করাচী ও নজরুল । নজরুলের ভাবনা

করাচী ও নজরুল : ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলের প্রিটেস্ট পরীক্ষা সমাপ্ত করেছিলেন কাজী নজরুল। ১৯১৭ সালের শেষদিকে পরীক্ষা দেয়ার পর দেয়ালপত্রে সৈনিক দলে যোগদানের বিজ্ঞাপন দেখে নজরুল গোপনে আসানশোল যান।

 

করাচী ও নজরুল

 

করাচী ও নজরুল । নজরুলের ভাবনা

সেখান থেকে মহকুমা হাকিমের অনুমতিপত্রসহ কোলকাতায় এসে ফোর্ট উইলিয়ামে ডাক্তারি পরীক্ষা দিতে আসেন নজরুল। হাওড়া স্টেশন থেকে রওয়ানা হবার সঠিক দিন। তারিখ জানা যায় না তবে ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নজরুল সৈনিক হিসাবে এক বড় বাহিনীর সাথে লাহোরে যাত্রা করেন।

সেনাবাহিনীটি মূলত কয়েক হাজার বাঙালি হিন্দু-মুসলমান তরুণ দিয়ে গড়াছিল বলে ৪৮ বাঙালি রেজিমেন্ট হিসাবে তাদের পরিচয় ছিল। নজরুলের সেনা সঙ্গীদের মধ্যে চট্টগ্রামের মহিবুল, মির্জাপুরের রনদা প্রসাদ সাহা, কুষ্টিয়ার শম্ভুরায় ও কলকাতার মনিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নাম। পাওয়া যায়। যাদের সঙ্গে পল্টন ভেঙে যাবার পরও নজরুলের সখ্যতা ছিল।

 

করাচী ও নজরুল

 

৪৯ রেজিমেন্টের একটি অংশকে ১৯১৭ সালে মেসোপটেমিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাজী নজরুল সব সময় করাচীতে অবস্থান করেছিলেন। করাচীতে থাকা অবস্থাতেই তিনি ব্যাটেলিয়ান কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে উন্নীত হন। পল্টনে থাকা অবস্থায় নজরুল গানে-কবিতায় মাধ্যমে সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন। কোয়ার্টার মাষ্টার হাবিলদার নজরুল পেয়েছিলেন রসদভাণ্ডারের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব।

ভাষান্তরে কোট-প্যান্ট বুট মোজা-কম্বলের জিম্মাদার ও সরবরাহকারী। এই ধরনের গার্হস্থ দায়িত্ব নজরুলের নিজের সাহিত্য ও সঙ্গীত চর্চার ক্ষেত্রে অনুকূল ছিল। তা ছাড়া একাধিক বাধ্যযন্ত্র শেখা, ছাউনির জৈনিক পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে আরবি-ফারসীর তালিম নেওয়া, স্বরলিপি দেখে রবীন্দ্র সঙ্গীত তোলা বিপ্লবী পত্রপত্রিকা গোপনে পড়া, বেশ কয়েকটি বাংলা পত্রিকা গোপনে সংগ্রহ করা, ফলে নজরুলের ছাউনির দিনগুলি ছিল নিবিড়।

 

করাচী ও নজরুল

 

গান গেয়ে, কবিতা লিখেন, উচ্চকণ্ঠে রসিকতায় যেমন সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন তেমনি গোপনে নজরুল সংগ্রহ করতেন রাজদ্রোহে মূলক কাগজপত্র, সংগ্রহ করতেন নিষিদ্ধ পত্রিকা, সংবাদ রাখতেন আইরিশ বিপ্লব রুশ বিপ্লবের।

নজরুল গোপনে সে-সব পড়াতেন রাত ভোগে রচনা করতেন উপ্তাক্ষর কবিতা, সঙ্গীত, করুণ আত্মত্যাগের গল্প এবং নাটকীয় পত্রোপন্যাস। নিঃশব্দে নীরবে নজরুল বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। অনেক সময় সমবেত সভায় নজরুল মধ্যমণি হিসাবে থাকতেন অট্টরোলে-হট্টগোলে তিনি তার বিদ্রোহীমূলক বাক্য বন্ধুদের মধ্যে উপস্থাপন করতেন, যেমন দে গরুর গা ধুইয়ে, ঘি চপচপ কাবালী মটর, চালাও পানসি বেলা ঘরিয়ার প্রভৃতি।

 

করাচী ও নজরুল

 

বাংলা পত্রপত্রিকার ভেতর দিয়ে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি ও হালচালের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় ঘটেছিল নজরুলের। করাচী একদিকে যেমন নজরুলকে রুশবিপ্লবের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস মেলে ধরেছিল তার সামনে। নজরুলের সাহিত্যচিন্তা ও সমাজ ভাবনার মানচিত্র এই ছাউনিতে বসেই নজরুল পেয়েছিল।

সাঙ্গীতিক অবকাঠামোর ভিত্তি করাচীতে মোটামুটি মজবুত হয়েছিল এ প্রশ্নে অনেক নজরুল প্রেমিক একমত। যে পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে নতুন করে আরবি-ফারসির পাঠ নিচ্ছিলেন নজরুল, তিনি ফারসি কাব্যের সঙ্গে নজরুলের কাব্যরস কে পরিণত করে তুলতে সাহায্য করেছিলেন। ঠিক সেই সময়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখার সুযোগও নজরুলের জীবনে এসে গেল। সহকর্মীদের কেউ কেউ ছিলেন গুণী সঙ্গীতজ্ঞ।

 

google news logo

 

তাঁদের কাব্য থেকে নজরুল কণ্ঠসঙ্গীত, অর্গ্যান, ক্ল্যারেওনেট, কর্নেট, তবলা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রে নজরুলের অল্পবিস্তর হস্তক্ষেপ ঘটল। এভাবেই করাচী সেনা ছাউনিতে নজরুল নিজেকে সর্বদা প্রতিভা অন্বেষণে নিয়োজিত রাখেন। তাইতো যুদ্ধের কাছাকাছি থাকা করাচীর সৈন্য শিবির যেন হয়ে উঠেছিল নজরুল প্রতিভার বৈচিত্র্যে সাজানো এক সাগর বেলা।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment