কবি নজরুলের গানে প্রেম ও পূজা

কবি নজরুলের গানে প্রেম ও পূজা নিয়ে আজকের আলোচনা। প্রেম মনস্তত্ত্বের প্রথম স্তরে অব্যক্ত প্রেমের যন্ত্রণা। তনু-মন সবই প্রিয়জনের জন্য প্রস্তুত, শুধুমাত্র প্রকাশের অভাবেই আসে বিরহ ব্যথা। দ্বিতীয় স্তরে মিলনকালেও জাগে আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনার প্রকাশ- আর সত্যই যখন প্রেমিক ও প্রেমিকা বিচ্ছিন্ন, সেখানেই নজরুল ইসলামের যথার্থ প্রেমিক কবি সত্তায় প্রকাশ।

 

কবি নজরুলের গানে প্রেম ও পূজা

 

কবি নজরুলের গানে প্রেম ও পূজা

বৈষ্ণব প্রেম মনস্তত্ত্বের স্তরগুলি তিনি অনেক ক্ষেত্রেই যথার্থভাবে মেনে চলেছেন তার প্রেমসঙ্গীতগুলি রচনার ক্ষেত্রে। কবির সৃষ্ট বিরহের গানেও দেবতা প্রণামের সময়ও প্রেমিকার চোখে বিশ্বময় ধরা দেয় তার প্রেমাস্পদের রূপ- এটি প্রেমের চরম পরিণতি, যেখানে পরস্পর পরস্পরের সামনে উপস্থিত না থেকেও কবির প্রেমিক- প্রেমিকা একে অপরের জগতে সর্বত্র বিরাজিত।

আবার বিপরীত দিক থেকে যদি দেখি, তাহলে আমাদের সামনে উপস্থিত হয় আরাধ্য এবং আরাধিকার নৈকট্য, যেখানে আরাধ্যের মধ্যে লক্ষিত হয় না এমন কোনা বিশালত্ব, যা মানুষকে দুর থেকে পূজা করায় আরাধ্য পরিণতহন প্রিয়রূপে (“কি হবে জানিয়া কে তুমি বঁধু, কি তব পরিচয়?”)।

 

কবি নজরুলের গানে প্রেম ও পূজা

 

যে বিশালের আরাধনায় সারা প্রকৃতি রত, যার বন্দনায় ভোরের তারা অপেক্ষমান, করা ফুলের পুষ্পাঞ্জালি হাতে পৃথিবী যার জন্য প্রতীক্ষারত, যে শক্তিমানকে দর্শন করবার জন্য বধূর সাজে ঊষা নিজেকে সাজিয়ে তোলে- সেই পুরুষোত্তম কবির চোখে ধরা দিয়েছেন প্রেমিকরূপে। যার জন্য আপেক্ষমানা কবির সঙ্গীতের প্রেমিকা সত্তাটি তার ফুটে ওঠা ভীরু মনের কলিটিকে নিয়ে (“আকাশে ভোরের তারা মুখপানে চেয়ে থাকে”)। কিন্তু এই অপেক্ষা যে শুধুই চোখে আনে জল, প্রেমিকাকে করে তোলে অস্থির। তাই কবির সঙ্গীতের নায়িকা প্রেমিক দেবতাটির উদ্দেশ্যে দেহ-মন সর্বস্ত সমৰ্পণে প্রস্তুত ।

“ওগো ও শিল্পী গলাইয়া মোরে
গাড়িতে চাহ কোন মানস প্রতিমারে।
ওগো ও পূজারী কেন এ আরতি
জাগাতে পাষাণ প্রণয় দেবতারে।
এ দেহ ভৃঙ্গারে থাকে যদি মদ,
ওগো প্রেমাস্পদ পিও গো পিত্ত ।
চাহ যদি মোরে কর গো ন্দন
তপ্ত তনু তব শীতল করিও না ॥”

 

কবি নজরুলের গানে প্রেম ও পূজা

 

এমত নিবেদিতপ্রাণ প্রেমিকার প্রাণে জাগে শুধু রোদনের ঢেউ, দেহ-মনের সীমা ছাড়ায়ে তার আরাধ্য প্রেমিক তাকে নিয়ে যেতে চায় কোন সে প্রেমের রাজ্যে, কোন্ মধুবনেই বা শেষ হবে তার এই অভিসার যাত্রা সে জানে না (‘ওগো প্রিয়তম। এত প্রেম দিও না গো’)।

প্রেমিক কবি নজরুলের নায়িকা তার আরাধ্য প্রিয়ের অপেক্ষায় হতাশ হয়ে ‘আরতি দীপ নিভিয়ে নিয়ে ‘বাঁশিকে’ ‘ঘুম পাড়িয়ে’ জীবেনর ‘খেয়াঘাটে’ অপেক্ষমানা- যদি পারের মাঝি হয়েও সে ধরা দেয়- অন্তত জীবনে না হোক মরণোত্তর তো মিলন হবে জীবাহার সঙ্গে পরমাত্মার। কবির প্রেমিক সত্তার সঙ্গে মিলিত হতে জীবাত্মাকে জন্ম জন্মান্তরে- লোক লোকান্তরে শুধুই কেঁদে বেড়াতে হয়- সেই চোখের জলই কখনো আকাশে তারা, কখনো ফুল হয়ে প্রেমিকের পায়ে ঠাঁই পেতে চায় কিন্তু এ সাধ কি কোনো দিন মিটবে?- কবির জীবাত্মা কি সত্য মিলিত হতে পারবে তার আরাধ্য দেবতার সঙ্গে’ (আরো কত দিন বাকি”)

কবি নজরুল ইসলাম তাঁর সৃষ্ট প্রেমকে কখনো ব্যর্থ করেননি। কারণ প্রেম যখন তাঁর উপলব্ধিতে হয়ে উঠেছে সাধনারই নামান্তর, তখন যে কোনো জন্মেই হোক তিনি মিলিত হবেন সেই পরম সত্তার সঙ্গে-

“তবু জানি হে স্বামী
কোনো সে লোকে আমি
তোমারে পাব’ বুকে বাহুতে বাঁধিব।”
(‘জনম জনম তব তরে কাঁদিব’)

 

google news logo

 

কবির আরাধ্য প্রেমিক দেবতাটি কখনো বা পরম ঐশ্বর্যশালী। তাই সেই দূরের আকাঙ্ক্ষিত আরাধ্যকে দুর থেকে প্রণাম করে শ্রদ্ধা জানানোতেই বোধ হয় জীবাবার সম্বষ্টি। দূর থেকে যতটুকুই আরধ্যের স্পর্শ সে অনুভব করে, তাতেই সে খুশি। একমাত্র কামনা,- “সন্ধ্যাবেলায় ঝরি যেন/ তোমার পায়ে নয়ন রেখে।” আরাধ্যের রূপ দর্শনে জীবাত্মার যে আর্তি- তা যেন ব্যর্থ না হয়, সে সাধ্যটুকু যেন মেটে। বৈষ্ণবীয় লীলা দর্শন তত্ত্বেরই প্রকাশ যেন গানটিতে (“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়”)। আবার এরই পিরীত ভাবেকবি রচনা করেন গানটি “যখন আমার গান ফুরাবে তখন এসে ফিরে”।

জীবন শেষে মিলিত হতে চান পরমাত্মা প্রেমিক সত্তার সঙ্গে একটা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এখানে প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করছে। কবি তাঁর সত্তাকে অর্পণ করেছেন বিধাতা পুরুষের চরণে। তাঁর চরণে মৃত্যুও শ্রেয়। কারণ প্রেমের পরিণতি যদি জীবনে না ঘটে, তবে মরণেও তা বরণযোগ্য। তাই আসন্ন মৃত্যুর ব্যথার মাঝেও কণ্ঠে জাগে অপূর্ব সুরের জোয়ার- এ যেন পরম প্রাপ্তি, আরাধ্যের সান্নিধ্য লাভ, অমৃতের স্বাদ। মরণ ধরা দিয়েছে “শ্যাম সমান” হয়ে (‘গানগুলি মোর আহত পাখির সম”)

বাস্তবের ব্যর্থ প্রেম ও ছলনার যে বিষাক্ত স্মৃতি কবির স্মৃতিপটে ক্ষণে ক্ষণে রক্তক্ষরণ ঘটায়, সেই স্তর থেকে তাঁর প্রেমসঙ্গীত উন্নীত হয়েছে এমন এক স্তরে, যেখানে তিনি, “আপনার চেয়ে আপন” জনকে খোঁজেন আপন সত্তারই মাঝে বাস্তব জগৎ সেখানে অর্থহীন।

ভাবসম্মিলনের এই অপূর্ব মহিমায় প্রেমাস্পদ ও পরমাত্মা মিলেমিশে হয়েছেন একাকার যাঁর অস্তিত্ব একমাত্র কবির হৃদয়ে- যাঁকে ভালোবেসে মালা পরালে সে মালা দোলে কবিরই (আরাধ্যেরই) গলায়। প্রেমের এই অপূর্ব মহিমা কি বাস্তবে মেলে। এ তো স্বর্গীয় সুখ, যেখানে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটেছে কবি কাজী নজরুলের সঙ্গীতে, তাঁর বোধে (“আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়”)।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment