যুগ অবতার নজরুলের পরিচয় । নজরুলের ভাবনা

যুগ অবতার নজরুলের পরিচয় : প্রথম মহাযুদ্ধের আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানের কল্যাণকর মূর্তিটাই মানুষের কাছে বেশি করে প্রতিভাত হতো। কিন্তু মহাযুদ্ধে বিজ্ঞানের মারণকৌশল দেখে মানুষ ভার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে উঠল। শৌর্যবীর্যের লীলাক্ষেত্র ও ততকর পরিবর্তনের কারক বলে যে যুদ্ধকে প্রথমে কীর্তিত করা হয়েছিল তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখে মানবসমাজ তখন আতঙ্কগ্রস্থ।

 

যুগ অবতার নজরুলের পরিচয়

 

যুগ অবতার নজরুলের পরিচয় । নজরুলের ভাবনা

 

প্রথম মহাযুদ্ধের পর আকাঙ্ক্ষিত নবজীবনের কোনো ইঙ্গিতই দেখা গেল না। কোটি কোটি প্রাণের মূল্য যা কেনা হলো তার অকিঞ্চিৎকরতা ও অসারতায় মানুষ প্রমাদ গুনলো। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করল মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, মহামারী, নৈতিক বিপর্যয়, বিশৃঙ্খলা প্রভৃতি নানা অভিশাপ।

মহাযুদ্ধে যে পক্ষ পরাজিত হলো তার দূরবস্থা তো বর্ণনার বাইরে। কিন্তু যে দল জয়লাভ করল তার ভাগ্যেও উল্লেখযোগ্য কিছু মিলল না। দেশে দেশে শ্রমিক-বিক্ষোভের অগ্নি ধূমায়িত হতে লাগল। রুশ বিপ্লবের সাফল্য শ্রমিক আন্দোলনে নূতন শক্তি সঞ্চারিত হলো। বিভিন্ন দেশে শ্রমিক ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। শ্রমশক্তির আত্মচেতনা-মুখরিত জয়ধ্বনি শোনা গেল। ইংল্যণ্ডের মতো দেশেও সাধারণ ধর্মঘটের ঘণ্টা বাজল।

 

যুগ অবতার নজরুলের পরিচয়

 

গণ-আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ রোধ করার জন্যে এবং ধনিক সভ্যতার স্বার্থ- সংরক্ষণের উদ্দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের নিশান হাতে জার্মানী, ইতালী প্রভৃতি দেশে ডিক্টেটরদের আবির্ভাব ঘটতে লাগল। তাদের ঘৃণা, কঠোর ও নির্মম শাসনদণ্ডের তাড়নায় গণতন্ত্রের লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের সীমা রইল না। যুদ্ধের ফলে এমন কিছু পাওয়া গেল না যা কিনা মানবসমাজ দৃঢ়প্রত্যয় আঁকড়ে ধরতে পারে। শ্রেণীর গণ্ডী ভেঙে পড়তে লাগল, পরিবারের ভিত্তি টলে উঠল, সমাজের কাঠামো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। জীবিকার প্রশ্নই জীবনের চেয়ে বড় হয়ে পড়ল।

জীবনের বাইরেই শুধু ফাটল ধরল না, তার ভিতরেও ভাঙনের স্রোত প্রবেশ করল । দুঃখ-দুর্দশায় মানুষের নীতিবোধ ক্রমেই অসাড় হয়ে পড়তে লাগল। নানা মানসিক ব্যাধি শারীরিক রোগের মতো বেড়েই চলল। এইসব মানসিক ব্যাধির উৎস খুঁজতে গিয়ে ফ্রয়েড় চেতনলোকের নীচে এক অচেতন লোকের অস্তিত্ব আবিষ্কার করলেন। ফ্রয়েড় প্রভৃতি মনস্তত্ত্ববিদদের গবেষণায় মনোবিজ্ঞানের জগতে এক যুগান্তর দেখা দিল।

সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রেও মনস্তত্ত্ববিদদের আবিষ্কৃত বিভিন্ন তথ্য ব্যবহৃত হতে লাগল। সামাজিক ও শাস্ত্রীয় অনুশাসন এবং নৈতিক পীড়নে যে-সব বিষয় নিষিদ্ধ বলে অস্পৃশ্য ছিল, সাহিত্য ও শিল্পের দুঃসাহসী কর্মীরা তাদের জাতে তুলতে আরম্ভ করলেন।

 

যুগ অবতার নজরুলের পরিচয়

 

প্রথম মহাযুদ্ধের পরে বোঝা গেল যে, পৃথিবীতে প্রাণের মূল্য কমে গিয়েছে এবং সেই সঙ্গে জীবনের চেয়ে মৃত্যুর আয়োজনই বড় হয়ে উঠেছে। এই সময় মানবিকতা লাঞ্ছিত হতে লাগল। মানবিকতা নয়, অমানবিকতাই তখন ধর্ম- তারই আওতায় সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প প্রভৃতি তাদের ঐতিহ্য-বিচ্যুত চোরাবালির মধ্যে অসহায় ঘুরপাক খেতে লাগল। সংশয়, অবিশ্বাস ও স্বার্থপরতার বাহুগ্রাস করল যুগমানসকে।

যুগ অবতার নজরুলের পরিচয়

চিরন্ততার চেয়ে বড় হয়ে উঠল সাময়িকতা, উন্নাসিকতা ও নৈরাশ্যের অতলে ডুবে গেল সত্যকার জীবন-জিজ্ঞাসা। একদিকে দেখা গেল নৈরাশ্যের মহাশূন্যতা-জীবন অন্তঃসারশূন্য হয়ে গেল। ফাঁপা, ফাঁপা মানুষে ভরে উঠল পৃথিবী। অন্যদিকে এক নূতন মূল্যমান মিলে গেল জীবনের। সে-মূল্যমান বিশ্বভ্রাতৃত্বের মহাসম্ভাবনায় সমুজ্জ্বল। প্রথম বিশ্বক্ষুদ্ধ সঙ্কটে-আকীর্ণ, পৃথিবী সৃষ্টি করলেও সঙ্কট-হরণের বীজ উপ্ত করে দিয়ে গেল।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

পূর্বেই বলা হয়েছে, ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষ পাশ্চাত্যের নববন্যার প্লাবনে ভেসে গিয়েছিল, আবার তার সমস্যাও সঙ্কটের সে ভাগীদার হলো। পৃথিবীব্যাপী সমস্যা ও সঙ্কট স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে আত্মপ্রকাশ করল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই এদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন সংঘটিত হতে লাগল। তখনই আবির্ভাব ঘটল কাজী নজরুলের।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment