ইসলাম ধর্মবিষয়ক সঙ্গীত রচনার প্রেক্ষাপটঃ কাজী নজরুল ইসরামের ইসলামী গান রচনার পটভূমিতে পল্লীগায়ক আব্বাসউদ্দিনের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর অনুরোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নজরুল ইসলামী গান রচনায় হাত দেন।
ইসলাম ধর্মবিষয়ক সঙ্গীত রচনার প্রেক্ষাপট । নজরুলের ভাবনা
আব্বাসউদ্দিনের অনুরোধে নজরুল প্রথম যে দুটো ইসলাম গান রচনা করেন, সেগুলি হলো-
১। ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে
২। ইসলামের ঐ সওদা লয়ে
গান দুটি নজরুল রচনা করেন ১৯৩১ সালের শেষের দিকে অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে। এইচ.এম.ভি থেকেও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গানটি রেকর্ডে বাজারজাত করা হয়। রেকর্ড নম্বর এন ৪১১১, প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ সাল। কারো কারো মতে, নজরুল রচিত ‘বাজলো কিরে ভোরের সানাই’ গানটি ‘মোয়াজ্জিন পত্রিকায় ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যায় ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হয়।
সে হিসাবে নজরুল রচিত প্রথম ইসলামী গান এটি, যা পরে মোহম্মদ কাশেমের কণ্ঠে গ্রামোফোন রেকর্ডে প্রকাশিত হয়। তবে গ্রামোফোন রেকর্ডের জন্য রচিত প্রথম ইসলামী গান ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে যার শিল্পী ছিলেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ।
এ প্রসঙ্গে শিল্পী আব্বাসউদ্দীন তাঁর রচিত ‘গীতিকার নজরুল’ প্রবন্ধে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে তিনি যখন কুচবিহার কলেজের ছাত্র, তখন স্কুল কলেজে প্রতিবছর মিলাদ করতেন। সেই মিলাদ মাহফিলে কবিকে তিনি নিমন্ত্রন জানান এবং এবং কবি তার গান শুনে মুগ্ধ হয়। এভাবেই পরিচয়ের সুত্রপাত।
পরবর্তীতে শিল্পী আব্বাসউদ্দীন কবিকে প্রায়ই বলতে থাকেন-পিয়ারু কাওয়াল, কালু কাওয়াল প্রমুখ যে ধরণের উর্দু কাওয়ালী গান করেন, সে ধরনের ইসলামী গান রচনা করর জন্য, কথাটা কবির মনে ধরে। তিনি আব্বাসউদ্দীনের গ্রামোফোন কোম্পানি রিহার্সেল ইনচার্জ ভগবতী বাবুর সঙ্গে তাকে কথা বলতে বলনে। ভগবতী বাবু প্রস্তাব শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলেন, না, না ওসব গান চলবে না।
তার প্রায় ছ’মাস পরে আব্বাসউদ্দিন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল রুমে ভগবতী বাবু ও বৃদ্ধ আশ্চর্য্যময়ীকে গল্প করতে দেখেন। তিনি উত্তম সুযোগ বুঝে ইসলামী গান দেবার কথাটা তুলেন। তিনি বলেন, একটা এক্সপেরিমেন্ট করুন না। যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কি; তখন ভগবতী বাবু সে প্রস্তাবে রাজী হন।
আব্বাসউদ্দিন ঘর থেকে বেরিয়ে নজরুলের খোঁজ করে জানতে পারেন, পাশের কামরায় তিনি ইন্দুবালাকে গান শেখাচ্ছেন। ঘরে ঢুকেই তিনি ভগবতী বাবুর রাজী হওয়ার কথা কবিকে জানান, নজরুল ইন্দুবালাকে বাড়ি চলে যেতে বলে দশরথ পিয়নকে পান ও চায়ের ব্যবস্থা করতে বলেন।
তারপর কবি আব্বাসউদ্দিনকে পনেরো বিশ মিনিট চুপ করে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতে বলে রচনা করেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান-‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” সুর সংযোগ করে সাথে সাথে শিখিয়ে দেন তাকে। পরের দিন কবি দ্বিতীয় গান লেখেন- “ইসলামের ঐ সওদা লয়ে গান দুটি রচনা ও সুরারোপিত হবার চারদিন পরেই। রেকর্ড করা হয়।
সেই গান বাংলার আকাশ বাতাসে তোলে নব আলোড়ন। এরপর নজরুল লিখে চলেন আরো বহু ইসলামী গান। খুলে যায় গান রচনার এক নতুন দুয়ার। মুসলমানের ঘরে ঘরে জাগে নতুন উদ্দীপনা। রচিত হয় আরো কিছু বিখ্যাত গান। সেই গানগুলি এত জনপ্রিয় হতে থাকে যে নতুন নতুন মুসলমান শিল্পী গ্রামোফোন রেকর্ডের জন্য যোগদান করতে থাকেন।

তা ছাড়া অনেক হিন্দু শিল্পীরাও মুসলমান নামে ইসলামী গান রেকর্ড করতে থাকেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধীরেন দাস (গণি মিয়া), চিত্ত রায় (দেলোয়ার হোসেন), আশ্চর্যময়ী দাসী (আমিনা বেগম), হরিমতী (সকিনা বেগম), গিরীন চক্রবর্তী (সোনামিয়া/সুজনমাঝি) প্রমুখ এভাবে রচিত হয় নজরুলের বেশ কিছু বিখ্যাত ইসলামী গান। যেমন
নাম মোহম্মদ বোল রে মন
আল্লাহ আমার প্রভু
ত্রিভুবনের প্রিয় মোহম্মদ
এলো আবার ঈদ ইত্যাদি।
পরবর্তীতে নজরুলের ইসলামী গানের সংকলন ‘জুলফিকার’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের গানগুলি নজরুলের অসামান্য সৃষ্টি। এই গানগুলি-মুসলমানদের নব জাগরণের এক অতুলনীয় অবদান। এভাবেই বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম ইসলামী গানের একজন সার্থক কবি, গীতিকার এবং রূপকার।
আরও দেখুনঃ