নজরুল সঙ্গীতে রাগ নির্ভরতা, নজরুলের আশ্চর্য মহত্তর কৃতিত্ব, সঙ্গীতস্রষ্টা নজরুলের জীবনে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় হলো রাগ-সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর ভক্তি ও নিষ্ঠা। রাগ-রাগনীর প্রয়োগ ও ব্যবহারে নজরুল তাঁর অনুপম সৃজনীশক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। পাশাপাশি নজরুল সঙ্গীতে সেসব রাগের প্রয়োগরীতিতে শাস্ত্রীয় পদ্ধতি কোথাও না লঙ্ঘন করে, তিনি মহত্তর কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। পূরবী, বেহাগ, বা জয়জয়ন্তী, যে-কোনো রাগের ক্ষেত্রেই তার চলন, সুরবিস্তার প্রভৃতি সঠিক ভাবে পালন করেছেন। শিল্পীমনের নতুন সৃষ্টির প্রেরণায়, তিনি প্রচলিত রাগ-রাগিনীর রূপান্তর না ঘটিয়ে, নতুন নতুন রাগ সৃষ্টি করে নিয়েছেন।
নজরুল সঙ্গীতে রাগ নির্ভরতা নিয়ে কথা বলতে হলে আমাদের নজরুলকৃত নবরাগমালিকা দেখতে হবে। খেয়াল করবেন সেগুলো সম্পূর্ণ শাস্ত্রসম্মত এবং কবি সেগুলির যাবতীয় পরিচয় প্রদান করে গেছেন। দুই-তিনটি প্রচলিত রাগকে যে মুন্সীমায়নায় মিশ্রিত করে তিনি নতুন সুরের মেজাজ সৃষ্টি করেছেন, তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ভরিয়া পরাণ শুনিতেছি গান’ বেহাগ ও বসন্তের মিশ্রণে অপরূপ সুষমায় মণ্ডিত হয়েছে।
নজরুল-কৃত নবরাগ প্রসঙ্গে প্রথমে ধরা যাক, ‘দোলন চাঁপা’ রাগিণীর কথা। এখানে হাম্বীর কামোদ ও নট, তিনটি রাগের রূপই মাঝে মাঝে উঁকি দেয়। রাগের চঞ্চল গতির কারণে ঐ আভাস স্থায়ী হয় না। আরোহী স্বর সা গা হ্মা পা, গামা না ধা, পা, না, ধার্সা, অবরোহণে ব্যবহৃত হয়েছে সা না ধাণা, ধাণা ধা পা হ্ম পা গা মা গা মা রা সা। ধৈবত ও ষড়জ, যথাক্রমে বাদী ও সম্বাদী।
কবিকল্পনায় রাগটির মাধুর্য চাঁপাফুলের সুরভির মতো তীব্র এবং সেখানেই নামকরণের সার্থকতা। এই তীব্র সুরভি হ্মা, গা মা না ধা ব্যবহারে প্রকাশিত। অনুরূপভাবে ‘মীনাক্ষী; রাগিনীতে নীলাম্বরী, কাফি আভাস পাওয়া যায়। রাগিনীতে মীনের বক্র ও চঞ্চল গতি ফুটে ওঠে অবরোহনে কোমল ধৈবতোর মাধ্যমে ঘেঁষা গান্ধারের ব্যবহারে।
নজরুলের গান শুধু গান নয়, রাগ-রাগিনীর উদাহরন দেবার জিনিসও বটে। কাজী সাহেব রাগ-রাগিনীর এই বৃহৎ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন বিভিন্ন সূত্রে। গ্রামোফোন কোম্পানিতে তিনি ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খানের সান্নিধ্যে আসেন এবং কার্যত তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মুর্শিদাবাদ-নিবাসী ওস্তাদ কাদের বক্স ও মঞ্জু সাহেবের নিকটও তিনি বহু রাগ-রাগিনী আয়ত্ত করেন। ঠাকুর নবাব আলী চৌধুরী প্রণীত সঙ্গীত-পুস্তক থেকে তিনি বহু অপ্রচলিত ও লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিনীর হদিশ পান।
উদাহরণ হিসাবে লংকাদহন সারং রাগটি ধরা যায়। এই রাগে নজরুল রচনা করেন ‘অগ্নিগিরি ঘুমন্ত উঠিল জাগিয়া’ গানটি। একইভাবে রচিত হল ‘মেঘবিহীন খর বৈশাখে” গানটি সাবন্ত নারং রাগে। এই পথে আহরিত হয় বিরাট ভৈরব, দরবারী টোড়ী, বড়হংস সারং, দেবগান্ধার প্রভৃতি রাগ। এ ছাড়া প্রথম শ্রেণীর শ্রুতিধর হওয়ার ফলে অনেক অনুপম নজরুলসঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছে।
সে যুগের বিখ্যাত অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের গাওয়া ‘নীলাম্বরী’ রাগের বিখ্যাত গান শুনে তিনি রচনা করলেন ‘নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায় কে যায় গানটি। ‘কাবেরী তীরে’ ও ‘হরপ্রিয়া’ নামে দুটি বেতারগীতি আলেখ্যে তিনি গানটি যুক্ত করেন। পরবর্তীকালে কবির পরিচালনায় ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র রেকর্ডে গানটি পরিবেশন করে অবিনশ্বর মর্যাদা দান করেছেন।
নজরুল সঙ্গীতে রাগ নির্ভরতা, নজরুলের আশ্চর্য মহত্তর কৃতিত্ব:
কয়েক হাজার নজরুলসঙ্গীতে শতাধিক রাগ-রাগিনীর ব্যবহৃত হয়েছে। প্রচলিত, লুপ্তপ্রায় এবং স্ব-কৃত রাগ-রাগিনীর অঞ্জলিতে তিনি সাজিয়েছিলেন দেবী সুরেশ্বরীর বরণডালা। এ এক বিস্ময়কর নজীর রাগভিত্তিক বেশ কিছু নজরুলসঙ্গীত বাংলাগানের শ্রোতাদের কাছে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে :
- শুন্য এ বুকে পাখি মোর’ (ছায়ানাট)
- ‘শ্মশানে জাগিছে, শ্যামা’ (কৌশিকী)
- ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারী (আহির ভৈরব)
- ‘কুহু কুহু, কোয়েলিয়া’ , (খাম্বাজ)
- ‘কারেবী নদীজলে কে গো বালিকা’ (কণৰ্টী সামস্ত)
- ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’ (মান্দ)
- ‘আজি ও শ্রাবণ নিশি’ (মিয়া মল্লার)
- ভোরের হাওয়ায় এলে (রামকেলি)
- ‘গুঞ্জমালা গলে’ (মালগুঞ্জি)
- ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি (হিজাজ ভৈরবী)
- ‘রুমঝুম রুমঝুম’ (পিলু)
সঙ্গীত-শিক্ষক নজরুলের অভিনব শিক্ষা-পদ্ধতিতে কোনো গোঁড়ামি ছিল না। তিনি শিল্পীর গান শুনে তার গায়ন-রীতি বা অধিকারটুকু বুঝে নিয়ে তার উপযোগী গান দিতেন। শিল্পীর সকটুকু উৎকর্ষ তিনি গানের মধ্যে আদায় করে নিতেন। জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, শচীন দেববর্মণ, মৃণালকান্তি ঘোষ, শ্রীমতী ইন্দুবালা, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র প্রমুখ শিল্পীরা স্ব-স্ব রীতিতে জ্যোতিষ্মান।
নজরুল এঁদের প্রত্যেকের গানে অলঙ্করণ পদ্ধতির বিভিন্নতায় তাঁদের শিল্পী মেজাজের স্বাধীনতাকে সুযোগ দিয়েছেন পরিপূর্ণ গায়কী আদায়ের জন্য। শচীনবাবুর ‘পদ্মার ঢেউরে’ বা ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’, মৃণালকান্তির ‘বলরে জবা বল’ বা ‘মহাকালের কোলে এসে’ এবং শ্রীমতী ইন্দুবালার ‘কেন আন ফুলডোর’ ‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’ গানের চালে দুস্তর ব্যবধান। অনুমান করা কঠিন যে সবগুলিই নজরুলের সৃষ্টি। আবার তাঁর সঙ্গীতজীবনের শেষ পর্বের বিশিষ্ট শিল্পী শৈলদেবীর গাওয়া গানে আমরা পাই আরেক নজরুলকে।
১৯২২-৪২ এই কুড়ি বছরে নজরুল যে কত শিল্পীকে দিয়ে তাঁর গান রেকর্ড করিয়েছেন তা সঠিকভাবে নিরুপণ করা সম্ভব নয়। একটি আংশিক তালিকা থেকেই নজরুলসঙ্গীতের বৈচিত্র্যের আভাস পাওয়া যাবে-ললিত মুখোপাধ্যায়, কে মল্লিক, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ, গোস্বামী, উমাপদ ভট্টাচার্য, ধীরেন দাস, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, শচীন
দেববর্মণ, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, মৃণালকাস্তি ঘোষ, রত্মেশ্বর মুখোপাধ্যায়, হিমাংশু দত্ত, কমল দাশগুপ্ত, গিরীন চক্রবর্তী, চিত্ত রায়, সত্য চৌধুরী, সত্যেন ঘোষাল, জনন্ময় মিত্র, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সন্তোষ সেনগুপ্ত, দ্বিজেন চৌধুরী, গোপাল সেন, সুনীল ঘোষ, ইন্দুবালা, আঙুরবালা, হরিমতী, কমলা (ঝরিয়া), রাধারাণী, বীণাপানি (মধুপুর), শৈল দেবী, ইলা ঘোষ, দীপালি নাগ, সুপ্রভা সরকার, যূথিকা রায়, কানন দেবী, মড্ কস্টেলো, পারুল দাস (কর), গীতা মিত্র, বিজন ঘোষ দস্তিদার, কুসুম গোস্বামী, প্রতিভা বসু (সাহিত্যিক), দীপ্তি বন্দোপাধ্যায়, কল্যাণী দাস প্রমুখ।
নজরুল সঙ্গীতে লুপ্ত রাগের ব্যবহার :
‘হারামণি’ এবং ‘নবরাগ মালিকা’ এই দুই পর্যায়ে লুপ্ত, অর্ধলুপ্ত এবং নতুন সৃষ্ট রাগে নজরুল যে গানগুলি রচনা করেছেন, সেগুলি সঙ্গীতজ্ঞ নজরুলের অসামান্য কৃতিত্ব বহন করছে। বাংলা সঙ্গীতে সুরের দীনতা কবিকে পীড়া দিয়েছিল, তাই তিনি সমৃদ্ধির দিকে বিশেষরূপে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। আধুনিক গানে সুরে সমতার অভাবও কবিকে বেদনাহত করেছিল। তিনি লিখেছেন, “আধুনিক (মর্ডাণ) গানের সুরের মধ্যে আমি যে অভাবটি সবচেয়ে বেশি অনুভব করি তা হচ্ছে ‘সিমিট্রি [Symmetry]’ (সামঞ্জস্য) বা ইউনিফরমিটি’র [ uniformity ] (সমতা) অভাব। কোনো রাগ বা রাগিণীর সঙ্গে অন্য কোনো রাগ বা রাগিণীর মিশ্রণ ঘটাতে হলে সঙ্গীতশাস্ত্রের যে সুক্ষ্ম জ্ঞান বা রসবোধের প্রয়োজন তার অভাব আজকালকার অধিকাংশ গানের সুরের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে এবং ঠিক কারণেই আমার নূতন রাগ-রাগিণীর সৃষ্টির এবং অপ্রচলিত রাগ-রাগিণী উদ্ধারের প্রচেষ্টা।”
একেবারে লুপ্ত হয়ে যাওয়া বা লুপ্তপ্রায় রাগ-রাগিণীগুলি উদ্ধার করে কবি সেই সুরে ‘হারামণি’ পর্যায়ের গানগুলি রচনা করেন। ‘হারামণি’ নামকরণটি ইঙ্গিতবহ হয়েছে সন্দেহ নেই। এ পর্যায়ের কয়েকটি গানের সুর ও প্রথম কলির উল্লেখ করছি : বসন্ত মুখারী-বসন্ত মুখর আজি, আনন্দী-দূর বেণকুঞ্জে মূরলী মুহু মুহু, শিবরঞ্জী-হে পার্থসারথি বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ, লঙ্কদহন সারং-আগ্নিগিরি ঘুমন্ত উঠিল জাগিয়া, পঠমঞ্জরী-আমি পথ মঞ্জরী ফুটেছি আঁধার রাতে, কর্ণাট সামন্ত-কাবেরী নদী জলে কে গো বালিকা, নীলাম্বরী নীলাম্বরী শাড়ী পরি নীল যমুনায়, নারায়ণী-নারায়ণী ঊষা খেলে হেসে, সিংহেন্দ্র মাধ্যমা, পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে, বাঙাল বিলাবল ইত্যাদি। অনন্ত গৌড়, মালগুঞ্জ, আহরী ভৈরব, আনন্দ ভৈরব, উমা তিলক, শৃঙ্গার বিরহাগ্নি রক্তহংস সারং ইত্যাদি রাগ হারামণি পর্যায়ের।
স্বল্প পরিচিত খাড়ব জাতীয় কাফি ঠাটের লঙ্কদহন সারং, খাম্বাজ ঠাটের ওড়ব খাড়র জাতীয় নারায়ণী, কাফি ঠাসের পঠমঞ্জরী রাগগুলি বৈশিষ্ট্যের দাবী রাখে। হারামণি পর্যায়ে যে রাগগুলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার অনেকগুলিই দক্ষিণ ভারতীয় এবং এগুলি বাংলায় অপ্রচলিত। এদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রাগ হলো নীলম্বারী, সিংহেন্দ্র মধ্যমা, কণটী সামস্ত, সাবন্ত সারং ইত্যাদি।
নজরুল সঙ্গীতে সম্পর্কে আরও পড়ুন: