বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুলের ব্যতিক্রমধর্মী অবদান । নজরুলের ভাবনা 

বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুলের ব্যতিক্রমধর্মী অবদান : বাংলা গানকে সুন্দরভাবে অলংকৃত করেছে কাজী নজরুলের গান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমসাময়িক রচয়িতাদের মতোই এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমধর্মী পদচারণা নজরুলের গানের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি পর্যায় বেড়েছে বাংলা গানের ।

 

বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুলের ব্যতিক্রমধর্মী অবদান

 

বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুলের ব্যতিক্রমধর্মী অবদান । নজরুলের ভাবনা 

সকল শ্রেণীর শ্রোতাদের সাঙ্গীতিক অনুভূতিকে কাজে লাগাতে নজরুল সমর্থ হন। আমরা নজরুলের ব্যতিক্রমধর্মী রচনা কিছুটা হলেও উপস্থাপন করবার চেষ্টা করব।

গজল

প্রেমসঙ্গীতের মধ্যে গজল গানে নজরুল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি তার গানগুলিতে আরবি ও ফারসি শব্দ ব্যাপকভাবে ও সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন। নজরুলের আগে অতুল প্রসাদ সেন কর্তৃক গজল গান রচিত হয়েছে। নজরুলই প্রথম সার্থকভাবে পারস্য গজলের সুরটিকে বাংলা গানের কাঠামোতে ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর জনপ্রিয় গজল হচ্ছে। (১) “বাগিচায় বুলবুলি তুই” (২) “আমারে চোখ ইশারায়।

লোকসঙ্গীত

বাংলা লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে নজরুলের অবদান সুদূরপ্রসারী। সুরের বৈচিত্র্য সাধনের জন্য নজরুল লোকসঙ্গীত থেকে সুর সংগ্রহ করতে দ্বিধা করেননি। নজরুলসঙ্গীতে বাংলা লোকসঙ্গীতের মধ্যে ঝুমর, সাঁওতালি, বাউল, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, কীর্তন, ভজন, কাজরী ইত্যাদি এবং উত্তর ভারতীয় লোকসঙ্গীতের মধ্যে গজল, কাওয়ালী, বিহারী প্রভৃতি সঙ্গীতগুলির সুর, তিনি সমানভাবে নিজের গানে ব্যবহার করেছেন। যেমন : কাণ্ডারিগো কর কর পার ।

 

বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুলের ব্যতিক্রমধর্মী অবদান

 

কীর্তন :

বাংলা গানের ধারায় নজরুলের আরেকটি ব্যতিক্রমধর্মী অদান কীর্তন। নজরুলের কীর্তন পর্যায়ের গান বাংলা কীর্তন তথা বাংলা গানকে অনেকাংশে আলোকিত করেছে। নজরুল সৃষ্ট কীর্তনের গায়কী তথা সুর বৈচিত্র্য পঞ্চ-গীতি কবির গানের বৈশিষ্ট্যকে বাংলা গানের ধারায় সার্থকতা প্রদান করেছে। যেমন- “আমি কি সুখে লো গৃহে।

হিন্দি গান

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভাষাগত অবস্থান মূলত হিন্দি। এছাড়াও ব্রজবুলি, উর্দু প্রভৃতি ভাষার সংমিশ্রণ দেখা যায়। নজরুলের বিশাল সঙ্গীত ভাণ্ডারে হিন্দি ভাষার সংমিশ্রন নজরুলের গানের ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য বহন করে আছে। যা বাংলা গানে নজরুলের ব্যতিক্রমধর্মী অবদান হিসেবে স্বীকৃত।

জারি গান

গানগুলির মধ্যে সুস্পষ্টরূপে দুটি বিশেষ ধারার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথম ক্ষেত্র নজরুল নানারূপ অসামাজিক প্রথা, এদেশীয় রাজনৈতিক এবং কপট দেশাত্মবোধকে আক্রমণ করে তীব্র শ্লেষাত্মক ব্যঙ্গ প্রধান গান রচনা করেছেন। দ্বিতীয় ধারায় নজরুল প্রধানত মানবিক প্রেম ও ধর্ম সম্মধীয় লঘু হাস্যরসের অবতারণা করেছেন। তার ব্যঙ্গগীতি, “বেয়াই আলাপের যে ফুরসৎ নাই”।

ছাত্রদলের গান

মারুল রচনায় এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তিনি বিরচন করেননি। তার রচিত শ্লোগান, উদ্দীপক শক্তি, কাব্য ও সঙ্গীতের মাধ্যমে বাহ্যিক প্রকাশ লাভ করে। এই প্রকাশ ধর্মীতাই বিভিন্ন পর্যায়ের গান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তার একটি উপজীব্য বিষয় ছাত্রদলের গান।

 

বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুলের ব্যতিক্রমধর্মী অবদান

 

শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিভক্তিকরণে তার অবদান

রাগ প্রধান গান নজরুল রচিত সঙ্গীতের মধ্যে একটি অন্যতম পর্যায়। রাগমিশ্রিত কাব্যগীতিকেই নজরুলের ভাষায় রাগ প্রধান গান বলা হয়। যার বাণী অংশের চেয়ে সুরবিন্যাস বেশি মহত্বপূর্ণ। নজরুলের ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, টপ্পা পর্যায়ের গান শাস্ত্রীয় শ্রোতাদের প্রাণবন্ত করেছে। যা সমসাময়িক অন্য কোন রচয়িতা করে যেতে পারেনি।

গণসঙ্গীত :

গণসঙ্গীত হলো মূলত নিপিড়ীত মানুষের জীবনীশক্তির প্রসঙ্গ কথা। যার মূলে আছে গণচেতনা, বেঁচে থাকার কথা, মানব মুক্তির কথা, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি বিষয়। রচনার পরিধি খুব কম হলেও নজরুল গণসঙ্গীত রচনা করেছেন। নজরুলের গণসঙ্গীতের মধ্যে ২টি দর্শন স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান। যেমন

(১) মানুষের মুক্তি এবং (২) পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ।

নারী জাগরণের গান :

নারী জাগরণের গান নজরুলের সঙ্গীত রচনায় একটি অন্যতম দিক। যা নজরুলের পূর্বে এতটা দেখা যায়নি। নজরুলের এই সঙ্গীতের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের মুক্তির ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। যেমন : “জাগো নারী জাগো”।

বাণী চিত্রের গান :

বাণী চিত্রের গান রচনা করবার ক্ষেত্রে অনেকেই নাম কিনেছেন। নজরুল রচিত বাণীচিত্রের গানের পরিধি এতটা বৃহৎ না হলেও নজরুলসঙ্গীতের ভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করবার জন্যে যথেষ্ট। নজরুল বাংলা ছবির সঙ্গীত পরিচালনা এবং কিছু ছবিতে অভিনয়ও করেছেন। যেমন “আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ।

 

বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুলের ব্যতিক্রমধর্মী অবদান

 

দেশী-বিদেশী ভাষার সংমিশ্রনে নজরুলসঙ্গীত :

নজরুল তাঁর গান তথা বাংলাগানের সমৃদ্ধির জন্য দেশী-বিদেশী ভাষার সংমিশ্রনে গানের একটি পর্যায় উপস্থাপন করেন। গানগুলিতে রাগনির্ভরতার কারনে লঘু হলেও যথেষ্ট নান্দনিকতা লাভ করেছে।

যেমন : আলগা করল খোঁপার বাঁধন।

ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নজরুলসঙ্গীতের আয়োজনঃ

নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবন ১৯২০ থেকে ১৯৪২ সালের জুলাই পর্যন্ত । ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর মোটামুটিভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের দানা বাঁধতে থাকে। ১৯১৭ সালে নজরুল ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে করাচী চলে যান। ২ বৎসর করাচীতে থাকাকালীন তার মধ্যে পরাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মনোভাব পরিপূর্ণভাবে স্থান পায়। ২ বৎসর পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। ক্রমান্বয়ে রচনা করতে থাকেন বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গীত। যার মধ্যে উদ্দীপনামূলক গান একটি স্থান দখল করে আছে। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে এই গানগুলো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। আহ্বান জানিয়েছিল সমগ্র ভারতবাসীকে একত্রিত করবার। যার ফলে অর্জিত হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা।

ছাদ পেটানোর গান

নজরুল সকল শ্রেণীর মানুষের তথা জনগণের কবি। তাই তিনি রচনা করে গেছেন। সবার জন্য বিভিন্ন ধরনের গান। তার একটি ধরন ছাদপেটানোর গান। শ্রমজীবি মানুষ তাদের দৈনন্দিন শ্রম দেবার সাথে সাথে সঙ্গীতের সমন্বয়টুকু যাতে গ্রহণ করতে পারেন। তার কিঞ্চিত হলেও নজরুল রচনা করে গেছেন। যেমন: “সারাদিন পিটি।

দেশি ও বিদেশী সুর সংগ্রহ

নজরুলের আর একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো বিদেশী সুর সংগ্রহ। মধ্য প্রাচ্যের অনেকগুলি দেশের বিভিন্ন সুর তিনি সংগ্রহ করেছেন। এবং হুবহু সেই সুরের ফ্রেমে বাংলা কথা বসিয়ে দিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ তুরস্কের লোকসঙ্গীতের সুরে “শুকনো পাতার নূপুর পায়ে” এবং ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ” আরবী লোকসঙ্গীতের অনুকরণে ‘চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়’ ইজেপসিয়ান নাচের সুরে ‘মোমের পুতুল মোমের দেশের মেয়ে” ইত্যাদি গান উল্লেখযোগ্য।

 

বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুলের ব্যতিক্রমধর্মী অবদান

 

নতুন রাগ সৃষ্টি ও তার সঠিক রূপায়ণ

ভারতীয় রাগ সঙ্গীতে নজরুলের যথেষ্ট দক্ষতা ছিল। তিনি জমীর উদ্দীন খাঁ সাহেবের কাছে নিয়মিত তালিমও নিয়েছেন। তাই দেখা যায় যে, নজরুলসঙ্গীতে ব্যাপকভাবে রাগের প্রভাব পড়েছে। শুদ্ধ রাগ নির্ভর গান ছাড়াও তিনি কয়েকটি নতুন রাগও সৃষ্টি করেছেন। তা ছাড়াও বিভিন্ন রাগের মধ্যে মিশ্রণ ঘটিয়েও তিনি সুরের বৈচিত্র্য সাধন করেছেন।

শ্যামা সঙ্গীত :

পর্যায় ভিত্তিক গান রচনার মধ্যে নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত একটি ভীন্ন গীতরীতির পরিচায়ক। কালী বিষয়ক ভক্তিমূলক গানকে শ্যামা সঙ্গীত বলে। শ্যামা সঙ্গীতের সুর কিছুটা রামপ্রসাদি গানের ভিত্তি যদিও। তবুও নজরুল সৃষ্ট শ্যামা সঙ্গীতের সুরের আঙ্গিক, গায়কী সবকিছু ভিন্নধর্মী যা বাংলা গানের ধারার একটি ভিন্ন গীতিশৈলি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

ইসলামী গান

নজরুলের ইসলামী গান নজরুলসঙ্গীত রচনার অন্যতম অধ্যায়। ইসলাম ধর্মের বিষয়বস্তু মানবদর্শন এই গানের মূল উপাখ্যান। ইসলামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী এবং বিষয়ভিত্তিক অনেক ইসলামী গান তিনি রচনা করেছেন। যেমন : “ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর”।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান

১৯০৫ সালের পর থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা প্রকট আকার ধারণ করে। বালক নজরুল তখন থেকেই অসাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গ নিয়ে নিজেকে তৈরি করেন। ব্রিটিস শাসনের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় তিনি বহু গান, কাব্য রচনা করেছেন। তার রচিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।

 

google news logo

 

উপসংহার :

উপরে বর্ণিত বাক্য সমন্বয়ের মূল বক্তব্যে আমরা দেখেছি যে, নজরুলের ব্যতিক্রমধর্মী পর্যায়ের সঙ্গীত রচনা তাঁকে যেমন সম্মানিত করেছে তেমনি নজরুলসঙ্গীত তথা বাংলা গানকে দিয়েছে পরিপূর্ণতা।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment