নজরুলের উদ্দীপনামূলক গানঃ নজরুল রচিত সঙ্গীতের পর্যায়গুলোর মধ্যে উদ্দীপনামূলক গান অন্যতম। উদ্দীপনামূলক গান রচনার মূল প্রেক্ষাপট পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের মুক্ত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। অসুন্দরকে পরিহার করে সুন্দর ও সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্যে দেশমাতৃকার মুক্তির প্রশ্নে নজরুলের সার্থক রচনা তার উদ্দীপনামূলক গান।
নজরুলের উদ্দীপনামূলক গান । নজরুলের ভাবনা
আমি নজরুলের উদ্দীপনামূলক গান রচনার প্রেক্ষাপট, উৎস, শ্রেণী সংগ্রামের বাণী, গঠন প্রণালী, থাকা সমন্বয় সাঙ্গীতিক বিন্যাস উপস্থাপন করবার চেষ্টা করেছি মাত্র।
সংজ্ঞা :
উদ্দীপনামূলক গান মূলত বাণী প্রধান, যেখানে সুর লঘু প্রকৃতির অর্থাৎ যে গান পরাধীনতার বিরুদ্ধে মুক্তির শ্লোগান তথা, দেশমাতৃকার মুক্তির কথা বলে। যে গান উদ্দীপিত করে তোলে সকল শ্রেণীর মানুষকে তাকে উদ্দীপনামূলক গান বলে।
রচনার প্রেক্ষাপট:
১৮৯৯ সালে পরাধীন ভারতবর্ষে নজরুলের জন্ম। শৈশব থেকেই নজরুলের মধ্যে বিদ্রোহ মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ে রাজরোষের বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন প্রতিবাদ মুখর। এই বিদ্রোহী মনোভাবটির বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে কাব্য ও সঙ্গীতের মাধ্যমে।
তৎকালীণ সময়ের ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব :
বঙ্গভঙ্গের পর ব্রিটিশ শাসনের যে অবকাঠামো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছিল তা তৎকালীণ সময়ে বিভিন্ন কবির লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছিল। যার মধ্যে নজরুল সবার শীর্ষে। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে যে মুক্তি ঘটবেই তা নজরুল দিব্য দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। শাসন-শোষন যত বড়ই হোক না কেন সময়ের বিবর্তনে তার প্রস্থান ঘটবেই। তাই তো নজরুলের অগ্নীশ্রাবি বাণী “বিদ্রোহের মতো বিদ্রোহ যদি করতে পার, প্রলয় যদি আনতে পার তা হলে নিদ্রিত শীর জাগবেই এবং মুক্তি ঘটবেই।”
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা :
১৯১৭ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত করাচিতে থাকার সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক ঘটনা তাকে তরান্বিত করেছিল। কলকাতায় ফিরে চিত্তরঞ্জন नान মহাশয়ের সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে। চিত্তরঞ্জন বাবু তখন “বাংলার কথা” পত্রিকার সম্পাদক।
আমন্ত্রিত হয়ে নজরুল ‘বাংলা কথা’ পত্রিকার জন্যে লেখায় মনোনিবেশ করেন। যা ১৯২২ সালের ২০ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়। সমসাময়িক রচয়িতাদের মধ্যে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে সুরেষ বসু, মোজাফফর আহমেদ, এম. এম বছির হোসেন প্রমুখ।
‘বাংলার কথা’ পত্রিকায় লেখার কারণে নজরুল ব্রিটিশ প্রশাসনের নজরে চলে আসেন। তার সমসাময়িক যারা বিদ্রোহী মূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন তাদের ক্ষেত্রেও ঠিক প্রশাসন একই ধরনের আচরণ করেছিলেন। শুধু সমন্বয়ের কারণে এই কয়েকজন কবি কঠিন প্রাচীর ভেদ করেও তাদের লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন।
নজরুলের উদ্দীপনামূলক গানের সাঙ্গিতিক রূপ :
ক) বাণী :
নজরুলের উদ্দীপনামূলক গান মূলত বাণী প্রধান। বাণীর মাধ্যমেই বিদ্রোহমূলক উদ্দীপনা ভাবটি সম্প্রভাবে ফুটে উঠেছে।
খ) শব্দ ও বাক্য সমন্বয় :
গান রচনার গঠনগত প্রক্রিয়ার সব পর্যায় একই। প্রথমত, শব্দ এবং পরে শব্দ সমন্বয়ে বাক্য, এটাই নিয়মতান্ত্রিক। নজরুল তার রচনার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুর সংযোজন করার পর কখনও শব্দ ও বাক্য পরিবর্তন করেছেন।
গ) সুরের আঙ্গীক বিশ্লেষণ :
(১) জয় হোক জয় হোক, তাল কাহারবা
(২) সংঘ সরনতীর্থ যাত্রা/দাদরা
(ঘ) রাগ-রাগীনীর ব্যবহার
কোনো রাগ-রাগিনীর ব্যবহার এতটা দেখা যায় না।
(ঙ) তাল প্রসঙ্গ
নজরুলের উদ্দীপনামূলক গানে যে-সকল তালের প্রয়োগ দেখা যায়। তা হলো কাহারবা, দাদরা তেওড়া ইত্যাদি।
(চ) অবয়ব প্রসঙ্গ –
লঘু সঙ্গীত হিসেবে অবয়ব লঘু প্রকৃতির। যাতে রয়েছে স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী, অভোগ এবং স্থায়ী ও একাধিক অন্তরার সমন্বয় দেখা যায় ।
নজরুলের উদ্দীপনামূলক গানের সান্নিতিক মূল্যায়নঃ
সাঙ্গীতিক উপকরণে নজরুলের উদ্দীপনামূলক গান পরিপূর্ণতা পেয়েছে। সৃষ্টিশীল প্রতিভার ক্ষেত্রে নজরুল যা দিয়ে গেছেন মূল্যবোধের দৃষ্টিতে তা সার্থকতা পেয়েছে বাংলা সঙ্গীত সম্ভারে।
নারী জাগরণের গান
নারী জাগরণের গান নজরুলের সঙ্গীত রচনায় একটি অন্যতম দিক। যা নজরুলের পূর্বে এটতা দেখা যায়নি। নজরুলের এই সঙ্গীতের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের মুক্তির ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
উপসংহার :
উপরে উল্লেখিত আলোচনায় আমরা একটি স্থানে মিলিত হয়েছি যে, নজরুলের উদ্দীপনামূলক গান নজরুলসঙ্গীতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পরাধীন ভারতের মুক্তিকামী মানুষকে একটি বিন্দুতে একত্রিত করবার জন্যে নজরুল ইসলাম চেষ্টা করেছিলেন। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তার উদ্দীপনমূলক গানে এবং স্বাধীনতা পেয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশে।
আরও দেখুনঃ