সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । চক্রবাক কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ১৯টি। এই কাব্যে নজরুল বেদনার ছবি তুুুলে ধরেছেন; এতে রয়েছে প্রেমের অনুুুভূতি এবং অতীত সুুখের স্মৃতিচারণা।
সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে কবিতা
দেখা দিলে রাঙা মৃত্যুর রূপে এতদিনের কি গো রানি? মিলন-গোধূলি-লগনে শুনালে চির-বিদায়ের বাণী। যে ধূলিতে ফুল ঝরায় পবন রচিলে সেথায় বাসর-শয়ন, বারেক কপোলে রাখিয়া কপোল, ললাটে কাঁকন হানি, দিলে মোর পরে সকরুণ করে কৃষ্ণ কাফন টানি। নিশি না পোহাতে জাগায়ে বলিলে, ‘হল যে বিদায় বেলা।” তব ইঙ্গিতে ও-পার হইতে এপারে আসিল ভেলা। আপনি সাজালে বিদায়ের বেশে আঁখি-জল মম মুছাইলে হেসে, বলিলে, ‘অনেক হইয়াছে দেরি, আর জমিবে না খেলা! সকলের বুকে পেয়েছ আদর, আমি দিনু অবহেলা।‘ ‘চোখ গেল উহু চোখ গেল’বলে কাঁদিয়া উঠিল পাখি, হাসিয়া বলিলে, ‘বন্ধু, সত্যি চোখ গেল ওর নাকি?’ অকূল অশ্রু-সাগর-বেলায় শুধু বালু নিয়ে যে-জন খেলায়, কী বলিব তারে, বিদায়-ক্ষণেও ভিজিল না যার আঁখি! শ্বসিয়া উঠিল নিশীথ-সমীর, ‘চোখ গেল’কাঁদে পাখি! দেখিনু চাহিয়া ও-মুখের পানে – নিরশ্রু নিষ্ঠুর! বুকে চেপে কাঁদি, প্রিয় ওগো প্রিয়, কোথা তুমি কত দূর? এত কাছে তুমি গলা জড়াইয়া কেন হুহু করে ওঠে তবু হিয়া, কী যেন কী কীসের অভাব এ বুকে ব্যথা-বিধুর! চোখ-ভরা জল, বুক-ভরা কথা, কণ্ঠে আসে না সুর। হেনার মতন বক্ষে পিষিয়া করিনু তোমারে লাল, ঢলিয়া পড়িলে দলিত কমল জড়ায়ে বাহু-মৃণাল! কেঁদে বলি, ‘প্রিয়া, চোখে কই জল? হল না তো ম্লান চোখের কাজল!’ চোখের জল নাই – উঠিল রক্ত – সুন্দর কঙ্কাল! বলিলে, ‘বন্ধু, চোখেরই তো জল, সে কি রহে চিরকাল?’
ছল ছল ছল কেঁদে চলে জল, ভাঁটি-টানে ছুটে তরি, সাপিনির মতো জড়াইয়া ধরে শশীহীন শর্বরী। কূলে কূলে ডাকে কে যেন, ‘পথিক, আজও রাঙা হয়ে ওঠেনি তো দিক! অভিমানী মোর! এখনই ছিঁড়িবে বাঁধন কেমন করি? চোখে নাই জল – বক্ষের মোর ব্যথা তো যায়নি মরি!’ কেমনে বুঝাই কী যে আমি চাই, চির-জনমের প্রিয়া! কেমনে বুঝাই – এত হাসি গাই তবু কাঁদে কেন হিয়া! আছে তব বুকে করুণার ঠাঁই, স্বর্গের দেবী – চোখে জল নাই! কত জীবনের অভিশাপ এ যে, কতবার জনমিয়া – পারিজাত-মালা ছুঁইতে শুকালে – হারাইলে দেখা দিয়া। ব্যর্থ মোদের গোধূলি-লগন এই সে জনমে নহে, বাসর-শয়নে হারায়ে তোমায় পেয়েছি চির-বিরহে! কত সে লোকের কত নদনদী পারায়ে চলেছি মোরা নিরবধি, মোদের মাঝারে শত জনমের শত সে জলধি বহে। বারেবারে ডুবি বারেবারে উঠি জন্ম-মৃত্যু-দহে! বারে বারে মোরা পাষাণ হইয়া আপনারে থাকি ভুলি, ক্ষণেকের তরে আসে কবে ঝড়, বন্ধন যায় খুলি। সহসা সে কোন সন্ধ্যায়, রানি, চকিতে হয় গো চির-জানাজানি! মনে পড়ে যায় অভিশাপ-বাণী, উড়ে যায় বুলবুলি। কেঁদে কও, ‘প্রিয়, হেথা নয়, হেথা লাগিয়াছে বহু ধূলি।’ মুছি পথধূলি বুকে লবে তুলি মরণের পারে কবে, সেই আশে, প্রিয়, সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে! কে জানিত হায় মরমের মাঝে এমন বিয়ের নহবত বাজে! নবজীবনের বাসর-দুয়ারে কবে ‘প্রিয়া’‘বধূ’হবে – সেই সুখে, প্রিয়া, সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে!
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।
চক্রবাক কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- তোমারে পড়িছে মনে
- বাদল-রাতের পাখি
- স্তব্ধ রাতে
- বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি
- কর্ণফুলী
- শীতের সিন্ধু
- পথচারী
- মিলন-মোহনায়
- গানের আড়াল
- তুমি মরে ভুলিয়াছ
- হিংসাতুর
- বর্ষা-বিদায়
- সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে
- অপরাধ শুধু মনে থাক
- আড়াল
- নদীপারের মেয়ে
- ১৪০০ সাল
- চক্রবাক
- কুহেলিকা