কাজী নজরুলের ইসলামী গানের বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য: কাজী নজরুলের ইসলামী গান রচনা বাংলা সঙ্গীত ভুবনে এক অসামান্য অবদান। তিনি ইসলামী গান রচনার ক্ষেত্রে এক অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন।
কাজী নজরুলের ইসলামী গানের বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য । নজরুলের ভাবনা
বাণী ও সুরের ঐশ্বর্যে তাঁর ইসলামী গান বাংলা সঙ্গীতের এক অতুলনীয় সম্পন। তিনিই মূলত বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে ইসলামী সঙ্গীতধারার প্রবর্তক। তাঁর রচিত ইসলামী গান তৎকালীন ঘুমন্ত মুসলমান জাতিকে নিদ্রা থেকে উত্থিত করে বাঙালি মনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল। ইসলাম চেতনায় করেছিল উদ্বুদ্ধ।
ইসলামী গানের বৈশিষ্ট্য :
১. ইসলাম ধর্ম বিষয়ক বা ইসলামী ভাবদর্শে রচিত গানই ইসলামী সঙ্গীত।
২. কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ইসলামী গানে আরবী ও ফার্সী শব্দের ব্যবহার অধিক পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের শব্দ চয়ন করে তিনি ইসলামী গানের নিজস্ব স্টাইল তৈরি করেন।
৩. মুসলিম ঐতিহ্যের অনুসরণ ও বহু বিচিত্র ব্যবহার ইসলামী গানে দেখা যায় ।
৪. ইসলাম ধর্মের বিষয়ের উপর নজরুলের ইসলামী গানগুলি রচিত। যেমন : হামদ নাত, হজ, জাকাত, নামাজ, রোজা, ঈন, কোরবাণী, মোহররম, মক্কা, মদিনা মনোয়ারা, শবেবরাত, শবেকদর, ফাতেহা-ই দোয়াজদম প্রভৃতি।
৫ ইসলামী গানের সুরগুলিতে মৌলিক ক্ল্যাসিক সুরের মহিমা পরিলক্ষিত হয়। রাগ-রাগিনী ছাড়াও নজরুলের ইসলামী গানে বাউল, ভাটিয়ালী, কীর্তন প্রভৃতি সুরের ব্যবহার হয়েছে সাবলীলভাবে। বেশির ভাগ ইসলামী গানগুলি ভক্তি ভাব রস ও গভীর অতি প্রাকৃত কল্পনার সুরে নিষিক্ত।
৬. এই ধারার গানগুলির বাণী মধুর সুরগুলিও মধুরতর। সুরের মাদকতা ও বাণীর সুন্দর সমন্বয়ে নজরুল রচিত ইসলামী গানগুলি চিরকাল বেঁচে থাকবে। যেমন আল্লাহ আমার প্রভু। ইসলামের ঐ সওদা লয়ে ইত্যাদি গানগুলি বাণী ও সুরের ঐশ্বর্যে মহিমান্বিত।
৭. কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রচিত ইসলামী গানে ৩০ থেকে ৪০টি রাগের প্রয়োগ এবং তালের প্রয়োগ করেছেন। যেমন-
ইসলামের ঐ সওদা লয়ে রাগ ভৈরবী, তাল : কাহারবা।
এ কোন মধুর শারার দিলে- রাগ জয়জয়ন্তী, মিশ্র তাল : কাহারবা
আয় মরু পায়ের হাওয়া-রাগ মাঢ় মিশ্র, তাল দাদরা।
৮. ইসলামী গানের কোনো কোনো অংশ তাল ছাড়া গীত হয় অর্থাৎ শেয়রের প্রয়োগ দেখা যায়, যেমন-এ কোন মধুর শরাব দিলে গানটির কথা উল্লেখ করা যায়।
৯. অন্যান্য গানের তুলনায় ইসলামী গানে কম যন্ত্রের প্রয়োগ দেখা যায়। পূর্বে শুধু হারমনিয়াম ও তবলা সহযোগে গাওয়া হলেও বর্তমানে অন্য যন্ত্রের প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে।
১০. ইসলামী গানের মূল আবেদন মুসলমানদের সমৃদ্ধ অতীত ইতিহাসের কথা, মুসলিম সমাজের অতীত গৌরব আর ঐতিহ্যের রোমন্থন।
১১. নজরুল তাঁর ইসলামী গানের মধ্যে দিয়ে বাঙালি মুসলমানদের সঞ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছেন, ব্যাখ্যা দিয়েছেন পবিত্র কোরআনের মর্মকথার ও হাদীসের সঠিক অনুসরণ করার কথা ।
১২. ইসলামী গানগুলিতে বিধৃত হয়েছে বিখ্যাত মুসলিম রমণীদের দৃষ্টান্তমূলক কথকতা, বিধৃত হয়েছে শিল্পী ফরহাদ, লায়লী-মজনুর অমর করুণ কাহিনী এবং মমতাজ, নূরজাহান, জাহানারা, জেবুন্নেসা ও সুলতানা রাজিয়ার কীর্তিময় কাহিনী ।
১৩. বাঙালি মুসলমানদের জাগরণ, বাঙালি মনে নতুন প্রাণের সঞ্চার, অর্ধশিক্ষিত অবচেতন বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতি বিকাশ সর্বোপরি একটি জাতির সামাজিক চেতনা জাগ্রত করার ঐতিহাসিক প্রমাণ নজরুলের ইসলামী গানগুলি। যেমন-বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা, বাজলো কি করে ভোরের সানাই প্রভৃতি।
১৪. ইসলামী গানগুলিকে মূলত ২ ভাগে ভাগ করা যায়।
ক) জাগরণী গান ও
খ) ইসলামের মূলতত্ত্ব বিশ্লেষণ
এ ছাড়াও আন্তঃবিভাগ অনুযায়ী এগুলি হামদ্, নাত, মর্সিয়া, মোনাজাত, মুর্শেদী, পর্বসঙ্গীত, দেহতত্ত্বমূলক ইত্যাদি শ্রেণীতে বিভক্তি।
১৫ যে-কোনো পবিত্র অনুষ্ঠান বা মিলাদ মাহফিলে এ ধরনের গান গীত হয়।
ইসলামী গানের বৈচিত্র্য :
কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গানের ভুবন বৈচিত্র্যময়। তিনি ইসলাম ধর্মীয় প্রায় সকল বিষয়ের উপর গান রচনা করেছেন, পাশাপাশি মুসলিম রমণীদের দৃষ্টান্তমূলক কথকতাও স্থান পেয়েছে তাঁর ইসলামী গানগুলিতে। অপরদিকে তাঁর ইসলামী গানগুলি তৎকালীণ মুসলিম জাতির সামাজিক চেতনা জাগ্রত করার এক ঐতিহাসিক প্রমাণ, তাঁর রচিত ইসলামী গানগুলির মধ্যে আছে হামদ, নাত, মর্সিয়া, মুর্শিদী, মারফতি, পর্বসঙ্গীত, মোনাজাত, মুসলিম রমণীদের কীর্তিগাথামূলক গান প্রভৃতি।
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত মোট ইসলামী গানের সংখ্যা ২৮৪ টি। তার মধ্যে গ্রামোফোন রেকর্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে ১১৪টি অর্থাৎ ২১৯টি গান। লেটো ইসলামী গানের সংখ্যা ২২টি।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, গীতি গ্রন্থে বা রেকর্ড কোম্পানির খাতায় ইসলামী গানের সন্ধান পাওয়া যায় ৪১টি। এভাবে মোট গানের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮২টি। লেখক আসাদুল হকের কাছে নজরুলের ইসলামী গানের আরো দুটি হস্তলিপি পাওয়া যায়।
নজরুলের ইসলামী গানের সংকলন ‘লফিকার’ গ্রন্থটি। এই সঙ্গীত গ্রন্থের মূল আবেদন মুসলমানদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের কথা। কবির লেখনীর গুণে সেই গৌরবময় অতীত মুসলমানদের প্রাণে এক নতুন আশার সঞ্চার করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান-দূর আরবের স্বপন দেখি, বক্ষে আমার কাবার ছবি ইত্যাদি।
নজরুলের হামদ ও নাত তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি। যে-কোনো পবিত্র আসরে আল্লাহ ও হজরত মুহম্মদ (সাঃ) এর মহিমা বর্ণনা করে হামদ ও নাত গীত হয়। কখনো কখনো মিলাদ মাহফিলেও এ ধরনের গান পরিবেশিত হয় তাঁর রচিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হামদ ও নাত হলো-
তুমি অনেক দিলে খোদা (হামদ)
এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল (হামদ)
হেরা হতে হেলে দুলে (নাত)
সাহরাতের ফুটলোরে (নাত)
এছাড়াও শেখ সাদী রচিত বিখ্যাত নাত ‘বালাগাল উলা বে কামালিহি কে আশ্চর্য সুন্দরভাবে বাংলায় রূপান্তর করে নজরুল লিখলেন- ‘কুল মুখলুক গাহে হজরত’। কবি নজরুল ইসলামের ইসলামী গান ঘুমন্ত বাঙালি মুসলিম জাতিকে নিদ্রা থেকে মনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর রচিত ‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা, বাজলো কিরে ভোরেই সানাই, দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠেছে দীন- ই ইসলামী লাল মশাল, আজি কোথা তখত তাউস ইত্যাদি গান মুসলমান সমাজে জাগরনের সুর ধ্বনিত করেছে।
কাজী নজরুলের ভেতর ইসলামের রূপ যেন এক অলৌকিক জ্যোতি বিচ্ছুরিত করেছিল। তাঁর, লেখনি যেদিন ইসলামী গান লিখতে শুরু করল সেদিন থেকে তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিলেন আল্লাহ ও নবীজীর কাছে। তারপর একে একে লিখলেন নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত, ঈদ, কোরবানী, মক্কা, মদিনা, শবেবরাত, শবেকদর, ফাতেহাদোয়াজদম, মুনাজাত, মর্সিয়া ও মুসলিম রমণীদের কীর্তিগাথামূলক গান যার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নরূপ।
নামাজ রোজা হজ্জ্ব যাকাত নিয়ে নজরুল লিখলেন-নামাজ পড় রোজা রাখ নবীজী, মা ফাতেমা ও হাসান হোসেন নিয়ে লিখলেন-ও মদিনা বলতে পারিস ফাতেহাদোয়াজম নিয়ে লিখলেন-
ত্রিভুবনের প্রিয় মোহম্মদ
তৌতিদেরই মুর্শিদ
নাম মোহম্মদ বোল ইত্যাদি
মক্কা মদিনা নিয়ে লিখলেন-
ওগো মদিনা মনোয়ারা
সুদূর মক্কা
এছাড়াও মুসলমানদের বিভিন্ন পর্বশালা নিয়ে লিখলেন-
এল রমজানের চাঁদ (রোজা)
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে (ঈদ)
ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক (ঈদ)
মোহরমের চাঁদ এল ঐ (মোহররম)
ফোরাতের পানিতে নেমে (মোহররম)
গুনে গরিমায় আমাদের নারী (মুসলিম নারীদের কীর্তিগাথামূলক গান)
আমি গরবিনী মুসলিম বালা (“)
এল এল শবেবরাত (শবেবরাত)
শোনে শোনে ইয়া এলাহী (মোনাজাত)
শোনে শোনে মোনাজাত (মোনাজাত)
ইত্যাদি
এভাবে নজরুল রচিত ইসলামী গানগুলি বাঙালি মুসলিম সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং এ ধরনের চাহিদা ক্রমেই বাড়তে থাকে। তখনকার দিনে মুসলিম শিল্পী সংখ্যা কম থাকায় দেখা যেত অনেক হিন্দু শিল্পীরা তাদের নাম বদলে মুসলিম ঐতিহ্যপূর্ণ গান গাইতে শুরু করেন। সে রকম কয়েকজন শিল্পী ধীরেন দাস। (গনিমিয়া), হরিমতী (সকিনা বেগম), গিরীন চক্রবর্তী (সোনামিয়া / সুজন মাঝি) প্রভৃতি ।

বাল্যকালেই মূলত লেটোদলে থাকা অবস্থায় নজরুল অনেক ইসলামী গান রচনা করেছিলেন। মোহম্মদ আয়ুব হোসেন বর্ধমানের বিভিন্ন অঞ্চল নজরুলের শতাধিক লেটো গান সংগ্রহ করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ইসলামী গান হলো
১. যে নামাজ পড়ে না
২. কাবাহ আমার কেবলা আমার
৩. আমি কোন পথে যাই সোনার মদিনা গো
৪. মরুর তরুতলে ছকিনা ঘুমায়। প্রভৃতি।
নজরুল তাঁর মৃত্যুর পর কোথায় তাঁকে কবর দিতে হবে ইসলামী গানের বাণী ও সুরেও সে কথা বলে গেছেন। তিনি লিখেছেন-‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই; আল্লাহ নজরুলের এই স্বপ্ন সফল করেছেন। তিনি মসজিদের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। এটা তাঁর আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ বিশ্বাসেরই প্রাপ্তি।
বাংলা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম ইসলামী গানের এক সার্থক কবি, গীতিকার ও রূপকার। ইসলামী গান রচনায় নজরুল অদ্বিতীয়। বাংলা সঙ্গীত ভুবনে নজরুল ইসলাম রচিত ইসলামী গান ইতিহাসে চিরন্তন হয়ে থাকবে।
আরও দেখুনঃ