নজরুলের রোমান্টিক গান এবং চার কবির রোমান্টিক গানের তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপন কর : বাংলা গানের ধারায় পঞ্চ-গীতি কবির গান একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নজরুল পর্যন্ত এই পঞ্চ-গীতি কবির গানের পর্যায় গুলোর মধ্যে রোমান্টিক গান একটি বিশেষ ধারা। আমরা এখানে নজরুলের রোমান্টিক গানের সাথে রবীন্দ্রনাথ, ডি. এল. রায়, অতুল প্রসাদ, রজনী কান্তের রোমান্টিক সঙ্গীতের গীতি শৈলী, সুর বিশ্লেষণ নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনায় উপস্থাপনের চেষ্টা করব।
নজরুলের রোমান্টিক গান এবং চার কবির রোমান্টিক গানের তুলনামূলক আলোচনা
মন্তব্য – ( ১ ) বাংলা গানের বিশেষজ্ঞ দিলিপ কুমার রায় তাঁর “ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাস” গ্রন্থে বাংলা গানের তুলনামূলক আলোচনায় লিখেছেন-
বাংলা গানে আধুনিক এবং রোমান্টিক সঙ্গীতের সৃষ্টিশীল অবস্থান পঞ্চ-গীতি কবির।
(২) সুবোধ মিত্রের ভাষায়
“পঞ্চ-গীতি কবির সকল পর্যায়ের গানের মধ্যে আধুনিক এবং রোমান্টিক সঙ্গীতের অবস্থান সর্বাপেক্ষা বেশি”।
তথ্য : বাংলা গান ও বর্তমান অবস্থা / লেখক গৌরি সংঘর চট্টপাধ্যায়।
ৰাণীগত অবস্থাঃ
বাণীর দিক দিয়ে কাউকে ছোট করে দেখা সম্ভব নয়। যদিও ভাষাগত ও বাণীগত দিক দিয়ে অনেক মন্তব্য প্রচলিত। নজরুলের ইসলাম সকল পর্যায়ে বাণী বন্ধ করতে গিয়ে তাঁর গানে সাধারণ অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করেছে। যেটা চার কবির রোমান্টিক গানে অনেকাংশে অনুপস্থিত। যেমন-
১. নজরুলের গান-তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি………
২. রবীন্দ্র নাথের গান-আমার পরাণে যাহা চায়…….
৩. ডি. এল. রায়ের গান-আজি তোমার কাছে ভাসিয়া যায়।
৪. অতুল প্রসাদের গান কে আবার বাজায় বাঁশি….
৫ রজনীকান্তের গান জাগাও পথিকে ওসে ঘুমে অচেতন….
শাব্দিক অলংকরণ :
বাণী-বিন্যাস এবং সাঙ্গীতিক অবস্থান সঠিক রাখবার প্রয়োজনে সব গীতিকারগণেই শব্দগত অবস্থান সঠিক রাখবার চেষ্টা করে। এদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান সবার শীর্ষে তার পরই কাজী নজরুলের রোমান্টিক গান। ডি.এল. রায় এর প্রবর্তক হলেও তার গানে শব্দগত অলংকারের যে অবস্থান তা রবীন্দ্র নাথ ও নজরুলের গানের সমসাময়িক নয়। এই তিন কবির পরেই রজনী কান্ত এবং অতুল প্রসাদের গানের শব্দ গত অবস্থান।
বাক্য সমন্বয়
সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করতে গেলে বাক্য সমন্বয়ে গানের ভাব দর্শন এবং ভাষাগত অবস্থান দুটোর মধ্যেই সীমাদ্ধ। রোমান্টিক গানের সঠিক সুর সংযোজনে অনেক সময় বাক্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তবুও রোমান্টিক গান যেহে বাণী ও সুরে গঠিত, সে কারণে পঞ্চ-গীতি কবির বাক্য সমন্বয়ের অবস্থান সুন্দর। নজরুলসঙ্গীতের সুর বৈচিত্র্যের কারণে বাক্য সমন্বয় হয়তো স্বাভাবিক পর্যায়ের।
সুর বৈচিত্র্য
রোমান্টিক সঙ্গীতের সুর বৈচিত্র্যে নজরুল ইসলাম সবার শীর্ষে। নান্দনীক অবস্থানে নজরুলের রোমান্টিক গানের ব্যাপকতা অনেক বেশি। ভাষাগত অবস্থান ছন্দপত অবস্থান এবং গীতি শৈলী সব কিছু মিলিয়ে পঞ্চ-গীতি কবির রোমান্টিক গানের অবস্থান অপরিসীম।
বিষয় :
রোমান্টিক গানের বিষয়বস্তু ও ভাবধারা সব গীতিকারের একই রকম প্রায়। তবুও পঞ্চ-গীতিকারের ক্ষেত্রে সামান্য পার্থক্য আমরা উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি। প্রথমে রবীঠাকুরের রোমান্টিক গানের কথা বলা যেতে পারে। পরবর্তীতে কাজী নজরুলের রোমান্টিক গানের দর্শনতত্ত্ব এবং সারমর্ম দুটি ভিন্ন অবস্থান, এক্ষেত্রে বিষয়ের বিশ্লেষণ করলে বিষয়তাত্ত্বিক ধারায় পরিবর্তন লক্ষণীয়। যা আমরা নজরুল, রবীন্দ্রনাথ তথা পথ-কবির রোমান্টিক গানে অবস্থান লক্ষ করি
দর্শন-তত্ত্বঃ
সাঙ্গীতিক ভাব ধারায় অবস্থানের প্রেক্ষাপটে গানের দর্শনতত্ত্ব গীতিকারের ভাব ধারার উপর নির্ভরশীল। সে ক্ষেত্রে নজরুলের রোমান্টিক গানের দর্শনতত্ত্ব আলোচনায় তৎকালীণ উৎস ও পটভূমির অবস্থানের উপর নির্ভর করে। ঠিক তেমনি রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য রোমান্টিক গানের দর্শনতত্ত্ব ঠিক একই । এখানে নজরুলের রোমান্টিক গানের সাথে চার কবির রোমান্টিক গানের দর্শনতত্ত্ব ভিন্ন রকম, তুলনামুলক আলোচায় দর্শনতাত্ত্বিক উপায়ে রোমান্টিক গানের একমাত্র দর্শনত আলোচনা করা যেতে পারে। তবে কোনো গীতকারের গানের দর্শনতত্ত্ব ভালো বা মন্দ সে বিবেচনা সম্ভব নয়।
অবয়ব :
চর্যাপদ থেকে আধুনিক পর্যায় পর্যন্ত বাংলা গানের ধারায় সকল পর্যায়ে গানের নাম ভিন্ন হলেও অবয়ব একই রকম প্রায়। স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ, এই চারটি বিভাগেই পঞ্চ-গীতির রোমান্টিক গানের অবস্থান। যদিও অনেক ক্ষেত্রে এর পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়।
রাগ-রাগিনীর ব্যবহার
পঞ্চ-গীতি কবির মধ্যে এক মাত্র নজরুলই তাঁর গানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ব্যবহার বেশি করেছেন। যদিও রোমান্টিক গানের ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাহ্যিক উপস্থাপন সামান্য। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে রাগের ব্যবহার সঠিকভাবে করেছেন বললেই চলে। ডি. এল. রায়, রজনী কান্ত, অতুল প্রসাদ সুরের নান্দনীক দিক রক্ষা করেই মূলত রোমান্টিক গানের সুর করেছেন। ফলে রাগের ব্যবহার সেখানে প্রাধান্য পায়নি।
তালের ব্যববহারঃ
তালের ক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম তাঁর গানে বৈচিত্র্য সাধন করেছেন। শুধু রোমান্টিক সঙ্গীত নয় রাগপ্রধান, ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ঠুমরী, টপ্পা এবং ভাল সৃষ্টিসহ সর্ব ক্ষেত্রে তিনি তাঁর বৈচিত্র্য সাধন করেছেন। রোমান্টিক গানের ক্ষেত্রে তার বৈচিত্র্য দেখা যায়, ঠিক একইভাবে ডি. এল. রায়, রজনীকান্ত অতুল প্রসাদের রোমান্টিক গানেও তালের বিভিন্নতা রয়েছে।
গীতিশৈলী :
গীতিশৈলীর ধারায় পঞ্চ-গীতি কবির গান একই রকম। প্রথমে স্থায়ী, স্থায়ী সমাপ্তির পর অন্তরা, অন্তরা সমাপ্তির পর সঞ্চারী, শেষ পর্যায়ে আভোগ পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে রোমান্টিক গানের সমাপ্তি।
সারমর্ম:
দর্শন তত্ত্বের আলোকে প্রত্যেক গানেরই সারমর্ম ভিন্নধর্মী, পঞ্চ-গীতি কবির গানের একটি পর্যায় রোমান্টিক হলেও সারমর্ম ব্যক্তি বিশেষ ভিন্নধর্মী। যেমন- কোনো গানের গীতিকারের অবস্থান বা ভাবদর্শনকেই আমরা দর্শনতত্ত্ব বলে জানি। কিন্তু গীতিকার ব্যতিত ব্যক্তি বিশেষের অবস্থান সারমর্ম সার্বিকভাবে ভিন্নধর্মী বা কখনও কখনও একটি ভিন্ন অর্থ বহন করে।
উপসংহার :
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে নজরুরের রোমান্টিক গানের বিশ্লেষণ রবীন্দ্রনাথ, অতুল প্রসাদ, রজনী কান্ত, ডি.এল. রায়, এদের রোমান্টিক গান প্রায় সমসাময়িক, যদিও অনেক ক্ষেত্রে নজরুলের রোমান্টিক গানের ব্যপকতা অনেক বেশি।
আরও দেখুনঃ