ওঠ রে চাষী কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর নতুন চাঁদ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । নতুন চাঁদ কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। প্রকাশক ছদরুল আনাম খান, মোহাম্মদী বুক এজেন্সী, ৮৬এ, লোয়ার সার্কুলার রোড, কলকাতা এতে রয়েছে নজরুলের ১৯টি কবিতা ।

ওঠ রে চাষী কবিতা
চাষি রে! তোর মুখে হাসি কই? তোর গো-রাখা রাখালের হাতে বাঁশের বাঁশি কই? তোর খালের ঘাটে পাট পচে ভাই পাহাড়-প্রমাণ হয়ে, তোর মাঠের ধানে সোনা রং-এর বান যেন যায় বয়ে, সে পাট ওঠে কোন লাটে? সে ধান ওঠে কোন হাটে? উঠানে তোর শূন্য মরাই মরার মতন পড়ে– স্বামীহারা কন্যা যেন কাঁদছে বাপের ঘরে। তোর গাঁয়ের মাঠে রবি-ফসলছবির মতন লাগে, তোর ছাওয়াল কেন খাওয়ার বেলা নুন লঙ্কা মাগে? তোর তরকারিতেও সরকারি কোন ট্যাক্স বুঝি বসে! তোর ইক্ষু এত মিষ্টি কি হয় চক্ষুজলের রসে? তোর গাইগুলোকে নিঙড়ে কারা দুধ খেয়েছে ভাই? তোর দুধের ভাঁড়ে ভাতের মাড়ের ফেন – হায়, তাও নাই!
তোর ছোটো খোকার জুড়িয়েছে জ্বর ঘুমিয়ে গোরস্তানে, সে দিদির আঁচল ধরে বুঝি গোরের পানে টানে। বিকার-ঘোরে দিদি তাহার ডাকছে ছোটো ভায়ে, দুধের বদল ঝিনুক দিয়ে আমানি দেয় মায়ে। কবর দিয়ে সবর করে লাঙল নিয়ে কাঁধে, মাঠের কাদাপথে যেতে আব্বা তাহার কাঁদে। চারদিকে তার মাঠ-ভরা ধান আকাশ-ভরা খুশি, লাল হয়েছে দিগন্ত আজ চাষার রক্ত শুষি! মাঠে মাঠে ধান থই থই, পণ্যে ভরা হাট, ঘাটে ঘাটে নৌকা-বোঝাই তারই মাঠের পাট। কে খায় এই মাঠের ফসল, কোন সে পঙ্গপাল? আনন্দের এই হাটে কেন তাহার হাড়ির হাল? কেন তাহার ঘরের খোকা গোরের বুকে যায়? গোঠে গোঠে চরে ধেনু, দুধ নাহি সে পায়! ওরে চাষা! বাঁচার আশা গেছে অনেক আগে গোরের পাশের ঘরে কাঁদা আজও ভালো লাগে? জাগে না কি শুকনো হাড়ে বজ্র-জ্বালা তোর? চোখ বুজে তুই দেখবি রে আর, করবে চুরি চোর? বাঁশের লাঠি পাঁচনি তোর, তাও কি হাতে নাই? না থাক তোর দেহে রক্ত, হাড় কটা তোর চাই। তোর হাঁড়ির ভাতে দিনে রাতে যে দস্যু দেয় হাত, তোর রক্ত শুষে হল বণিক, হল ধনীর জাত তাদের হাড়ে ঘুণ ধরাবে তোদেরই এই হাড় তোর পাঁজরার ওই হাড় হবে ভাই যুদ্ধের তলোয়ার। তোরই মাঠে পানি দিতে আল্লাজি দেন মেঘ, তোরই গাছে ফুল ফোটাতে দেন বাতাসের বেগ, তোরই ফসল ফলাতে ভাই চন্দ্র সূর্য উঠে, আল্লার সেই দান আজি কি দানব খাবে লুটে? তেমনি আকাশ ফর্সা আছে, ভরসা শুধু নাই, তেমনি খোদার রহম ঝরে, আমরা নাহি পাই। হাত তুলে তুই চা দেখি ভাই, অমনি পাবি বল, তোর ধানে তোর ভরবে খামার নড়বে খোদার কল!

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তার জীবন শুরু হয়েছিল অ কিঞ্চিত কর পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্ম নিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজন্যদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জন প্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্ত র্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।

নতুন চাঁদ কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- নতুন চাঁদ
- চির-জনমের প্রিয়া
- আমার কবিতা তুমি
- নিরুক্ত
- সে যে আমি
- অভেদম্
- অভয় সুন্দর
- অশ্রু-পুস্পাঞ্জলী
- কিশোর রবি
- কেন জাগাইলি তোরা
- দুর্বার যৌবন
- আর কতদিন
- ওঠ রে চাষী
- মোবারকবাদ
- কৃষকের ঈদ
- চাষীর ঈদ
- আজাদ
- ঈদের চাঁদ
- চাঁদনী রাতে