বাংলা গানের আধুনিক পর্ব নিয়ে আলাপ করবো আজ। বাংলাসঙ্গীত মানেই গান-কথা ও সুরের সমন্বয়ের সৃষ্টরূপ। তাই বাংলাগানের আধুনিক পর্বকে সঙ্গীতের স্বর্ণযুগ বলা হয়। চর্যাপদ হতে এগান বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিকরূপে আত্মপ্রকাশ করে।
বাংলা গানের আধুনিক পর্ব

আধুনিক পর্বকে যারা অলংকৃত করেছেন তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রদাস সেন এবং কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম। সে প্রেক্ষাপটে ১৮৬১ হতে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এ সময়কে বাংলা গানের আধুনিক পর্ব হিসাবে ধরা হয়েছে। এই পঞ্চকবিদের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বাংলা গানের আধুনিক ধারার সূত্রপাত। বিভিন্ন পর্যায়ের গান রচনার ঐতিহ্যিগত রূপ এবং গতিপ্রকৃতি বাংলা গানকে বিশ্বসঙ্গীত সমাজে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে নিয়েছে। আমি সংক্ষিপ্তভাবে এ পর্বকে সাজাবার চেষ্টা করেছি মাত্র।
বাংলা গানের আধুনিক পর্ব এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতার নাম সারদা দেবী। শৈশবে বিদ্যালয়ের গতানুগতিক শিক্ষার প্রতি ছিল অনীহা। তাই নর্মাল স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স প্রভৃতি স্কুলে অল্প কিছুদিন পড়াশুনা করেই তাঁর বিদ্যালয় শিক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে।
শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে কবি প্রতিভার স্ফুরণ দেখা যায়। এবং এই সময়েই সঙ্গীতের প্রতিও তাঁর প্রবল আসক্তি দেখা যায়। তা প্রত্যক্ষভাবে পরীক্ষার পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্রের সঙ্গীত শিক্ষার যথাযথ সুব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে ক্রমান্বয়ে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতের আবেশে নিজেকে উদ্ভাসিত করে তোলেন। পরবর্তীতে এই তরুণকবি একাধিক গ্রন্থ রচনা করে বাংলাসাহিত্য জগতে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। একে একে তিনি রচনা করেন, সোনারতরী, চিত্রা, বলাকা, কল্পনা, ইত্যাদি। কাব্যগ্রন্থ; বউঠাকুরানীর হাট, গোরা ইত্যাদি।
গীতিনাট্য: বাল্মীকি প্রতিভা, মায়ার খেলা ইত্যাদি। প্রবন্ধ, ছোট গল্প এবং সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও নিজেকে উজার করে দিয়েছেন। সাঙ্গীতিক অবকাঠামোকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ বোলপুরে ব্রহ্মাচর্যাশ্রম নামে একটি আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। যা আজ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিশ্বদরবারে নাম কিনেছে।
রবীন্দ্রনাথ বাংলাগানের সমৃদ্ধি প্রশ্নে তাঁর সঙ্গীত রচনাকে বিভিন্নভাবে অলংকৃত করেছেন। তাঁর সমগ্রসঙ্গীত রচনাকে ৬টি মূল পর্যায়ে ভাগ করেন। যেখানে রয়েছে জাগতিক প্রেম, মানবদর্শন এবং আধ্যাত্মিক উপাসনা তাঁর বৈচিত্র্যময় গানের সাঙ্গীতিক বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা শুধু বাংলাগানকে আধুনিকায়নে প্রভাবিত করেনি, রবীন্দ্রসঙ্গীত বাংলাগানের ভাণ্ডারকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্ব সঙ্গীত সমাজে। আমি রবীঠাকুরের ৬টি পর্যায়ের গান নিম্নে উপস্থাপন করলামঃ
(১) পূজা তোমার সুরের ধারা।
(২) স্বদেশ ও আমার দেশের মাটি।
(৩) প্রেম আমার মনের মাঝে যে গান বাজে
(৪) প্রকৃতি বাদল দিনের প্রথম কদম
(৫) বিচিত্র এই তো ভাল লেগেছিল।
(৬) আনুষ্ঠানিক সুধা সাগর তীরে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান এবং বাংলা গানের আধুনিক পর্ব দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কার্তিকেয় রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর মহারাজের দেওয়ান। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এম. এ পাশ করেন।
বাংলাসঙ্গীতের আধুনিকায়নের প্রশ্নে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এক বিরল প্রতিভা। সঙ্গীত রচনা এবং সুরারোপে তিনি বাংলার সঙ্গীত জগতে এক অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য এবং আলোড়ন এনেছিলেন। রাগসঙ্গীত এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সুরকে সার্থকভাবে প্রয়োগ করে তিনি বাংলা গানে, অভিনবত্বের সঙ্গে গতির সঞ্চার করেছিলেন। তার দেশাত্মবোধক গান, কাব্যসঙ্গীত, হাস্যগীতি প্রভৃতি বাংলার ঘরে ঘরে গীত হয়।
বাংলাগানকে নন্দিত করার জন্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় চারশতেরও বেশি গান রচনা করেছিলেন। বাংলাগানের আধুনিক ধারার ক্ষেত্রে ডি.এল. রায়, দুটি অনবদ্য সংযোজনের জন্য বাংলাগানে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রথমত, বাংলাগানে সার্থকভাবে পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রণ এবং দ্বিতীয়, সম্মেলক সঙ্গীত ধারার প্রবর্তন।
ডি.এল. রায়ের গান:
(১) বঙ্গ আমার জননী আমার।
(২) আমি সারা সকালটি ।
(৩) ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে।
(৪) ওকে গান গেয়ে চলে যায়।
(৫) ছিল বসি সে কুসুম কাননে ।
বাংলাগানে রজনীকান্ত সেন:
রজনীকান্ত সেন ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার গঙ্গাবাড়ী নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রজনীকান্তের পিতার নাম গুরুপ্রসাদ সেন এবং মাতার নাম মনমোহনী। ১৮৯০ সালে তিনি বিএল-পাশ করে রাজশাহীতে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
এই কর্ম জীবনেই তিনি কাব্য ও সঙ্গীত সাধনায় ব্রতী হন, তারি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তার রচিত “মায়ের দেয়া মোটা কাপড়” গানটি। বাংলা গানের আধুনিক ধারাকে পরিপূর্ণ রূপ নিতে রজনীকান্ত মূলত তিনটি পর্যায়ের গান রচনা করেছেন। তা হলো- পূজা, দেশাত্মবোধক এবং হাসাগীতি। রজনীকান্তের গানের মূল বৈশিষ্ট্য হলো রচনার সারল্য, সুরের মানুষ এবং করুণ রসের স্বতস্ফুর্ত আবেগ।
রজনীকান্ত সেন খুব কম সময় ধরে পৃথিবীতে অবস্থান করলেও তার রচিত সঙ্গীত আবহমান বাংলার প্রচলিত সঙ্গীত ধারাকে বিবর্তিত করেছে। সাঙ্গীতিক অবকাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখে রজনীকান্তের গানের বাণী ও সুরের অপূর্ব সম্মেলন বাংলাগানকে আধুনিক রূপ দিয়েছে। রজনীকান্ত রচিত গান
(১) আজি এ শারদ সাঁঝে জীবনে
(২) আমি তো তোমায় চাহিনে
(৩) কি মধুকাকলী ওরে পাখী
(৪) ধীর সমীরে চঞ্চল নীরে
(৫) বেলা যে ফুরায়ে যায়
অতুলপ্রসাদ সেনের গান এবং বাংলা গানের আধুনিক পর্ব:
কালের বিবর্তনে অনেক প্রতিভাবন ব্যক্তি পৃথিবীতে অবির্ভূত হন। অতুলপ্রসাদকে তারি একজন বলে ধরে নেয়া যায়। অতুলপ্রসাদ ১৮৭১ সালের ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রামপ্রসাদ সেন এবং মাতার নাম হেমন্তশশী দেবী।
১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অতুলপ্রসাদ কিছু কাল প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যায়ন করেন। পরে বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারি পাশ করে আইন ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। এই কর্মজীবনেই অবসর মুহুর্তগুলি অতুলপ্রসাদ সঙ্গীত সৃষ্টির কাজে অতিবাহিত করতেন। তিনি প্রেম, প্রকৃতি, পূজা ইত্যাদি পর্যায়ের গান রচনায় নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রাখেন।
বাংলাগানের আধুনিক পর্বে অতুলপ্রসাদের সর্বপ্রথম অবদান হলো ঠুমরী গান রচনা। ঠুমরীর কাজ, লালিত্য, কোমলভাব তাঁর প্রায় সকল গানেই মধুরতম রূপ দিয়েছে বলে প্রমাণিক তাঁর রচিত গানগুলো ‘গীতি গুনজ’ নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট এই সঙ্গীত গুণীর জীবনাবসান ঘটে।
অতুলপ্রসাদের রচিত গান:
(১) আমার বাগানে এত ফুল ।
(২) ডাকে কোয়েলা বারে বারে।
(৩) আপন কাজে অচল হলে চলবে না।
(৪) একা মোর গানের তরী
(৫) তুমি মধুর অঙ্গে নাচো গো রঙ্গে।
কাজী নজরুল ইসলাম এবং বাংলা গানের আধুনিক পর্ব:
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা গানের বিবর্তনবাদের ধারায় আধুনিক পর্বের শেষ রচিয়তা। এই মহানকবি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, মঙ্গলবার বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন।
ছোটবেলা হতেই কবি প্রতিভার নানাদিক নজরুলের মধ্যে সুর্যরশ্মির মতো বিচ্ছুরিত হয়। যা প্রতিফলিত হয়েছে বাংলাগানের বিবর্তনে। বাংলাগানের এমন কোনো পর্যায় নেই। যেখানে নজরুল বিচরণ করেনি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অবকাঠামো থেকে শুরু করে ছাদ পেটানোর গান পর্যন্ত। প্রামাণিক তথ্য অনুসারে নজরুলের মোট সঙ্গীত রচনার সংখ্যা ৩,৫০০-এর বেশি।
যার মধ্যে রয়েছে ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরী, কাব্যগীতি, দেশাত্মবোধক রাগপ্রধান, আধুনিক, ভজন, উদ্দীপনামূলক, শ্যামাসঙ্গীত, লোকসঙ্গীত, গজল, নারী জাগরণ, সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতি, ইসলামিক, আগমনী, বাণীচিত্র, নাটক প্রভৃতি পর্যায়ের গান। আধুনিক শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করলে নজরুলের গানের চারদিগন্ত পরিচ্ছন্নভাবে সফলতার দাবীদার। কারণ নজরুল অসুন্দরকে পরিহার করে সুন্দর ও সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্যে দেশবাসীর হিতার্থে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।
তাই জনগণের কবি কাজী নজরুল সঙ্গীত রচনায় নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রেখেছেন। নজরুলের গানের বাণী ও সুরের অপূর্ব। সম্মেলন, রাগনির্বাচন, তালের সংযোগ, গায়কী বৈশিষ্ট্য বাংলাগানের আধুনিক রূপকে লাবণ্যময়ী করেছেন বলে সঙ্গীতগুনীরা একমত। এছাড়াও নজরুল সঙ্গীত বৈচিত্র্যের একটি মূল বিষয় হলো অন্য সুরকার প্রসঙ্গ।
গীতিকার নজরুল হলেও তার অনেক গানের সুরকার অন্যজন। এর মধ্যে কমলদাস, মৃনাল কান্তি ঘোষ, গীরিণ চক্রবর্তী প্রমুখ ব্যক্তি রয়েছেন। ফলে বিচিত্রমুখী সুরের ধারায় নজরুল সঙ্গীত বাংলাগানের বিবর্তনে আধুনিক পর্বকে করেছেন নান্দনিক ঐশ্বর্যমণ্ডিত এবং গীতিময়।
বাংলা গানের আধুনিক পর্বের সাঙ্গীতিক মূল্যায়ন:
সাঙ্গীতিক মূল্যবোধের দৃষ্টিতে পঞ্চ কবির গানের ধারাবাহিকতা অসীম। বাংলাগানের চারদিগন্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সাঙ্গীতিক অবকাঠামো, রাগ ও তালের ব্যবহার, গঠনপ্রণালী, অবয়ব, সুরবিন্যাস, বিষয় অনুসারে শব্দ তথা বাক্যচয়ন, গীতিশৈলী পঞ্চগীতি কবির গানে পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছে। ফলে বাংলাগানের চলমান দৃষ্টিকোণ ক্রমান্বয়ে আধুনিকায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রাসঙ্গিক আলোচনার ক্ষেত্রে সকল সঙ্গীতগুণী এ ক্ষেত্রে একমত। সঙ্গীতের বাহ্যিক অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একজন গীতিকার ও সুরকারের অবস্থান পরিপূর্ণ হবার কারণে সাঙ্গীতিক মূল্যবোধে তা পূর্ণতা পেয়েছে।
বিংশ শতাব্দীতে বাংলাসঙ্গীতের আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, ও নজরুল এই পঞ্চকবির গীতিরসে প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও লোকসঙ্গীতের বৈচিত্র্যময় সম্ভারে পূর্ণ হলো বাংলাসঙ্গীত তথা বাংলা গান। চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, গীতগোবিন্দ প্রভৃতি ধারা অতিক্রম করে বাংলা গান আজকের এ পর্যায়ে সমৃদ্ধও গতিময়তা পেয়েছে।

