মানুষ কবিতাটি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করা একটি অসাধারণ কবিতা। এই কবিতায় নজরুল মানব সেবাকে মানুষের আসল মর্যাদা ও মনুষ্যত্বের মূল পরিচয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কবিতাটির মূল ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হলো সাম্যবাদ ও মানবতার মহিমা, যেখানে জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বার্তা ফুটে উঠেছে। সমাজের অবক্ষয়কারী মোল্লা, পুরোহিত ও ধর্মীয় অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কবি সাহসী বিরোধিতা করেছেন এবং মানুষের মুক্তি ও সাম্যের পক্ষে কণ্ঠ তুলে ধরেছেন।
মানুষ কবিতা | সাম্যবাদী | কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্ ।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-
‘পূজারী দুয়ার খোলো,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হ’ল!’
স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়,
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ’য়ে যাবে নিশ্চয়!
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান’, ‘দ্বার খোল বাবা, খাইনি ক’ সাত দিন!’
সহসা বন্ধ হ’ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে!
ভুখারী ফুকারি’ কয়,
‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’
মসজিদে কাল শির্নী আছিল,-অঢেল গোস–র”টি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি,
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন্
বলে, ‘ বাবা, আমি ভূখা-ফাকা আমি আজ নিয়ে সাত দিন!’
তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা-‘ভ্যালা হ’ল দেখি লেঠা,
ভূখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?’
ভূখারী কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল-‘তা হলে শালা
সোজা পথ দেখ!’ গোস–র”টি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা ব’লে বন্ধ করনি প্রভু।
তব মস্জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী।
মোল্লা-পুর”ত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’
কোথা চেঙ্গিস্, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন’ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন’-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন’ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন’;-গ্রন’ আনেনি মানুষ কোনো।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মাদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে!
আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ,
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ।
হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম,
আমিই কি জানি-কে জানে কে আছে
আমাতে মহামহিম।
হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা,
কে জানে কাহার অন- ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?
কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?
হয়ত উহারই বুকে ভগবান্ জাগিছেন দিবা-রাতি!
অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান্ উ”চ নহে,
আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে,
তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন’ ভজনালয়
ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়!
হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর-বাসে
জন্মিছে কেহ- জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে!
যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে
আজিও বিশ্ব দেখনি,-হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে!
ও কে? চন্ডাল? চম্কাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব!
ওই হ’তে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।
আজ চন্ডাল, কাল হ’তে পারে মহাযোগী-সম্রাট,
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী-পাঠ।
রাখাল বলিয়া কারে করো হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে!
হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে!
চাষা ব’লে কর ঘৃণা!
দে’খো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না!
যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল,
তারাই আনিল অমর বাণী-যা আছে র’বে চিরকাল।
দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী,
তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি!
তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে,
দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে।
সে মার রহিল জমা-
কে জানে তোমায় লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা!
বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ-ঠুলি,
নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হ’য়েছে কুলি।
মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা-মথিত সুধা,
তাই লুটে তুমি খাবে পশু? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা?
তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে
তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোন্খানে!
তোমারি কামনা-রাণী
যুগে যুগে পশু, ফেলেছে তোমায় মৃত্যু-বিবরে টানি’।
মানুষ কবিতা আবৃত্তি:
মানুষ কবিতা নির্বাচিত শব্দের অর্থ ও টীকা :
সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: কবিতাটি সাম্যবাদের চেতনায় লেখা, যেখানে সব মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার দাবি তুলে ধরা হয়েছে।
মানব সেবা ও মনুষ্যত্ব: কাজী নজরুল মানব সেবাকে মানুষের প্রকৃত পরিচয় ও শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
ধর্ম ও সমাজ সমালোচনা: কবি সমাজে ধর্মের নামে সৃষ্টি অন্ধ বিশ্বাস ও বিভাজনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালোচনা করেছেন।
জাতীয় ও মানবিক মূল্যবোধ: ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মর্যাদা এবং তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলার পক্ষে কবির আহ্বান।
বিদ্রোহী স্পন্দন: কবিতায় কাজী নজরুলের বিদ্রোহী ভাব ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী কণ্ঠের প্রকাশ স্পষ্ট।
- অভেদ – অভিন্ন; নির্বিশেষে। আজারি – রুগ্ণ; ব্যথিত। কপাট – দরজার পাল্লা। কালাপাহাড় – প্রকৃত নাম রাজচন্দ্র বা রাজকৃষ্ণ; রাজনারায়ণ; কারো কারো মতে তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন। পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি অনেক দেবালয় ধ্বংস করেছেন। যারা পবিত্র উপাসনালয়ের দরোজা বন্ধ করে তাদের ধ্বংসের জন্য কবিতায় কালাপাহাড়কে আহ্বান জানানো হয়েছে। ক্ষুধার ঠাকুর – ক্ষুধার্ত মানুষকে দেবতাজ্ঞান করা হয়েছে। যেমন ‘অতিথি নারায়ণ’। ক্ষুধার মানিক জ্বলে – ক্ষুধার্ত ব্যক্তির জঠরজ্বালা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
- গজনি মামুদ – গজনির সুলতান মাহমুদ। তিনি সতের বার ভারতবর্ষ আ মণ করে ধ্বংসলীলা চালান। এখানে তাঁকে উপাসনালয়ের ভণ্ড দুয়া ক্র রিদের ধ্বংস করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। গো—ভাগাড় – মৃত গরু ফেলার নির্দিষ্ট স্থান। চেঙ্গিস – চেঙ্গিস খান; মঙ্গোলীয় দুর্ধর্ষ নেতা। জ্ঞাতি – সগোত্র; স্বজন; একই বংশে জাত ব্যক্তি। ঠাকুর – দেবতা। তিমির রাত্রি – অন্ধকার রাত। তেরিয়া – উদ্ধতভাবে; উগ্রভাবে। দ্বার – দরজা; দুয়ার।
- পান্থ – পথিক। পুরুত – পুরোহিত; পূজার্চনা পরিচালনার মুখ্য ব্যক্তি। পূজারী – পূজাকারী; উপাসক; পুরোহিত। ফুকারি – চিৎকার করে। বর – আশীর্বাদ; কারো কাছ থেকে কাক্সিক্ষত বস্তু বা বিষয়। ভজনালয় – উপাসনার গৃহ বা ঘর। ভণ্ড – কপট; ভানকারী। ভুখারি – ক্ষুধার্ত ব্যক্তি। মহীয়ান – অতি মহান। মুসাফির – সফরকারী; পথিক; আগন্তুক। শিরনি – মুসলমান বা হিন্দু কর্তৃক সত্যপীর বা অন্য পীরের উদ্দেশ্যে নিবেদনের জন্য আটা, ময়দা, চিনি, কলা, পায়েস ইত্যাদির তৈরি ভোগ বিশেষ; ফিরনি। শীর্ণ—গাত্র – রোগা শরীর পাতলা দেহ। সাম্য – সমতা।
![মানুষ কবিতা [ কবিতা, সারসংক্ষেপ ও টিকা ] সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ | কাজী নজরুল ইসলাম 2 google news logo](/wp-content/uploads/2023/02/google-news-logo.jpg)
মানুষ কবিতার সারসংক্ষেপ :
‘মানুষ’ কবিতায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানব সেবাকে মানবতার শ্রেষ্ঠ পরিচয় বলেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ হবার আসল মাপকাঠি হলো অন্য মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত থাকা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি বৈষম্য মানুষকে বিভাজিত করে, কিন্তু প্রকৃত মানুষ হলো যিনি সবাইকে সমান চোখে দেখে। কবি ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের তুলনায় মানুষের গুণ, নৈতিকতা ও কর্মকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি সমাজে অন্ধ ধর্মাচরণের প্রতি তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং সাম্যের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। কবিতার মাধ্যমে কাজী নজরুল সমাজের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে মানুষের অন্তরে বিদ্রোহ জাগাতে চান এবং সকলের মধ্যে সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
পাঠোত্তর মূল্যায়ন : বহুনির্বাচনি প্রশ্ন:
১. ‘মানুষ’ কবিতায় মুসাফির কতদিন অভুক্ত ছিল?
ক. একদিন
খ. তিনদিন
গ. পাঁচদিন
ঘ. সাতদিন
২. ‘ভ্যালা হলো দেখি লেঠা’ পঙ্ক্তিটিতে প্রকাশ পেয়েছে:
ক. সংশয়
খ. উৎসাহ
গ. বিরক্তি
ঘ. আনন্দ
নিচের উদ্দীপকটি পড়ুন এবং ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দিন :
‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা কে দেয় থুথু ওই গায়ে,
হয়তো তোমায় স্তন দিয়েছে সীতাসম সতী মায়ে।’
৩. উদ্দীপক ও ‘মানুষ’ কবিতায় যেখানে সাদৃশ্য রয়েছে:
ক. মানুষকে ঘৃণা না করা
খ. ধর্মই সবার উপরে
গ. সমাজের উন্নয়ন
ঘ. পুরোহিতের ঈশ্বর ভক্তি
৪. উদ্দীপক ও ‘মানুষ’ কবিতায় সাদৃশ্য দেখা যায় যে বিষয়ে:
I. মানবিকতা II. সহযোগিতা III. সহমর্মিতা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক.I
খ.II
গ. III
ঘ. II
ঙ. III