কাজী নজরুলের বাউল গান নিয়ে আজকের আলোচনা। বাংলার জলবায়ুতে যে সমস্ত ধর্মমত জন্মগ্রহণ ও বিকাশ লাভ করেছে, বাউল ধর্মমত তাদের অন্যতম। বাউল ধর্মমত প্রথম থেকেই পাশাপাশি লৌকিক ধর্মমতগুলিকে স্বীকার করে নিয়ে এগিয়ে চলেছে, এর একটা ক্রমবিকাশের ধারা লক্ষিত হয়। শাস্ত্রীয় বা আচারসম্মত বাউল ধর্মের বাইরেও আর একটা লৌকিকধারা লক্ষিত হয়। এই ধারার বাউলের সূক্ষ্ম আধাত্মিক অনুভূতির কোনো স্থান নেই।
কাজী নজরুলের বাউল গান
সাধারণভাবে জীবনের নানা রহস্যের অনুসন্ধান করাই তার উদ্দেশ্য। আবার জীবনের পরপারের আশঙ্কাও কোনা কোনো সময় তাদের মনকে করে তুলেছে ব্যাকুল । কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর গানে বেছে নিয়েছেন বাউলের লৌকিক ধারাটিকে, এবং তার উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি করেছেন বাউল গান ।
‘আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল, আমার দেউল
আমারি এই আপন দেহ।
আমার এ প্রাণের ঠাকুর নহে সুদূর অন্তরে
মন্দির দেহ ॥……..
গানটিতে বাউল কবির প্রাণের ঠাকুর প্রাণেই বসবাস করেন, তাঁর জন্য মন্দিরের প্রয়োজন নেই, দেহেই তাঁর বসবাস- তাই তো তিনি বড় আদরের ধন, বাউলের চিরসাথী প্রাণের ঠাকুর বাউলের সঙ্গে সাথে যেমন নাচগান করেন, তেমনি ভিক্ষাও করেন। অর্থাৎ প্রাণের ঠাকুর বাউলের সুখে দুঃখে নিত্যসঙ্গী। জীবনের পরপার নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন আমাদের বাউল কবি নজরুল ইসলাম। স্বর্গে যাবার ইচ্ছা কবির প্রখর
“সংসার ছক পেতে হায় বসে রোস মোহের নেশায়,
হেরে যে সব খোয়ালি যাসনে তবু খেলা ছাড়ি
প্রাণমন এই দুই ঘুঠিতে যুগ বেঁধে তুই যা এগিয়ে,
দেহ তোর একলা ঘুঠি রাখ আড়িতে মার বাঁচিয়ে।
আড়িতে মার খেলে তুই স্বর্গে যাবি জিতবি হারি
অপর একটি গানে কবি তাঁর প্রাণের ঠাকুরকে উপলব্ধি করেছেন দুখের মাঝে। এ শুধু বাউল গানের কথা নয়, প্রতিটি ভক্তহৃদয়ের প্রতিদিনের উপলব্ধির কথা
তুমি তুলে দিয়ে সুখের দেয়াল ছিলে আমার প্রাণের আড়াল
আজ আড়াল ভেঙে দাঁড়ালে মোর
সকল শূন্য ভরি ॥’
(‘তুমি দুখের বেশে এলে বলে ভয় করি কি হরি’)
শুধু বাউলের মনের কথা নিয়েই কবি ক্ষান্ত থাকেননি, বাউলের গানের সুরে বসিয়েছেন তাঁর দেশের মাটির কথা, করেছেন জন্মভূমির গুণকীর্তন। ‘আমার দেশের মাটি’ গানটিতে পাই পরাধীন ভারতের দেশপ্রেমী নজরুল ইসলামকে। নজরুল ইসলাম রচিত লোকসঙ্গীতগুলিতে বিশেষভাবে লক্ষিত হয় তৎকালীন সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার এক মনোভাব। পরাধীন ভারতের গ্লানি কবিকে বার বার ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। তারই ফলস্বরূপ কবি বারংবার গেয়েছেন জাগরণের গান, শুনিয়েছেন মানুষকে তাদের আত্মসচেতনতার বাণী। এমনই কৃষাণ, শ্রমিক ও ধীবরের গান কবি রচনা করেছেন।
অত্যাচারিত, অনাহারিক্লিষ্ট কৃষকদের ঘুমভাঙার ডাক শুনেছেন কবি
‘আজ জাগরে কৃষাণ, সব ত গেছে
কিসের বা আর জয়
এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার
সুধার জগৎ ভয়’।
হাতুড়ি ও শাবল নিয়ে শ্রমিকদের আহ্বান জানিয়েছেন নতুন দিনের প্রত্যাশায়।
‘আবার নতুন করে মল্লভূমে
গর্জাবে ভাই দল-মাদল।
ধর হাতুড়ি, তোল কাঁধে শাবল ।…….
ধীবরদের জানিয়েছেন ঠেলে ওঠার আহ্বান।
“তোমরা নীচে পড়ে রইবে না আজ
শোনরে ও ভাই জেলে
এবার উঠব রে সব ঠেলে।
বিশ্ব সভায় উঠল সবাই রে
ঐ মুটে মঞ্জুর ছেলে।
এবার উঠব রে সব ঠেলে
[মাদারীপুরে নিখিলবঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবি সমাবেশের তৃতীয় অধিবেশনের উদ্বোধন সঙ্গীত হিসাবে গানটি ব্যবহৃত হয় ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই ও ১২ই মার্চ)
আরও দেখুনঃ