কাজী নজরুলের ভাওয়াইয়া গান নিয়ে আজকের আলোচনা। ভাটিয়ালীর মতই অর্থনৈতিক প্রভাবকে প্রকট দেখি উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া গানে। উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, কুচবিহার অঞ্চলের অসমতল পথে, যেখানে মহিষের গাড়ি অথবা মহিষের পাল চরানোই মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল, সেখানকার গানে ভাটিয়ালীর মত প্রবহমান সুর থাকাটা অসম্ভব। তাই ভাওয়াইয়ার বিষয়বস্তু ভাটিয়ালীরই মত প্রেমকেন্দ্রিক ও আধ্যাত্মিক হওয়া সত্ত্বেও গানের সুরে ধরা পড়ে ফাঁকা পার্বত্য ভূমিতে প্রতিধ্বনি হয়ে শব্দ প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারটা- সুরে লক্ষিত হয় একধরনের মোচড়, যা ধ্বনি ও প্রতিধ্বনির সংমিশ্রণে গঠিত। পার্বত্য পথেরই মতন এর সুরের ওঠাপড়া।
কাজী নজরুলের ভাওয়াইয়া গান । নজরুলের ভাবনা
নজরুল ইসলাম রচিত ভাওয়াইয়া গানগুলিতে চিরাচরিত সুরের ব্যবাহারটি অক্ষুণ্ণ। ভাটিয়ালী ও ভাওয়াইয়া রচনার ক্ষেত্রে কবি অনেকখানি অনুপ্রেরণা লাভ করেন প্রসিদ্ধ শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের কাছ থেকে। আব্বাসউদ্দীন আহমদ রচিত ‘গীতিকার নজরুল’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়-
‘নদীর নাম সই কচুয়া
মাছ মারে মাছুয়া’-
গানটি শিল্পীর কাছে শুনে কবি মুগ্ধ হন এবং রেকর্ড কোম্পানীর রিহার্সাল রচনা করেন একই সুরে বাঁধা এই গানটি:
‘নদীর নাম সই অল্পনা
নাচে তীরে খঞ্জনা, পাখি সেনয় নাচে কালো আঁখি,
আমি যাব না আর অল্পনাতে
জল নিতে সখি লো,
ঐ আঁখি কিছু রাখিবে না বাকি
ভাওয়াইয়া গানের গায়ন শৈলীতে যে গলাভাঙার মাধুর্য, সেটাই কবিকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে একাধিক ভাওয়াইয়া রচনায়। আব্বাসউদ্দীনের গাওয়া-
তোরষা নদীর পারে পারে ও
দিদি লো মানসই নদীর পারে’-
গানটির অনুকরণে কাজী নজরুল ইসলাম রচনরা করলেন-
‘পদ্মদীঘির ধারে ধারে ঐ
সখি লো কমল দীঘির ধারে
আমি জল নিতে যাই
সকাল সাঝে সই
সখি, ছল করে সে মাছ ধরে
আর, চায় সে বারে বারে ॥
উপরোক্ত গান দুটিতে কবি যথার্থ ভাওয়াইয়ার সুর ও ভাবকে অনুসরণ করেছেন। এছাড়া ভাওয়াইার সুরে রচিত-
‘কুচবরণ কন্যারে তার মেঘবরণ কেশ,
আমার লয়ে যাওরে নদী সেই সে কন্যার দেশ –
গানটিতে সুর ও বিষয়ের পাশাপাশি ‘কন্যার’রূপবর্ননার ক্ষেত্রে ধরা দিয়েছেন আধুনিক কবি নজরুল ইসলাম। আবার কবি তাঁর প্রিয় বস্তু চাঁদের আলো, তারা-র সৌন্দর্য দিয়ে সাজালেন তাঁর কল্পনার প্রেয়সীকে। কন্যার অঙ্গশোভায় পিছলে পড়ে চাঁদের কিরণ, সকাল ও সন্ধ্যা তাদের রক্তিম আভা নিয়ে আসে কন্যার পায়ের আলতা হতে। এ সজ্জা তো নজরুল ইসলামের বড় প্রিয়- আমাদের খুব পরিচিত।
আরও দেখুনঃ