যেভাবে গানের জগতে এলেন নজরুল

কাজী নজরুল ইসলামের সংগীতে হাতে-খড়ি হয় মাত্র দশ-বারো বছর বয়সে, এক লেটো দলে যোগ দিয়ে। লেটো ছিল এক ধরনের গ্রামীণ বিনোদনদল—নাচ, গান, অভিনয় মিলিয়ে গঠিত। এই দলগুলি বর্ধমান অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে সাধারণ মানুষকে আনন্দ দিত এবং একই সঙ্গে কিছু উপার্জনও করত। কিশোর নজরুল এই দলে যোগ দিয়েছিলেন দোহার হিসেবে। অচিরেই তিনি তাঁর অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দেন—গান গেয়ে, গান রচনা করে এবং ছড়া কাটায়। এই দলের সঙ্গে থাকতে থাকতেই তিনি প্রাথমিকভাবে সুর ও তালের ধারণা পেয়ে যান। তবে সেই সময়ে ‘সারেগামা’ শেখার মতো পদ্ধতিগত সংগীতশিক্ষা তাঁর হয়নি।

পদ্ধতিগত শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ আসে কয়েক বছর পরে, স্কুলজীবনে। তাঁর স্কুলের এক শিক্ষক গান জানতেন এবং কিশোর নজরুলকে সারেগামা ও কিছু গান শেখান। ধারণা করা হয়, এ সময়েই নজরুল স্বরলিপি দেখে গান তুলতে শেখেন। তখন স্বরলিপির প্রাপ্যতা খুব বেশি ছিল না, তবে রবীন্দ্রসংগীতের বেশ কয়েকটি স্বরলিপি পাওয়া যেত।

১৯১৭ সালের শেষ দিকে, স্কুলে পড়াকালীন, তিনি লেখাপড়া ছেড়ে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন এবং করাচিতে চলে যান। প্রথমে মনে হয়েছিল সেখানে সংগীতচর্চার সুযোগ থাকবে না, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ছিল। সৈন্যদের ব্যারাকে প্রায় প্রতি রাতেই গান-বাজনার আসর বসত, যেখানে গানের অনুরাগীরা নিজেদের প্রতিভা প্রকাশ করতেন। নজরুলও সেই আসরে গান গাইতেন, অন্যদের কাছ থেকে গান ও বাদ্যযন্ত্র শেখার সুযোগ নিতেন। কলকাতা থেকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপি থেকে তিনি গান তুলে সৈন্যসঙ্গীদের শোনাতেন। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে সেনাবাহিনী ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসার সময়ও তাঁর বাক্সে সেই স্বরলিপিগুলি অক্ষত ছিল।

 

নজরুলের গান রাজনীতির সমান্তরাল যাত্রা (১৯২৫–১৯৩০)

জেল থেকে মুক্তির পর ১৯২৫ সালজুড়ে কাজী নজরুল ইসলামকে লড়তে হয়েছে জীবিকার জন্য, একইসঙ্গে সংসারের দায়িত্বও নিতে হয়েছে। স্ত্রী প্রমীলা (দুলি) তখন গর্ভবতী; এপ্রিল মাসে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়, কিন্তু দারিদ্র্য থেকে মুক্তি মেলেনি। সংসারের চাপে তিনি কবিতা বা গান রচনায় মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। আগস্টে প্রথম সন্তানের জন্ম হয়; কিন্তু পরপরই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বন্ধুর নির্বাচনী প্রচারণা এবং নিজের অসুস্থতা তাঁকে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। ম্যালেরিয়া ও রক্ত আমাশয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন তিনি।

নভেম্বর মাসে কয়েকজন বামপন্থী সহযোদ্ধার সঙ্গে মিলে তিনি গঠন করেন লেবার স্বরাজ পার্টি”, যার মুখপত্র হিসেবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি প্রকাশিত হয় পত্রিকা লাঙল’। পত্রিকার জন্য নজরুল লেখেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা সংকলন সাম্যবাদী”। এ সময় গান রচনার সুযোগ খুবই সীমিত ছিল, কারণ তাঁর মনোযোগ রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠনের কাজে কেন্দ্রীভূত ছিল।

 

কৃষ্ণনগরে নতুন সূচনা

১৯২৬ সালের শুরুতে নজরুল পরিবার নিয়ে চলে যান কৃষ্ণনগরে, যেখানে বামপন্থী এমএলএ হেমন্তকুমার সরকারের আমন্ত্রণে তাঁরাই একটি পুরনো বাড়িতে বিনে ভাড়ায় বসবাস শুরু করেন। এখানে তিনি তুলনামূলক শান্ত পরিবেশ পান, যা তাঁকে আবার গানের দিকে ফিরিয়ে আনে।

তবে এগুলো ছিল মূলত রাজনৈতিক প্রয়োজনে লেখা গান। ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলন’-এর জন্য তিনি রচনা করেন কৃষাণের গান” (ওঠ রে চাষী জগদ্বাসী)। নজরুল নিজেই গানটি পরিবেশন করেন এবং সংবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়, শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলেন।

মার্চ মাসে তিনি লেখেন ধীবরদের গান” (আমরা নীচে পড়ে রইব না আর শোনরে ও ভাই জেলে), যা পরিবেশিত হয় নিখিল বঙ্গীয় আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মেলন’-এ। মে মাসের শেষে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য রচনা করেন দুটি দেশাত্মবোধক গান, যার মধ্যে অন্যতম দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার”। যদিও পরে বিশ্বাস করা হয়েছিল তিনি দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে এটি গেয়েছিলেন, কিন্তু সমসাময়িক সংবাদপত্রে বা মুজফফর আহমদের স্মৃতিতে রায়ের নামের উল্লেখ নেই।

 

রাজনীতি বনাম গান

১৯২৬ সালে তাঁর সৃজনশীলতা নতুন মাত্রা পেলেও, গানগুলো মূলত রাজনৈতিক প্রেরণায় লেখা ছিল। প্রেম, প্রকৃতি বা অন্তর্মুখী অনুভূতি নয়—এই গানগুলোর কেন্দ্রবিন্দু ছিল দেশপ্রেম রাজনীতি। বছরজুড়ে তিনি হেমন্তকুমার সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সম্মেলনে যোগ দেন—প্রথমে ঢাকা, পরে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে হবিবুল্লাহ বাহারের বাসায় থাকার সময় তিনি আবার কবিতা ও গান রচনায় অনুপ্রাণিত হন।

তবে এই অনুপ্রেরণা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অক্টোবর মাসে তিনি স্বরাজবাদী কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ান—ঢাকা বিভাগ থেকে কেন্দ্রীয় আইন সভার মুসলিম আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মাত্র ২৫০–৩০০ টাকার সামান্য সম্বল (যা দিয়েছিলেন ডা. বিধানচন্দ্র রায়) নিয়ে নির্বাচনে নেমে তিনি খুব কম ভোট পান; জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়।

 

বাংলা গজলের সূত্রপাত

নির্বাচনের পর ২৪ নভেম্বর কৃষ্ণনগরে ফিরে নজরুল আবার ম্যালেরিয়া ও রক্ত আমাশয়ে আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি একটানা লিখে ফেলেন তাঁর প্রথম গজল—
বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিস নে আজি দোল”
এটি শুধু নজরুলের নয়, বাংলা সাহিত্যেরও প্রথম প্রকৃত গজল। যদিও অতুলপ্রসাদ সেন পূর্বে কিছু গজলধর্মী গান লিখেছিলেন, কিন্তু সেগুলোর সুর ও কাঠামো গজলের নিয়ম মেনে হয়নি। অপরদিকে, নজরুলের গজল ছিল সঠিক উর্দু গজলের ছন্দ, ভাব ও সুরে রচিত, এবং তিনি এটি এক উর্দু গজলের সুরে বেঁধেছিলেন।

চোদ্দো দিন পরে তিনি রচনা করেন দ্বিতীয় গজল। এই সাফল্যে যেন তিনি গজলের নেশায় মগ্ন হয়ে পড়েন—বসা মাত্র গজল লিখতে পারতেন। তাছাড়া, গজল থেকে কবিতার চেয়ে বেশি আয় হতো—প্রতিটি গজলের জন্য পেতেন দশ টাকা!

 

গীতিকার সুরকার নজরুলের উত্থান

১৯২৭ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে নজরুল ধীরে ধীরে পেশাদার গীতিকার ও সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেন। কবি নজরুলের অবস্থান তখনও শক্তিশালী ছিল, কিন্তু তাঁর গান রচনার প্রতিভা দ্রুত তাঁকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। ১৯৩০ সালের পরে বলা যায়—কবি নজরুলের আড়াল থেকে গীতিকার সুরকার নজরুলই সামনে এসে দাঁড়ান

 

গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি

১৯৩০ সালের পরে কবি নজরুল ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন সঙ্গীত রচনা ও সুরকার জীবনে। সাহিত্যিক খ্যাতি তাঁর আগেই ছিল, কিন্তু এই সময়ে তিনি হয়ে উঠলেন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকার ও সুরকার।
কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়া (হিজ মাস্টার্স ভয়েস) নজরুলকে চুক্তিবদ্ধ করে। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার ও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। নজরুলের লেখা ও সুর করা গান রেকর্ড করতেন সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা—কমলা ঝরিয়া, অঞ্জলি রায়, ধীরেন দাস, কে. মল্লিক, আকাশিনী দেবী, এবং পরে নবীন প্রজন্মের শিল্পী যেমন ফিরোজা বেগম, শচীন দেববর্মণ প্রমুখ।

নজরুলের গান রেকর্ড হওয়ার পর বাজারে যে জনপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়, তা বাংলা গানকে নতুন যুগে প্রবেশ করায়। বিশেষ করে তাঁর বাংলা গজল, ইসলামী গান, শ্যামাসংগীত, দেশাত্মবোধক গান এবং প্রেমের গান শ্রোতাদের মনে এক অনন্য আসন গড়ে তোলে।

 

চলচ্চিত্রে নজরুল

১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে নজরুল চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন।

  • তিনি গান রচনা ও সুর দেন ধ্রুপদী, ঐতিহাসিক সামাজিক চলচ্চিত্রে
  • উল্লেখযোগ্য ছবি – ধূপছায়া, বিদ্যাপতি, রূপবান, পদ্মার ছায়া ইত্যাদি।
  • চলচ্চিত্রে তাঁর সুরে যেমন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ছোঁয়া ছিল, তেমনই সহজবোধ্যতার কারণে তা সাধারণ মানুষও গ্রহণ করেছে।

চলচ্চিত্রে কাজের সময় তিনি অনেক তরুণ শিল্পীকে প্রশিক্ষণ দেন, যাদের অনেকেই পরে বাংলা সঙ্গীতের স্তম্ভ হয়ে ওঠেন।

 

শিল্পী তৈরির কারিগর

নজরুল শুধু গান লিখে দেননি—তিনি শিল্পীদের উচ্চারণ, সুরের শুদ্ধতা ও আবেগের প্রকাশের জন্য ব্যক্তিগতভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ফিরোজা বেগম, সুচিত্রা মিত্র, ধীরেন দাস, ইমরত হুসেন প্রমুখ তাঁর সরাসরি শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে গান শেখা মানেই ছিল শুদ্ধতা, শৈলী ও আবেগের সমন্বয়।