নজরুল শ্যামা সঙ্গীত: শ্যামাসংগীত কালী-বিষয়ক বাংলা ভক্তিগীতির একটি জনপ্রিয় ধারা। এই শ্রেণীর সঙ্গীত শাক্তপদাবলির একটি বিশিষ্ট পর্যায়। শাক্তকবিরা প্রধানত তন্ত্রাশ্রয়ী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন বলে শ্যামাসংগীতে তন্ত্রদর্শন নানাভাবে দ্যোতিত। শ্যামাসঙ্গীতের পদগুলিতে কালী বা শ্যামা মাতৃরূপে ও ভক্ত সাধক সন্তানরূপে কল্পিত। ভক্তের প্রাণের আবেগ, আকুতি, আবদার, অনুযোগ, অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার নিবেদন ছন্দোবদ্ধ হয়ে গীতধারায় প্রকাশিত হয়েছে এই পর্যায়ে।এই কারণে সাধনতত্ত্বের পাশাপাশি আত্মনিবেদনের ঘনিষ্ঠ আকূতি শ্যামাবিষয়ক পদগুলিতে অপূর্ব কাব্যময় হয়ে উঠেছে।

নজরুল শ্যামা সঙ্গীত । নজরুলের ভাবনা
নজরুল শ্যামা সঙ্গীতগুলির সুরগত বিশেষত্ব সহজেই দৃষ্টিকোণ আকর্ষণ করে। বাঙলাদেশের মানুষের কানে ও মনে শ্যামা-সঙ্গীতের একটি সুরগত ‘টাইপ’ বা ‘নকশা’ বা ‘ঢন্ত’ বাসা বেঁধে আছে। অথচ, নজরুলের শ্যামা সঙ্গীতের সুরের সেই বিশেষ ‘টাইপ’ বা ‘ঢ’টি নেই। এগুলিতে রাগসঙ্গীত এবং মার্গসঙ্গীতের প্রভাব প্রবল এবং প্রবল বলেই প্রথম রেকর্ড করবার সময় প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী খোল না বাজিয়ে পাখোয়াজই বাজানো হয়েছিল। অবশ্যই খাঁটি শ্যামাসঙ্গীতের ঢংয়ে নজরুল যে সঙ্গীত রচনা করেন নি, এমনও নয়।

গানের রচনা রীতির দিক থেকে বিচার করলে কিন্তু নজরুলের শ্যামা সঙ্গীতকে রামপ্রসাদ-কমলাকান্তের কাছাকাছিই মনে হবে। শ্যামা বিষয়ক সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন এবং তাঁর গানের সুরে রামপ্রসাদী রূপটি অবিকৃত এবং অক্ষুণ্ণ আছে।
রবীন্দ্রনাথের “আমিই শুধু রইনু বাকী” কিংবা “বাল্মীকি প্রতিভা” তে এখিত “শ্যামা”, এবার ছেড়ে চলেছি মা।” গানটির নাম ঐ বিষয়ে সকলেরই মনে হবে। নজরুল সুরের দিক থেকে রামপ্রসাদী রূপটিকে অক্ষুণ্ণ রাখেননি বটে, কিন্তু ছন্দ ও শব্দচয়নের দিক থেকে তিনি শ্যামা সঙ্গীতের ভাবগত দিকটিকে অবিকৃত রেখেছেন।

শ্যামা-শ্যামা-উমাকে অবলম্বন করে তিনি ভক্তের আকুতি ও আবদারকে একদিকে যেমন ফুটিয়েছেন, অপরদিকে তাঁদের নামিয়ে এনেছেন পারিবারিক জীবনের মধুময় বন্ধনের ক্ষেত্রে। অপরদিকে তেমনি শব্দচয়নের বেলায় তিনি ঘরোয়া ও পরিচিত শব্দকেই প্রাধান্য দিয়েছেন; এমন কি, ছন্দের ক্ষেত্রেও তিনি বাঙালির প্রিয় ও পরিচিত শ্বাসাঘাত প্রধান ছন্দকেই মুখ্য করে তুলেছেন।

