কাজী নজরুল ইসলাম: রাজনীতি ও নির্বাচন

বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেবল এক মহান সাহিত্যিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক চেতনার অধিকারী। জীবনের বিভিন্ন পর্বে তিনি সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং নিপীড়িত জনগণের পক্ষে তার অবস্থান ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। তাঁর কবিতা, গান ও প্রবন্ধ যেমন বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, তেমনি তিনি সরাসরি রাজনৈতিক কর্মসূচি ও নির্বাচনের ময়দানেও প্রবেশ করেছিলেন।

রাজনীতিতে প্রবেশ এবং কীর্তি কিষান পার্টি

১৯২০-এর দশকে নজরুলের রাজনৈতিক মতাদর্শ আরও সুস্পষ্টভাবে বাম ঘরানার দিকে ধাবিত হয়। ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপটে তিনি যুক্ত হন তৎকালীন লেবার স্বরাজ পার্টির সঙ্গে, যা পরে “কীর্তি কিষান পার্টি” নামে পরিচিতি পায়। এই দলটি ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠন, যার উদ্দেশ্য ছিল কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা এবং ভারতবর্ষে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

নজরুল এই দলের মুখপত্র ‘লাঙ্গল’ ও পরে ‘গণবাণী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তিনি কেবল রাজনৈতিক আদর্শ প্রচার করেননি, তিনি চেষ্টা করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে বাংলার সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে। তিনি এ সময়ে রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দেন, মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেন এবং তাঁর কবিতা ও গানে রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দেন।

নির্বাচনে অংশগ্রহণ

নজরুলের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল ১৯২৬ সালের অবিভক্ত বাংলার আইনসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ। তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনে নির্বাচন করতে চাইলে সাড়া না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এই নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হন বৃহত্তর ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বাকেরগঞ্জ অঞ্চল নিয়ে গঠিত একটি আসন থেকে। তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ছিল সাহিত্য, রাজনীতি এবং জনসচেতনতামূলক ভাষণ।

তাঁর প্রত্যাশা ছিল, সাহিত্যিক ও জনমানসে জনপ্রিয়তা তাঁকে বিপুল ভোটে জয়ী করবে। কিন্তু তিনি নির্বাচনে পরাজিত হন। এই পরাজয়ের পেছনে ছিল একাধিক কারণ—সামন্তপ্রধান সমাজব্যবস্থায় তাঁর বামপন্থী অবস্থান, মুসলমান সমাজে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাভাবনা নিয়ে সন্দেহ, এবং সর্বোপরি তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারিত ধর্মীয় ফতোয়া। তাঁর নির্বাচনী প্রচারণাকে কাফের, বিদ্রোহী ও ইসলামবিরোধী বলে চিহ্নিত করা হয়, যার ফলে অনেক মুসলমান ভোটার তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেন।

রাজনৈতিক আদর্শ প্রভাব

নজরুলের রাজনৈতিক আদর্শ ছিল মানবমুক্তির আদর্শ—তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতা, শ্রেণিহীন সমাজ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক সাম্যের পক্ষে কথা বলতেন। তিনি যেমন ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, তেমনি পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধেও উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তাঁর রাজনীতি কোনো সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তিনি চেয়েছিলেন একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করতে, যেখানে ধর্ম, জাতি, শ্রেণি বা বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য থাকবে না।

তাঁর রাজনৈতিক লেখাগুলোর মধ্যে “রাজবন্দীর জবানবন্দি”, “বিদ্রোহী”, “সাম্যবাদী”, “আমি দুর্বিনীত”, ইত্যাদি রচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নজরুলের এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে ব্রিটিশ শাসকের চোখে ‘অবাঞ্ছিত’ করে তোলে, যার ফলে তাঁকে কারাবরণ করতে হয় এবং তাঁর পত্রিকাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

কাজী নজরুল ইসলামের রাজনীতিচর্চা ছিল তাঁর সাহিত্যিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাহিত্য ও রাজনীতিকে তিনি পৃথক করেননি—বরং সাহিত্যকে তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা, যা প্রমাণ করে যে তিনি কেবল কাগজ-কলমে বিদ্রোহী ছিলেন না, মাঠে নেমে সেই বিদ্রোহকে বাস্তবেও রূপ দিতে চেয়েছিলেন। নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলেও ইতিহাসে তিনি বিজয়ী, কারণ তাঁর চিন্তা, চেতনা ও সংগ্রামের আদর্শ আজও আমাদের প্রেরণা দেয়।