কাজী নজরুলের উত্তরাধিকারঃ নজরুলের কবিজীবন প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি কাল পর্যন্ত। ঊনিশ শ’ দশ থেকে উনিশ শ’ ত্রিশ পর্যন্ত কালকে আধুনিক বাঙলা কবিতার প্রথম পর্যায় এবং উনিশ চল্লিশ পর্যন্ত কালকে আধুনিক বাঙালা কবিতার দ্বিতীয় পর্যায় বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার । নজরুলের ভাবনা
নজরুলকে সাধারণত আধুনিক বাঙলাকবিতার প্রথম পর্যায়ের কবি বলে গণ্য করা হয়। কেন না, নজরুলের অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ রচনার জন্মকাল উনিশ শ’ তিরিশ সালের আগে। এ কথা বলা বাহুল্য যে, সাহিত্যের ইতিহাসে পর্যায় ভাগ করা হয় যুগের বিশেষ ভাবচিস্তার প্রবণতা ও প্রাধান্যের দিকে লক্ষ রেখে। এ ক্ষেত্রে কোনো গাণিতিক সীমারেখা টানা সম্ভব নয়।
কাব্য ও সঙ্গীতের ক্ষেত্রেই নজরুল প্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে। তাই এই অধ্যায়ে উক্ত দুই ক্ষেত্রে তাঁর উত্তরাধিকারের বিষয়ে আলোচনা করা হবে। অবশ্য এই উত্তরাধিকার সম্পর্কে কাব্য ও সঙ্গীতের আলোচনায় মোটামুটিভাবে নানা বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে কাব্য ও সঙ্গীতের বিশেষ বিশেষ দিকের কথাই বিশদভাবে বলা হবে। অন্যান্য বিভাগে তাঁর উত্তরাধিকারের কথা অধ্যায় বিশেষে যা বলা হয়েছে এখানে তার বেশি কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন।
প্রথম পর্যায়ের সবচেয়ে বিশিষ্ট কবি মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এবং কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু এই তিনজনের মধ্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও মোহিতলাল মজুমদার নজরুলের অগ্রগামী: কেননা, এঁদের প্রথম দিককার কাব্যগ্রন্থের বহু কবিতা নজরুলের প্রথম কবিতাপুস্তকের কবিতাবলি প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই আত্মপ্রকাশ করেছে।
এরা নজরুলের অনেক আগে থেকেই কবিতা লেখা আরম্ভ করেছেন। যতীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মরীচিকা’ (১৯২৩)-র কবিতাগুলি ১৩১৭ সাল (১৯১০) থেকে ১৩২৯ সাল (১৯২২)-এর মধ্যে লেখা। মোহিতলালের প্রথম কাবযগ্রন্থ ‘স্বপনপসারী’র প্রকাশ ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে হলেও কবিতাগুলির জন্য হয়েছিল ১৯১০ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’র প্রকাশ কাল ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ এবং এতে সংকলিত কবিতাবলি মোটামুটি গ্রন্থপ্রকাশের পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে লেখা। সুতরাং সাহিত্যের ইতিহাসে যতীন্দ্রনাথ ও মোহিতলাল নজরুলের অগ্রজ।
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর পূর্বে রমিণ্ডলীর মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান ও শক্তিশালী কবি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২)।

সত্যেন্দ্রনাথের ‘সবিতা’ (১৯০০), ‘হোমশিখা’ (১৯০৭), ‘ফুলের ফসল (১৯১১), ‘কুহু ও কেকা (১৯১২), ‘তুলির লিখন’ (১৯১৪), ‘অভ্রআবীর’ (১৯১৬), ‘হসস্তিকা’ (১৯১৬) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থটি যতীন্দ্রনাথ ও মোহিতলালের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পূর্বেই সাহিত্য ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিল। একাধিক কাব্যগ্রন্থ তো উভয়ের প্রথম কবিতা প্রকাশের আগেই আত্মপ্রকাশ করে।
এই তথ্যগুলির উপর জোর দেওয়ার কারণ এই যে, আধুনিক কবিতার প্রথম পর্যায়ের কবিদের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব সত্যেন্দ্রনাথের। অবশ্য এই প্রভাব যতটা ভাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশভঙ্গির।
আরও দেখুনঃ