পরভৃত কবিতা | মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম

পরভৃত কবিতা টি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । মরুভাস্কর কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। হজরত মোহাম্মদ সঃ এর জীবনী নিয়ে চারটি সর্গে ১৮ টি খণ্ড-কবিতা নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ।

 

পরভৃত কবিতা | মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম [ Kazi nazrul islam ]

পরভৃত কবিতা

আঁধার কেন গো ঘনতম হয় উদয়-উষার আগে?
পাতা ঝরে যায় কাননে, যখন ফাগুন-আবেশ লাগে
তরু ও লতার তনুতে তনুতে, কেন কে বলিতে পারে?
সুর বাঁধিবার আগে কেন গুণী ব্যথা হানে বীণা-তারে?
টানিয়া টানিয়া না বাঁধিলে তারে ছিঁড়িয়া যাবার মতো
ফোটে না কি বাণী, না করিলে তারে সদা অঙ্গুলি ক্ষত?
সূর্য ওঠার যবে দেরি নাই, বিহগেরা প্রায় জাগে,
তখন কি চোখে অধিক করিয়া তন্দ্রার ঝিম লাগে?

কেন গো কে জানে, নতুন চন্দ্র উদয়ের আগে হেন
অমাবস্যার আঁধার ঘনায়, গ্রাসিবে বিশ্ব যেন!
পুণ্যের শুভ আলোক পড়িবে যবে শতধারে ফুটে
তার আগে কেন বসুমতী পাপ-পঙ্কিল হয়ে উঠে?
ফুল ফসলের মেলা বসাবার বর্ষা নামার আগে,
কালো হয়ে কেন আসে মেঘ, কেন বজ্রের ধাঁধা লাগে?
এই কি নিয়ম? এই কি নিয়তি? নিখিল-জননী জানে,
সৃষ্টির আগে এই সে অসহ প্রসব-ব্যথার মানে!

এমনই আঁধার ঘনতম হয়ে ঘিরিয়াছিল সেদিন,
উদয়-রবির পানে চেয়েছিল জগৎ তমসা-লীন।
পাপ অনাচার দ্বেষ হিংসার আশী-বিষ-ফণা তলে
ধরণির আশা যেন ক্ষীণজ্যোতি মানিকের মতো জ্বলে!
মানুষের মনে বেঁধেছিল বাসা বনের পশুরা যত,
বন্য বরাহে ভল্লুকে রণ; নখর-দন্ত-ক্ষত
কাঁপিতেছিল এ ধরা অসহায় ভীরু বালিকার সম!

শূন্য-অঙ্কে ক্লেদে ও পঙ্কে পাপে কুৎসিততম
ঘুরিতেছিল এ কুগ্রহ যেন অভিশাপ-ধূমকেতু,
সৃষ্টির মাঝে এ ছিল সকল অকল্যাণের হেতু!
অত্যাচারিত উৎপীড়িতের জমে উঠে আঁখিজল
সাগর হইয়া গ্রাসিল ধরার যেন তিন ভাগ থল!
ধরণি ভগ্ন তরণির প্রায় শূন্য-পাথরতলে
হাবুডুবু খায় বুঝি ডুবে যায়, যত চলে তত টলে।
এশিয়া য়ুরোপ আফ্রিকা – এই পৃথিবীর যত দেশ
যেন নেমেছিল প্রতিযোগিতায় দেখিতে পাপের শেষ!

 

পরভৃত কবিতা | মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম [ Kazi nazrul islam ]

এই অনাচার মিথ্যা পাপের নিপীড়ন-উৎসবে
মক্কা ছিল গো রাজধানী যেন ‘জজিরাতুল আরবে।’
পাপের বাজারে করিত বেসাতি সমান পুরুষ নারী,
পাপের ভাঁটিতে চলিত গো যেন পিপীলিকা সারি সারি।
বালক বালিকা যুবা ও বৃদ্ধে ছিল নাকো ভেদাভেদ,
চলিত ভীষণ ব্যাভিচার-লীলা নির্লাজ নির্বেদ!

নারী ছিল সেথা ভোগ-উৎসবে জ্বালিতে কামনা-বাতি,
ছিল না বিরাম সে বাতি জ্বলিত সমান দিবস-রাতি।
জন্মিলে মেয়ে পিতা তারে লয়ে ফেলিত অন্ধকূপে
হত্যা করিত, কিংবা মারিত আছাড়ি পাষাণস্তূপে!
হায় রে, যাহারা স্বর্গেমর্ত্যে বাঁধে মিলনের সেতু
বন্যা-ঢল সে কন্যারা ছিল যেন লজ্জারই সেতু!
সুন্দরে লয়ে অসুন্দরের এই লীলা তাণ্ডব
চলিতেছিল, এ দেহ ছিল শুধু শকুন-খাদ্য শব!

দেহ-সরসীর পাঁকের ঊর্ধ্বে সলিল সুনির্মল
ত্যজিয়া তাহারে মেতেছিল পাঁকে বন্য-বরাহ দল!
চরণে দলিত কর্দমে যারে গড়িয়া তুলিল নর
ভাবিত তাহারে সৃষ্টিকর্তা, সেই পরমেশ্বর!

আল্লার ঘর কাবায় করিত হল্লা পিশাচ ভূত,
শিরনি খাইত সেথা তিন শত ষাট সে প্রেতের পুত!
শয়তান ছিল বাদশাহ সেথা, অগণিত পাপ-সেনা,
বিনি সুদে সেথা হতে চলিত গো ব্যভিচার লেনা-দেনা!
সে পাপ-গন্ধে ছিঁড়িয়া যাইত যেন ধরণির স্নায়ু,
ভূমিকম্পে সে মোচড় খাইত যেন শেষ তার আয়ু!
এমনই আঁধার গ্রাসিয়াছে যবে পৃথ্বী নিবিড়তম–
ঊর্ধ্বে উঠিল সংগীত, ‘হল আসার সময় মম!’

ঘন তমসার সূতিকা-আগারে জনমিল নব শশী,
নব আলোকের আভাসে ধরণি উঠিল গো উচ্ছ্বসি।
ছুটিয়া আসিল গ্রহ-তারাদল আকাশ-আঙিনা মাঝে,
মেঘের আঁচলে জড়াইয়া শিশুচাঁদেরে পুলক লাজে
দাঁড়াল বিশ্ব-জননী যেন রে ; পাইয়া সুসংবাদ
চকোর-চকোরী ভিড় করে এল নিতে সুধার প্রসাদ!

ধরণির নীল আঁখি-যুগ যেন সায়রে শালুক সুঁদি
চাঁদেরে না হেরে ভাসিত গো জলে ছিল এতদিন মুদি,
ফুটিল রে তারা অরুণ-আভায় আজ এতদিন পরে,
দুটি চোখে যেন প্রাণের সকল ব্যথা নিবেদন করে!
পুলকে শ্রদ্ধা সম্ভ্রমে ওঠে দুলিয়া দুলিয়া কাবা,
বিশ্ব-বীণায় বাজে আগমনি, ‘মারহবা! মারহবা!!’

 

কবিতা পরভৃত প্রথম সর্গ কাব্যগ্রন্থ মরুভাস্কর কাজী নজরুল ইসলাম পরভৃত কবিতা | মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম

 

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তার জীবন শুরু হয়েছিল অ কিঞ্চিত কর পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।

মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজন্যদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জন প্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্ত র্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।

১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্‌-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি।

এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।

 

পরভৃত কবিতা | মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ । কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম [ Kazi nazrul islam ]

মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ

প্রথম সর্গ

  • অবতরণিকা
  • অনাগত
  • অভ্যূদয়
  • স্বপ্ন
  • আলো-আঁধারি
  • দাদা
  • পরভৃত

দ্বিতীয় সর্গ

  • শৈশব-লীলা
  • প্রত্যাবর্তন
  • “সাক্কুস সাদ্‌র” (হৃদয় উন্মোচন)
  • সর্বহারা

তৃতীয় সর্গ

  • কৈশোর
  • সত্যাগ্রহী মোহাম্মদ

চতুর্থ সর্গ

  • শাদী মোবারক
  • খদিজা
  • সম্প্রদান
  • নও কাবা
  • সাম্যবাদী

 

Leave a Comment