শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খেয়াল ও নজরুল সৃষ্ট খেয়াল গানের সাঙ্গীতিক অবস্থান : খেয়াল গান মূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তৃতীয় পর্যায়। বিস্তৃতি এবং পরিধি হিসেবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পরিশিলিত ধারায় একমাত্র খেয়াল গানই বাহ্যিকভাবে বেশ সমাদৃত। চর্যাপদ রচনার সময় থেকেই লঘু সঙ্গীত কোনো-না- কোনোভাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রভাবিত। যার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন পঞ্চ-গীতি কবি তাদের গানে। পঞ্চ-গীতি কবিদের মধ্যে একমাত্র কাজী নজরুল ইসলামই লঘু সঙ্গীতে খেয়াল গানের সার্থক রচনাকার।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খেয়াল ও নজরুল সৃষ্ট খেয়াল গানের সাঙ্গীতিক অবস্থান
রাগ উপস্থাপন, তাল সংযোগ বিস্তৃত বাণী, তার খেয়াল গানকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে বলে সঙ্গীত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আমরা তাঁর খেয়াল পর্যায়ের গান এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খেয়ালের সাঙ্গীতিক বিশ্লেষণ, রচনার প্রেক্ষাপট প্রভৃতি পর্যালোচনা করব। যাতে করে নজরুল সৃষ্ট খেয়াল লঘু সঙ্গীত হলেও শাস্ত্রীয়ভাবে সমাদৃত এবং সার্থকময় হয় ।
খেয়াল গান = খেয়ালের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কল্পনা। শাস্ত্রীয় নিয়ম অনুসারে মুক্তর স্বরবিন্যাসই খেয়াল।
নজরুল সৃষ্ট খেয়ালের প্রেক্ষাপট ও উৎস :
নজরুল মূলত ১৯৩০ সাল থেকেই খেয়াল পর্যায়ের গান রচনায় মনোনিবেশ করেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বিশেষ পরিপকৃতার কারণে এবং বৈচিত্র্য সাধনের উদ্দেশ্যে রাগ নির্বাচন এবং খেয়াল গানে তার সঠিক রূপায়ন করবার ক্ষেত্র বিশেষভাবে শুরু থেকেই নান্দনিকতা পায়।
যাদের কাছে তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন তারাও নজরুলকে খেয়াল পর্যায়ের গান রচনায় প্রেরণা জুগিয়েছিল। পরিপক্বতা ও দক্ষতার দাবী রেখে যারা নজরুলকে সহযোগিতা করেছিলেন তারা হলেন প্র: জ্ঞান গোস্বামী, গীরিন চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন দাস প্রমুখ।
মন্তব্য
(১) ড: মাধুরীকর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ফ্রেমে নজরুলের খেয়াল গান রচনাকে দুঃসাহসিক বলে উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়, ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরী এই পাঁচটি ধারাকে বাংলা গানে লিপিবদ্ধ করা মোটেও সহজ কাজ নয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বিশেষ পারদর্শীতার জন্যে নজরুল উল্লেখিত পাঁচটি পর্যায়সহ প্রচলিত ও অপ্রচলিত রাগের প্রয়োগ দেখিয়েছেন তার খেয়াল তথা রাগ প্রধান গানে।
(২) আমেরিকার বিশিষ্ট সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ জান কোথালিক মার্গারেট হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে গবেষণা করে নজরুল সম্পর্কে একটি মন্তব্য উপস্থাপন করেন ।
পাশ্চাত্য সঙ্গীতে ইতিবৃত্তভিত্তিক পরিবেশনা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। কিন্তু হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয়সঙ্গীত পরিবেশনা এবং বাংলা গানে এর প্রয়োগ কাজী নজরুল ইসলামই সার্থকভাবে রূপ দিয়েছেন।
তথ্য সংগ্ৰহ
Dr Bonnic wade-Khyal a study in hindus.any classiccal vocal music: Vol (1) 1971 Page-48, 49, Losangeles Universily of California.
আমির খসরু প্রবর্তিত খেয়াল গানের প্রয়োগ : কাজী নজরুল ইসলাম তার খেয়াল গানে বৈচিত্র্যের ভাণ্ডার বাড়াতে গিয়ে শাস্ত্রীয়, প্রচলিত, অপ্রচলিত ছাড়াও ব্যক্তি বিশেষ সৃষ্ট রাগের প্রয়োগ করেছেন তার গানে। আমির খসরু প্রবর্তিত খেয়াল বিলাস খানীটোড়ী রাগকে তিনি তার রাগাশ্রয়ী কাব্যে সঠিকভাবে ব্যবহার করেছেন। স্বর রূপায়নের ক্ষেত্রে বাণী সঠিকভাবে নির্ণয়ে তিনি অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেন।
যেমন
“কে তুমি বিলাসিনী উদাস হাওয়ায়” ।
রাগ: বিলাস খানী টোড়ী
তাল: একতাল ।
নজরুলের খেয়াল গানের বৈশিষ্ট্য :
(১) সংক্ষেপতর বাণী ।
(২) স্থায়ী ও অন্তরায় সমন্বয় যা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খেয়াল গানের মতোই।
(৩) সঠিক রাগ নির্বাচন। যেমন: জয় জয়ন্তী, সুদ সারং, রাগেশ্রী প্রভৃতি।
(৪) তালের ব্যবহার হিসেবে ত্রিতাল, একতাল, ঝাঁপতাল ও আন্ধার ব্যবহার দেখা যায়।
(৫) শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খেয়ালের মতোই পরিবেশনা।
(৬) সনাতন ধর্মের বিষয়বস্তু বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তা ছাড়াও প্রকৃতিগত বর্ণনাও লক্ষ করা যায়।
(৭) নজরুলের খেয়াল লঘু সঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত তাই লঘুসঙ্গীতে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোই ব্যবহৃত হয়।
(৮) রাগ বহির্ভূত স্বরের প্রয়োগ।
(৯) ১৯২৯ পরবর্তী রচনা।
(১০) বিভিন্ন গবেষণার আলোকে নজরুল সৃষ্ট খেয়াল বাংলা গানের সমৃদ্ধতার ক্ষেত্রে বহুমুখী।
(১১) শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দক্ষতা অর্জনকারী শিল্পী নজরুলের খেয়াল গানের পরিবেশনায় যথার্থ।
রাগের ব্যবহার
নজরুল যে-সব রাগের খেয়াল রচনা করেছেন তার মধ্যে বৃন্দাবনী সারং, রাগেশ্রী, জয়জয়ন্তী, দেশকার, নাগেশ্রী, টোড়ি, সুদ সারং নটবেহাগ ইত্যাদি।
তালের ব্যবহার
নজরুল তার খেয়াল গানে ঝাঁপতাল, একতাল, ত্রিতালের প্রয়োগে বেশি করেছেন।
ব্যবহৃত যন্ত্র :
নজরুল রচিত খেয়াল গান লঘু সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য বহন করে সে কারণে তার খেয়াল গানে লঘু সঙ্গীতের ব্যবহৃত যন্ত্রই ব্যবহৃত হওয়া সমীচিন, এ ছাড়াও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খেয়ালে ব্যবহৃত যন্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়।
অবয়ব প্রসঙ্গ :
নজরুলের খেয়াল গানের অবয়ব শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের খেয়াল গানের অনুরূপ। দুটি বিভাগের মধ্যে প্রথমে স্থায়ী ও দ্বিতীয়ত অন্তরা।
শব্দচয়ন
শব্দচয়নের ক্ষেত্রে নজরুলের সার্থকতা খেয়াল গানে পূর্ণতা বহন করে। বিষয়ের উপর নির্ভর করে শব্দচয়ন এবং এর গঠন প্রণালীর ক্ষেত্রে স্বকীয়তা বিদ্যমান যা খেয়াল গানের প্রকাশধর্মী অবস্থানের বৈশিষ্ট্য এবং সাঙ্গীতিক অবস্থানের রূপ প্রদর্শন করে।
বাক্য সমন্বয় :
খেয়াল গানে বাক্যের পরিধি খুব সামান্য হলেও শব্দ সংযোগ করে বাক্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে নজরুলের অবদান অনস্বীকার্য। অনেকক্ষেত্রে সুর নির্বাচন করবার জন্যে গান রচিত হবার পর অনেক বাক্য পরিবর্তন করে নতুন বাক্য সংযোজন করেছেন। যা কাজী নজরুলের পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়।
সুর বিশ্লেষণ রাগের বৈচিত্র্যতার কারণে সুরারোপিত খেয়াল গানের সুর বিশ্লেষণ ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্যের। শাস্ত্রীয় রাগের চলন নিয়মতান্ত্রিকতায় হলেও সুর বৈচিত্র্যের নান্দনিক রূপ প্রকাশের জন্যে নজরুল অনেক সময় রাগ বহির্ভূত স্বরের প্রয়োগ করেছেন।
যেমন ” একি মধুর শ্যাম”।
রাগ : বৃন্দাবনী সারং, তাল : ত্রিতাল
গীতিশৈলী :
শাস্ত্রীয় সহীতের খেয়াল গানের মতোই নজরুলের খেয়াল গান পাঁচটি বিভাগে পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি ঘটে। প্রথমত, আলাপ, দ্বিতীয়ত, স্থায়ী ও অন্তরা পরিবেশন, তৃতীয়ত, বিস্তার, চতুর্থত তান এবং সর্বশেষ তেহাই। খেয়াল গানের গীতিশৈলীর সকল বৈশিষ্ট্যের রূপায়ন সম্ভব গায়কের গাইবার ক্ষমতা অনুসারে।
উপসংহার :
নজরুল যে সমস্ত খেয়াল গান রচনা করেছেন তার মধ্যে বিভিন্ন রাগের সমাবেশ ঘটিয়ে অধিকাংশ খেয়াল গানকেই আশ্চর্যভাবে তিনি রসোত্তীর্ণ করেছেন অথ খেয়ালের বিশেষ রূপটি কোথাও ব্যহত হয়নি। এখানেই নজরুল সৃষ্ট খেয়াল পর্যায়ের গানগুলি বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে।
আরও দেখুনঃ