নজরুলসঙ্গীত ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত : শাস্ত্রীয় সঙ্গীত রীতির পরিশীলিত ধারা ও রাগ-সুরের সামগ্রিক আদর্শে রচিত নজরুলসঙ্গীত আমাদের বাংলাগানের ভাণ্ডারকে যেভাবে বৈচিত্র্য সুরৈশ্বর্য, স্বকীয় গায়কী স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্টপূর্ণ সাঙ্গীতিক শ্রেণীবদ্ধ কাব্য সুষমায় সমৃদ্ধ করেছে, সংখ্যাধিক্যের মানদণ্ডে আজো তা বিশ্বের শীর্ষস্থানটি দখল করে আছে।
নজরুলসঙ্গীত ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত । নজরুলের ভাবনা
প্রাসঙ্গিকতার আলোকে নজরুলসঙ্গীতের সুর বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শ্রেণীগত তত্ত্বীয় আলোচনায় হওয়া সমীচীন, বিশেষ করে রাগভিত্তিক গানের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি যথেষ্ট অর্থবহ। তা ছাড়া নজরুলসঙ্গীত মূলতই রাগসঙ্গীতোপম এবং নজরুলও ছিলেন রাগসঙ্গীতানুরাগী।
কাজী নজরুল ইসলাম তার সঙ্গীতের বৈচিত্র্যসাধনের জন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিশীলিত ধারার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারাবাহিকতায় নজরুলের বৈচিত্র্য সঙ্গীত রচনা নজরুলসঙ্গীত, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তথা বাংলাগানের ভাণ্ডারকে অধিক সমৃদ্ধ করেছেন। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ চিনু লাহিড়ীর মন্তব্য:
“রাগ প্রধান সম্পর্কে বলতে গেলে গোড়ার থেকেই বলতে হয়। আমার যতদূর জানা আছে, এ বিষয়ে সৃষ্টিকর্তা হলেন শ্রদ্ধেয় কাজী নজরুল ইসলাম। সম্প্রতি এর চলন একটু বেড়েছে বটে কিন্তু ৩০/৩৫ বছর আগেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারার বা রাগপ্রধান বলে কোনো গান কাউকে গাইতে আমি শুনিনি যখন কাজী দা এই রাগাশ্রিত গান তৈরি করে বাজারে ছাড়লেন, কিন্তু এ গানে তাল, সারেগাম কেন, এমনকি বোল বিস্তার বা বোলতান পর্যন্ত ব্যবহার করেননি; শুধুই রাগের কাঠামোর উপরই গান শিখিয়েছেন। এতেই প্রমাণিক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারাবাহিকতায় কাজী নজরুলের গান এক দৃষ্টান্ত ।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিশীলি ধারা ও নজরুলসঙ্গীতঃ
১. ধ্রুপদ পর্যায়ের গান। রাগসঙ্গীতের মধ্যে ধ্রুপদ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, আদি ও শ্রেষ্ঠ। ধ্রুপদ এক প্রকার গায়নরীতি। এই গায়নরীতিতে রাগের বিশুদ্ধতা সবসময় মান্য হয়ে থাকে। কাজী নজরুল ইসলাম সঙ্গীত রচনায় ধ্রুপদের আঙ্গিকে বেশ কিছু গান রচনা করেছেন। তাঁর সঙ্গীতভাণ্ডার সংখ্যাধিক্যে বিশ্বজোড়া হলেও দ্রুপদ আঙ্গিকের গান মাত্র কয়েকটি। ফলে রাগও সুরের প্রথাবদ্ধ ও কাঠামোগত সুর-ঝংকার এবং বিপুল কারুকাজ সম্বলিত সুর ব্যাঞ্জনার তৃষ্ণা তাতে পরিমিত। এখানেই নজরুলের সাথে অন্যদের পার্থক্য।
নজরুলের রচনায় তাই ধ্রুপদের আঙ্গিক স্থায়ী হয়নি। কারণ নজরুল কাব্যের ভাব ব্যঞ্জনার চেয়ে সুরের রূপব্যঞ্জনার প্রতি ছিলেন যত্নশীল। তাঁর গানে রাগসুরের আর্বিভাব তিরোভাব পরমেল প্রবেশক, আগুন্তক, বিবাদীসুর, গ্রহস্বর ন্যাসম্বর ইত্যাদি প্রথাবদ্ধ ও কাঠামোগত ক্রিয়াদি রাগের সমগ্রতায় রূপবিন্যাস খুবই বৈশিষ্টপূর্ণ।
নজরুলের ধ্রুপদাঙ্গের গান বাংলা ভাষাতেই রচিত। নজরুলের ধ্রুপাদাঙ্গের গানে আলাপ অংশ সংযোজিত হয়েছে কিন্তু সেই আলাপ নোম, তোম, ইত্যাদি অর্থবিহীন শব্দ ব্যতিরেকে কেবল ‘আ’ দিয়ে গীত হয়। নজরুলসঙ্গীতে ধ্রুপদ গানের কথা ভাগে হিন্দুদেবদেবীর উপাখ্যান বেশি স্থান পেয়েছে। কাব্যে ভর্তিভাব, গুনকীর্তন, স্তুতি পাঠ, প্রকৃতির বর্ণনাও স্থান পেয়েছে। ভাল হিসাবে ঝাঁপতাল ও সুরফাঁক বেশি স্থান পেয়েছে।
ধ্রুপদের মতো নজরুলের ধ্রুপদাঙ্গের গানেও ৪টি তুক আছে। ধ্রুপদের গীতাংশ তালসহযোগে দ্বিগুন, তিনগুন, চৌগুন ইত্যাদি লয়কারি ক্রিয়াদি পরিবেশিত হয়ে থাকে; নজরুলের এরূপ গানে ঐ সকল ক্রিয়াদি পরিলক্ষিত হয় । তবে গীতাংশে স্বরসঙ্গতির মাধ্যেমে বোল বিস্তার বা স্বর বিস্তার লক্ষ করা যায় না এবং রাগে শুদ্ধতাও পরিলক্ষিত হয়। নজরুলের গানে ধ্রুপদের অবস্থান এতটা ব্যাপ্তি লাভ না করলেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারাবাহিকতায় নজরুলের ধ্রুপদ অংগের গান একটি অধ্যয়।
উদাহরণ : গগনে পবনে আজি ছাড়িয়ে গেছে রং-
রেকর্ড নং এফ টি – ৩০৮৩।
রেকর্ড প্রকাশকাল এপ্রিল ১৯৩৪ ।
রাগ-মিশ্রকাফি।
শিল্পী উষারাণী।
এ গানটি সাদ্রা । সাদ্রা ধ্রুপদের থেকে লঘু প্রকৃতির এবং ঝাঁপতালে নিবন্ধ হয়ে থাকে। এ গানটিও ঝাঁপতালে গীত হয়ে থাকে। বিষয়বস্তুগতভাবে গানটি হোরি।
কিন্তু গায়কীমূলে গানটি ধ্রুপদাঙ্গের লঘু প্রকৃতির সাদ্রা গান । খামার ধামার নজরুলের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিশিলিত ধারার দ্বিতীয় পর্যায়। নজরুল তার গানের বৈচিত্র্য সাধনের জন্য ধামার রচনাও তিনি বাদ দেননি। যদিও অন্যান্য পর্যায়ের গানের তুলনায় এর পরিধি বেশ ছোটপ্রকৃতির। তবুও তার গানের বৈচিত্র্যতা ও ধারাবাহিকতা ধামার গীতি শৈলির মতোই শাস্ত্রীয়।
যেমনঃ দোলে ঝুলন দোলায়।
তালঃ ধামার।
খেয়ালঃ খেয়াল শব্দটি পারসিক। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কল্পনা বা মনের স্বাধীন চিন্তাকুতি, যার মধ্যে কল্পনাশ্রয়ী সৃষ্টি ও বিকাশ তাই খেয়াল। নজরুলের খেয়াল অঙ্গের গানে ব্যাপকতা সৃষ্টি করেছেন। মধ্যযুগের প্রারম্ভে ধ্রুপদের নিয়মাবলী লঙ্ঘন করে নানাবিধ অলঙ্কাররীতি সহযোগে খেয়াল গাওয়ার প্রচলন শুরু হয়।
বিভিন্ন সঙ্গীতগুণীর মতামতঃ
নারায়ণ চৌধুরীর মতামত, “নজরুল বাংলা খেয়াল ও রাগপ্রধান এই দুই বর্গের গানই বহুসংখ্যায় লিখেছিলেন। রাগপ্রধান গানের সংখ্যাই বেশি। বাংলা খেয়াল আর রাগ প্রধান গানের গঠনে কতকগুলি সাদৃশ্য থাকলে বৈসাদৃশ্যও একাধিক আছে। এ দুটি গীত শ্রেণীকে এক কোঠায় ফেলা চলে না”।
বাংলা গানের প্রধান অবলম্বন হলো কথার ভাব ও ভাষার অবিকৃতি রূপ। এসব কথা বিবেচনা করলে নজরুলের খেয়াল অঙ্গের গানগুলি একপ্রকার কাব্যগুনসম্পন্ন সঙ্গীত। কারণ নজরুলের এই প্রকৃতির গানগুলি খেয়াল রীতির হলেও তা কাব্যবিবর্জিত নয়। নজরুলের রচিত বাংলাখেয়াল দুটি ভাগে বিভক্ত: প্রথমটি হিন্দি ভাঙা খেয়াল এবং দ্বিতীয়টি মূল হিন্দী খেয়ালের আদলে রচিত বাংলা খেয়াল।
নজরুলের রাগের অখণ্ড রূপ প্রকাশে যত্নবান ছিলেন। তিনি কখনো তাঁর গানে রাগের খণ্ডিত রূপকে টেনে আনেননি। যেমনটি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ঘটেছে। রাগের সামগ্রীকতায় ছিলেন নজরুলের অবস্থান। তাই তাঁর গানে আমরা একটি রাগের সামগ্রিক রূপায়নের চিত্র খুঁজে পাই। এটি নজরুলসঙ্গীতের একটি স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য। নজরুলের খেয়াল অঙ্গের গান মূলত শিল্পীর গায়কী শুনেই বিশেষ সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। তাই এ ধরনের গান বিশেষ কণ্ঠ শৈলীরও দাবী করে। একমাত্র তৈরি ও বেয়াজি কণ্ঠ ব্যতীত এ ধরনের গান পরিবেশন করা উচিত নয়। নিম্নে একটি গানের পরিচয় দেয়া হলোঃ
এসো প্রিয় আরো কাছেঃ রাগ- দেশী
সুরকার – কাজী নজরুল
শিল্পী প্রফেসর আন গোস্বামী
রেকর্ড নং এন ২৭০৬৩।
প্রকাশকাল- ১৯৪০ সাল
টপ্পা অঙ্গের গান :
টপ্পা হিন্দী শব্দ। এর আদি অর্থ ‘লঞ্চ’ এ থেকে রুঢ়ার্থ সংক্ষেপণ। ঐতিহাসিকদের মতে, পাঞ্জাবের ঝাড়া অঞ্চলের উটচালকের মধ্যে প্রচলিত গানের সুরভঙ্গিই টপ্পার সুরের ভিত্তি প্রবর্তিত হয়। বাংলা রাগসঙ্গীতের উৎকর্ষসাধানে ৪র্থ ব্যক্তিত্ব হিসাবে হরিনারায়ণ গুপ্তের পুত্র রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবুর (১৭৪১-১৮৩৯ খ্রিঃ) আবির্ভাব ঘটে। সেই বাংলা টপ্পা কাজী নজরুল কর্তৃক আরো একধাপ উৎকর্ষ সাধিত হয়।
মুষ্টিমেয় কয়েকটি গান নজরুল রচনা করেছেন। নজরুলের টপ্পা অঙ্গের রাগপ্রধান গানগুলো স্বতন্ত্র গায়কী বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত করা যায়। নজরুলের টপ্পা অঙ্গের গানের মধ্যে প্রেম-ভিত্তিক ও ভক্তি-ভারসংযুক্ত বাণীর উপস্থিতি সুস্পষ্ট। তবে নজরুল টপ্পার মধ্য বেশিদিন থেমে থাকেনি। টপ্পার গায়ন রীতিতে যে গিটকারীযুক্ত সুর একইভাবের উদ্রেক ঘটায় সম্ভবত এ কারণেই সুরের একই ব্যঞ্জনাময় রূপ প্রকাশে কোনো নতুনত্ব থাকায় নজরুলের বিশাল সঙ্গীত ভাণ্ডারে টপ্পা প্রাধান্য পেয়েছে।
টপ্পা অঙ্গের গান
“গানগুলি মোর আহত পাখির সম”
শিল্পী- আঙ্গুর বালা রাগ- ভৈরবী, তাল-দাদরা, রেকর্ড প্রকাশকাল- ১৯৩২ রেকর্ড নং- পি. ১১৭৪৭।
এ গানটি নজরুলের টপ্পা অঙ্গের রাগপ্রধান গান। এ গানটির চারটি রেকর্ড বলে প্রামাণিক।
১. রেকর্ড নং- পি- ১১৭৪৭- শিল্পী আঙ্গুরবালা-প্রকাশ ১৯৩২ ।
২. রেকর্ড নং – এফ টি – ৩৩৩৫ – শিল্পী : আঙ্গুরবালা প্রকাশ ১৯৩৪
৩. রেকর্ড নং – ১৭৪৯২- শিল্পী বীনা চৌধুরী- প্রকাশ ১৯৪০।
প্রথম রেকর্ডটি যে সময়কালে প্রকাশিত হয় সে সময় নজরুলের গানের সুর বিকৃতির কোনো অবকাশ ছিল না।
দ্বিতীয় রেকর্ডটি আজও প্রকাশ হয়েছে কিনা তার কোনো প্রামাণ্য তথ্য আজও পাওয়া যায়নি।
তৃতীয় রেকর্ডটির প্রকাশকাল হিসাবে সে সময় নজরুলসঙ্গীতের সুর অন্য সুরকার দ্বারা বিকৃত হয়েছে যথেষ্ট। এই রেকর্ডটির গানের সুরকার শৈলেশ দত্তগুপ্ত। ৪র্থ রেকর্ডটির প্রকাশকাল আরো অনেক পরে। এই রেকর্ডটি গায়ে “NOT FOR SALE” কথাটি লেখা আছে। অর্থাৎ সম্ভবত ৩টি বাতিল।
আরও দেখুনঃ