নজরুলের গানে ও কবিতায় “শব্দশ্লেষ” অলঙ্কার । নজরুলের ভাবনা

নজরুলের গানে ও কবিতায় “শব্দশ্লেষ” অলঙ্কার  : কোন কোন সময় কবিরা কিছু কিছু শব্দকে একাধিক অর্থে প্রয়োগ করেন। পাঠকরাও এই শব্দগুলিকে একাধিক অর্থে গ্রহণ করবেন এটাই কবিদের প্রত্যাশা ইহাকে শব্দশ্লেষ বলে।

 

নজরুলের গানে ও কবিতায় “শব্দশ্লেষ” অলঙ্কার

 

নজরুলের গানে ও কবিতায় “শব্দশ্লেষ” অলঙ্কার । নজরুলের ভাবনা

 

শব্দশ্লেষ অলঙ্কার দু প্রকার সভঙ্গ শব্দশ্লেষ এবং অভঙ্গ শব্দশ্লেষ। শব্দকে ভেঙে একাধিক অর্থ পাওয়া গেলে তাকে সভঙ্গ শব্দশ্লেষ অলঙ্কার বলে আর শব্দকে না ভেঙে একাধিক অর্থ পাওয়া গেলে তাকে অভঙ্গ শব্দশ্লেষ বলে। নজরুলের কাব্য ও সঙ্গীতে সভঙ্গ শব্দশ্লেষের ব্যবহার এতটা দেখা যায় না। কিন্তু অভঙ্গ শব্দশ্লেষের ব্যবহার অনেক বেশী দেখা যায়।

অভঙ্গ শব্দশ্লেষ

শব্দকে না ভেঙে যদি একাধিক অর্থ হয়,-

অভঙ্গ শব্দশ্লেষ জানিবে নিশ্চয়।- মধুসূদন বসু

(১) মাটির ঢিবিতে দুদিন বসিয়া

রাজা সেজে করে পেষণ কষিয়া-

এ পেষণে তারি আসন ধসিয়া রচিছে গোরস্থান। (ফরিয়াদ)

এখানে ‘রাজা’ শব্দটির দুইটি অর্থ- (১) পরাধীনতার আমলে ভারতের উৎপীড়নকারী বিদেশী শাসক, (২) উৎপীড়নকারী মানুষ।

 

নজরুলের গানে ও কবিতায় “শব্দশ্লেষ” অলঙ্কার

 

(২) পরোয়া করি না বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে, মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।

(আমার কৈফিয়ৎ) এখানে ‘রবি’ শব্দটির দুইটি অর্থ- (১) রবীন্দ্রনাথ (২) সূর্য।

(৩) ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর।

উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার। (কাণ্ডারী হুঁশিয়ার) পলাশী-প্রান্তরে সিরাজের ভাগ্য বিপর্যয়ে দেশের স্বাধীনতা নাশের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে নজরুল এই দুইটি ছত্র রচনা করেছেন। এখানে ‘দিবাকর’, ‘রবি’ ও ‘খুনে’ শব্দ তিনটির দুইটি অর্থ। ‘রবি’ ও ‘দিবাকর’ শব্দ-দুইটির দুইটি অর্থ- (১) সূর্য, (২) স্বাধীনতা। ‘খুনে’ শব্দটির দুইটি অর্থ- (১) রক্তে; (২) দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারের দ্বারা।

(৪) যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে। (কুলি-মজুর)

এখানে ‘দধীচি’ শব্দটির দুইটি অর্থ- (১) পুরাণে দেবতাদের কল্যাণে আত্মবিসর্জনকারী দধীচি মুনি, (২) মানব কল্যাণে ত্যাগ স্বীকারকারী শ্রমিক।

 

নজরুলের গানে ও কবিতায় “শব্দশ্লেষ” অলঙ্কার

 

(৫) অনেক দধাটি হাড় দিল ভাই দানব-দৈত্য তবু মরে নাই। (সব্যসাচী) ‘দধীচি’ শব্দটির এখানে দুইটি অর্থ- (১) পুরাণের ত্যাগ-স্বীকারকারী দধীচি মুনি;

(৬) মানুষের কল্যণে ত্যাগ স্বীকারকারী মানুষ।

“দানব-দৈত্য” শব্দটিরও এখানে দুইটি অর্থ-

(১) পুরাণে বর্ণিত দানব-দৈত্য
(২) এ যুগে যারা মানুষের অকল্যাণে ব্যাপৃত।

(৭) কেন দুর্বলেরে করে প্রবল নির্যাতন? এ সুন্দর বসুন্ধরা রাক্ষস আর দৈত্য- ভরা। (চির-বিদ্রোহী, শেষ সওগাত) ‘রাক্ষস’ ও ‘দৈত্য’ শব্দদ্বয়ের দুইটি অর্থ-

(১) পুরাণে বর্ণিত রাক্ষ ও দৈত্য,

(৮) এ যুগের নির্যাতনকারী মানুষ।

(৯) প্রার্থনা করো- যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ। (আমার কৈফিয়ৎ) এখানে ‘রক্ত’ শব্দটির দুইট অর্থ- (১) শোণিত; (২) বিদ্রোহ-ভাবপূর্ণ (লেখনীর বিশ্লেষণ)।

 

google news logo

 

(১০) ঝরলো যে ফুল ফোটার আগেই তারি তরে কাঁদি হায়। (অখণ্ড নজরুল গীতি) এখানে ‘ফুল’ শব্দটির দুইটি অর্থ- (১) পুষ্প; (২) অল্প বয়সে মৃত্যু হয়েছে এমন শিশু বা কিশোর-বয়স্ক মানুষ ।

(১১) গোলাপ হয়ে কাঁদে তাহারি কামনা উদাস প্রাতে। (বুলবুল) এখানে ‘গোলাপ’ শব্দটির দুইটি অর্থ- (১) ফুলের নাম; (২) সুন্দর।

(১২) তারে স্বর্গের আছে প্রয়োজন যারে ভালবাসে মাটি। (ইন্দ্র-পতন) দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে ব্যথিত হয়ে লেখা ‘ইন্দ্র-পতন’ কবিতার এই ছত্রে ‘মাটি’ শব্দটির দুইটি অর্থ- (১) মৃত্তিকা; (২) পৃথিবী ।

(১৩) বন্ধু গো আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে। (আমার কৈফিয়ৎ) ‘বিষ-জালা’ শব্দটির দুইটি অর্থ- (১) বিষপানের ন্যায় জ্বালা; (২) মানুষকে লাঞ্ছিত হতে দেখে তীব্র বেদনা-বোধ।

নজরুলের গানে ও কবিতায়

(১৪) কংস-কারায় কংস-হস্তা জন্মিছে অনাগত । (সব্যসাচী) এখানে ‘কংস-কারা’ ও ‘কংস-হস্তা’ শব্দ-দুইটির অর্থ ‘কংস-কারা’ শব্দের দুইটি অর্থ- (১) পুরাণে বর্ণিত কংসের কারাগার; (২) কংসের কারাগার তুলা পরাধীনতার আমলের ভারতবর্ষ।

‘কংস-হস্তা’ শব্দের দুইটি অর্থ- (১) কংসের বিনাশকারী শ্রীকৃষ্ণ; (২) পরাধীনতার আমলের শাসকদের শাসনের অবসানে সক্ষম অসাধারণ বীর।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment