ্গীতের আদি নিদর্শন যেহেতু চর্যাপদ সেহেতু রজনীকান্ত সেনের গানের মধ্যে লোকসঙ্গীত পর্যায়ের গান ব্যতিক্রম কিছু নয়।
বাংলা লোকসঙ্গীত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা সর্বক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতকে সার্থক রূপ দিয়েছে।
বাংলা গানের ক্রমবিবর্তনের ধারার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান বাংলা গানের ভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত। তাঁর ছয়টি পর্যায়ের গানের আঙ্গিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় লোকসঙ্গীত বিচিত্র পর্যায়ের গানের অধিভুক্তিতে রচিত। সুরের বিভক্তিকরণ থাকলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লোকসঙ্গীত পর্যায়ের গানে প্রাচীন লোকসঙ্গীতের উপকরণ সংযুক্ত । যেমন—
*এবার তোর মরা গাঙে”
“গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটি”
ইত্যাদি।
বাংলা লোকসঙ্গীতের বিবর্তনে কাজী নজরুল ইসলাম :
বাংলা গানের বিবর্তনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম একজন আধুনিক কবি। সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য তিনি রচনা করেছেন তাৎপর্যপূর্ণ সঙ্গীত। বাংলা গানের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি বিচরণ করেননি। তাঁর গানের বৈচিত্র্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষকে সঙ্গীত-মুখর করেছে। তাঁর গানের উদ্দীপক শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে প্রতিটি সঙ্গীত পিপাসু মানুষের কাছে। পর্যায় ভিত্তিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তাঁর সঙ্গীত ভাণ্ডারে লোকসঙ্গীতানুগ নজরুলসঙ্গীত একটি ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য বহন করে আছে। যেমন-
“আমার গহীন জলের নদী”
“গাঙে জোয়ার এল কিরে”।
ইত্যাদি।
প্রচলিত লোকসঙ্গীতের সাথে পঞ্চ গীতিকবি :
পঞ্চ গীতিকবির লোকসঙ্গীতের ধারাবাহিকতা ও বর্তমান প্রচলিত লোক সঙ্গীতের মধ্যে অনেক ভিন্নতা দেখা যায়। বিশেষ করে বাণী ও সুরের ক্ষেত্রে এই বাক্যটি প্রনিধান যোগ্য। প্রাচীন লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে পঞ্চ-গীতি কবির লোকগীতি পর্যায়ের গান রচনা। যার বাণী ও সুর বর্তমান প্রচলিত লোকসঙ্গীতের মতো লঘু প্রকৃতির নয়। বর্তমান প্রচলিত ধারায় লোকসঙ্গীতের মধ্যে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুরশিদি, মারফতী, গম্ভীরা, লালনগীতি, বাউল, হাছন রাজার গান বেশ জনপ্রিয়।
উপসংহার :
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা একটি বিষয় একমত হতে পারি যে, পঞ্চ- গীতি কবির লোকসঙ্গীতানুগ গান বাংলা লোকসঙ্গীতকে অলংকৃত করেছে।
আরও দেখুনঃ