নজরুলের বিদেশী সুরের গান : গানের জগতে নজরুল এসেছিলেন এক হাতে পূজোর থালা নিয়ে যাতে ছিল নানা ধরনের পুষ্পসম্ভার আর অন্য হাতে ছিল বিচিত্র সুরের মালা। তাই তাঁর অনেক গানেই পাওয়া যায় আরবী, ইরানী, তুর্কী ও মিশরীয় সুরের গতি প্রকৃতি। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের সুরের আঁধারে ও সে দেশের চিত্রাঙ্কনে যে গানগুলি কবি নজরুল সৃষ্টি করেছেন সে গানগুলিকে বিদেশী সুরের গান বলা হয়।

নজরুলের বিদেশী সুরের গান । নজরুলের ভাবনা
যারা বিদেশী সুর অবলম্বন করে গীত রচনা করেছেন তাদের মধ্যে নজরুল অন্যতম। বিদেশী সুর সম্পাদনে নজরুল দেশীয় সঙ্গীতরসে যে প্রাণ মাতানো গীতিগুচ্ছ রচনা করেছেন তার তুলনা আমাদের বাংলাসঙ্গীত ভাণ্ডারে তেমনটি দেখা যায় না। তাঁর গানের সর্বময়ী সুরবিস্তারের জন্য তিনি বিদেশী সুর অবলম্বন করেন।
নজরুলের গানে পড়েছে প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব। আসলে নজরুল আকর্ষনীয় সুর তা যে কোনো ভাষায় হোক না কেন কানে এলেই তিনি সেটা তাঁর গানে ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। ফলে বৈচিত্র্যময় সুরে পরিপূর্ণ হয়েছে নজরুলের সঙ্গীত। মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলি দেশের বিভিন্ন সুর তিনি সংগ্রহ করেছেন এবং হুবহু সেই সুরের ফ্রেমে বাংলা কথা বসিয়ে দিয়েছেন।

এমন কি নজরুলসঙ্গীতে জিপসীদের সুর বৈচিত্র্য অতি সুনিপুণভাবে নজরুল ব্যবহার করেছেন, ফলে নজরুলসঙ্গীত নবরূপে পরিচিতি পেয়েছে। পারস্য দেশের মোকাম ও গম্বা আমাদের দেশে প্রথম নজরুলই ব্যবহার করেছেন। মোকাম বলতে আমাদের দেশে সঙ্গীতের ঠাটের প্রতিরূপকেই বোঝানো হয়েছে। সকল বিদেশী সুরের গানেই নজরুল সার্থকতা অর্জন করেছিলেন।
তাই নজরুলসঙ্গীত বঙ্গ সংস্কৃতির এক উল্লেখযোগ্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। সুর ও বাণীর মালা দিয়ে আর কোন গীতিকার ও সুরকার বাঙালির হৃদয়কে এত গভীরভাবে আবেগে জড়াতে পারেনি। যতই দিন যাচ্ছে নজরুলসঙ্গীতের কদর আরো বেড়েই চলছে। কারণ নজরুর সঙ্গীত তো শুধু গীতি নয় অমৃত সুর সুধায় সিক্ত এক প্রকার আস্বাদন সামগ্রী। সত্যিকারের বিদেশি সুরে কি মাদকতা আছে তা একমাত্র রসিকরাই জানেন।

নজরুলসঙ্গীত বিদেশী সুরের অবস্থান বর্ণনা করতে গিয়ে নজরুল পুত্র কাজী অনিরুদ্ধ বলেছেন, “বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুল যেন মধ্যপ্রাচ্যের সুর ও সাফী, খেজুর গাছ, প্রখর রৌদ্র এবং ওয়েসিসের শ্যামলিমা নিয়ে হাজির হলেন”। কবি নজরুলের এই সৃজনশীল বহুধারার গান বাংলাগানের এক অমূল্য সম্পদ। তাইতো কবি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছেন। “আপনারা আমার কবিতা সম্পর্কে যা খুশি বলুন কিন্তু আমার গান সম্পর্কে নয়, কারণ গান আমার অনুভূতি”।
যেমন: রুমঝুম রুমঝুম রুমঝুম ঝুম-এই গানটি আরবী সঙ্গীতের সুরকে অবলম্বন করে রচিত। বেদুঈন আরবী মেয়েদের মনোরঞ্জনী গানের সুরের প্রভাব এই গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ ছাড়া “মোমের পুতুল মোমের দেশের মেয়ে এগানটি মিশরীয় ইজিপসীয় ড্যান্সের সুরে সুরারোপ করেছেন। তাতে একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে নজরুল তার গানের বৈচিত্র্য প্রশ্নে অনেক দুর্লভ সুরকেও তার রচিত গানে নান্দনিকভাবে ব্যবহার করেছেন।

