Site icon Amar Nazrul [ আমার নজরুল ] GOLN

কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রকৃতি

কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রকৃতি

কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রকৃতি নিয়ে আজকের আলোচনা। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর রচিত সঙ্গীতগুলিতে চিরাচরিত বিভাগের বাইরে একটি বিভাগ সংযোজন করেছেন, যার মধ্যে আমরা পাই কবির নিজস্ব তথা সময় মানবমনের আনন্দ এবং ব্যথা যন্ত্রণার সন্ধান। কবি তর আপন মনের অনুভূতির সঙ্গে সমগ্র মানবমনের অনুভূতির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন প্রকৃতিকে।

 

 

কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রকৃতি

 

কবির ‘চিরজনমের সাথী’ আকাঙ্ক্ষিতের প্রতীক্ষায় তিনি প্রকৃতির সর্বত্র বিরাজিত। জন্ম জন্মান্তর ব্যাপী কবির এই অপেক্ষা। তাই শতজনমের পরও বসন্ত প্রকৃতির সঙ্গে একীভূত হয়ে গাঁথেন তাঁর আরাধ্যের জন্য বরণের মালা- থাকেন তারই অপেক্ষায়,- সে অপেক্ষা সর্বসমক্ষে নয়; তিনি আরাধ্যকে প্রেম নিবেদন করেন অতিগোপনে সকলের অলক্ষ্যে অবহেলিত সন্ধ্যামালতীর মতইঃ

“আমি সন্ধ্যামালতী বনছায়া অঞ্চলে
লুকাইয়া রই ঘন পল্লব তলে ॥
বিহগের গীতি ভ্রমরের গুঞ্জন নীরব হয় যখন
আমি চাঁদেরে তখন পূজা করি আঁখি জলে ‘

…বিরহী কবির অন্তরের অনুভূতিগুলের পূর্ণতা প্রাপ্তির অভাবের স্বাক্ষরবাহী গানগুলির ‘গানের বুলবুলি’, তাই-মধ্যে লক্ষিত হয় কবি হৃদয়ের গোপন যন্ত্রণার প্রকাশ। শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে’

“কণ্ঠে আমার নাই যে আগের কথার ভিড়
আলোয়ার এই আলোতে আসবে না কেউ কুল ভুলি।’

 

 

কবি-হৃদয়ের শূন্যতার বাণীবাহী গানগুলির মধ্যে পাই স্বজন হারানোর ব্যথার প্রকাশ- গঙ্গায় যে চিতা নিভে গেছে, সে চিতা কিন্তু কবির বুকে জাজ্বল্যমান। চাঁদের চোখে মেঘের ছায়া দেখে কবি অনুভব করেন তাঁর হারানো প্রিয়ার উপস্থিতি। প্ৰিয়া বুঝি ‘গভীর নিশীথের’ কণ্ঠলগ্না হয়ে শ্রান্ত আলুলায়িত কেশ নিয়ে কবির বুকে রোরুদ্যমানা (‘কেন মেঘের ছায় আজি চাঁদের চোখে’)। বিরহী কবির মনোবেদনা ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র প্রকৃতির বুকে। তাঁর দৃষ্টিতে সমগ্র প্রকৃতি আজ কবির সাথে শোকবিহুল। (‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়)।

বাস্তব জীবনে এত না পাবার যন্ত্রণা তবু কবির ‘মনোবনে কেন মালতী বল্লরীর দোলা লাগে, তা কবি নিজেই জানেন না। প্রকৃতির সকল আনন্দের সঙ্গে তাঁর মনও চঞ্চল হয়ে ওঠে। প্রকৃতির বুকের চঞ্চলতার যেমন অর্থ খুঁজে পান না করি, তেমনি তল পান না নিজের হৃদয়েরও (‘কেন মনোবনে মালতী বল্লরী দোলে’)। শুধুমাত্র মানবিক প্রেম ভালোবাসা আনন্দ বা দুঃখ নয়, প্রকৃতি প্রায়শ তাঁর সঙ্গীতের মধ্যে কবির আধ্যাত্মিক প্রেমের সঙ্গী।

সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের নিয়ন্তা পরমারাধ্য নটরাজের বীণার সুর শোনেন কবি প্রভাবত প্রকৃতিতে। তারই মনোমুগ্ধকর সুরে আবিষ্ট সমগ্র প্রকৃতি কবিরই সঙ্গে। সৃষ্টিকর্তার গভীর বাণী শোনেন কবি প্রভাত প্রকৃতির বীণার তারে সেই সুরকে ত্রিভুবন প্রণাম জানায়, তারই মোহিনী মায়ায় কবির ভাবগঙ্গা ‘মন্ত্রমুগ্ধা’, স্থির হয়েছে তার তরঙ্গ।

 

 

কালবৈশাখীর রূপে কবি প্রত্যক্ষ করেছেন মহাকালের রূপ, যিনি বহন করে আনেন। পরম আকাঙ্ক্ষিতের বারতা। সমস্ত বাধা দূর করে কবি ঝড়রূপী তাঁর প্রিয়তমের উদ্দেশ্যে যাত্রায় উদ্যত নিলিত হতে চান মহাকালের অশান্ত বুকে ঝরা পাতার মতই:

“নয়নের জল হেরিতে না পারি / বাহিরে গগনে ঝরে কত বারি। বন্ধ কুটিরে অন্ধ তিমিরে/ চেয়ে আছি কাহার পথ চাহি।

বন্ধু গো, ওগো ঝড়, ভাঙো ভাঙো দ্বার,/ তব সাথে আজি নব অভিসার,
ঝরা পল্লব-প্রায় তুলিয়া লহ আমায়/অশান্ত ও বক্ষে হে বিদ্রোহী ॥
(‘তরুণ অশান্ত কে বিরহী’)

পরম সুন্দর মহাকালের প্রলয় উৎসবের রূপকে প্রত্যক্ষ করেন কবি ঝড়ের মধ্যে। তাই হাসি কান্নার জীবন ছেড়ে মিলিত হতে চান সেই নিত্য নতুন পরমানন্দের সঙ্গে। যে উৎসবে বন তার ফুলের ডালা উজাড় করে ঢেলে দেয় দেবতার পায়ে, নীল আকাশে ছুটে আসে মেঘের রাশি, সাগরওঠে দুলে, বান ডাকে শীর্ণানদীর দুকুল ছাপিয়ে- এমন মহোৎসবের দিনে কবে কবির ডাক পড়বে, ছুটবে তাঁর ঘরের বাঁধন।

“হে পথিক, তব সুর অশান্ত বায়/ জন্মান্তর হ’তে যেন ভেসে আসে হায়। বিজড়িত তব স্মৃতি চেনা অচেনায়/প্রাণ-কাঁদানো।’ (“মেঘ-মেদুর গগন কাঁদে)

 

 

এতো পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার আকর্ষণ, যা কবিকে করে তোলে পার্থিব জীবনে বিরাগী। এমনই আবিষ্ট চিত্তে কবি চন্দ্রালোকিত পুর্ণিমারাতে দোলন-চাঁপা ফুলের সৌন্দর্যে দেখতে পান শ্রীকৃষ্ণের লীলার ইঙ্গিত। চাঁদের উপস্থিতিতে যেন শ্যামপল্লবরূপী কৃষ্ণের কোলে রাধার মিলন- লতার দোলনায় বাঁধা তাদের দোলনা। একই সঙ্গে অনেকগুলি স্বর্গীয় উপমা এনেছেন কবি দোলন চাপার রূপবর্ণনায় –

‘যেন দেব কুমারীর শুভ্র হাসি
ফুল হয়ে দোলে ধরায় আসি,
আরতির মৃদু জ্যোতি-প্রদীপ-কলি
দোলে যেন দেউল আঙ্গিনাতে ॥
… … …

ও যেন মুঠিভরা চন্দন গন্ধ
দোলেরে গোপিনীর গোপন আনন্দ
ও কিরে চুরি করা শ্যামের নূপুর
তন্দ্রা যামিনীর মোহন হাতে ॥’

প্রাকৃতিক পরিবেশ কবির হাতে রূপ নিয়েছে এক আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলীর। মহাকালের সঙ্গে মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষায় কবি যেমন কাতর, অপরদিকে অধ্যাত্মপ্রেম-সুরা দানকারী যে সাকী কবিকে পথ দেখান তাঁর চরমপ্রাপ্তির, তাঁরই পদচিহ্নে কবি দেখেন শুকনো পাতার আবর্জনা, যা যন্ত্রণা দেয় কবিকে।

 

 

কবির চারিপাশে এক হতশ্রীযুক্ত প্রকৃতির বর্ণনা- সেখানে গুলবাগিচা শূন্য, রাঙাগুলের বাজার শুধুই স্মৃতির কাঁটায় ছাওয়া, নেই বঁধুর জন্য বছর আসা যাওয়া- এ শুধুই ে কবি হৃদয়ের ভরাডুবির পথ বেয়ে চলা (‘শূন্য আজি গুলবাগিচা যায় কেঁদে যায় লখিন হাওয়া’)। প্রকৃতি গানটিতে কবির বিধ্বস্ত হৃদয়েরই পরিচয়বাহী, যেখানে প্রেম গেছে শুকিয়ে শুধুমাত্র কোনো ক্রমে ক্লান্ত পথিকের দিন যাপনের চিত্র।

আরও দেখুনঃ

Exit mobile version