তুবড়ি বাঁশির ডাক প্রবন্ধ [ দুর্দিনের যাত্রী ] কাজী নজরুল ইসলাম

তুবড়ি বাঁশির ডাক প্রবন্ধটি কাজী নজরুল ইসলাম এর “দুর্দিনের যাত্রী” নামক প্রবন্ধ সংগ্রহশালার অংশ :

ওই শোনো –

পুব সাগরের পার হতে কোন্ এল পরবাসী।

শূন্যে বাজায় ঘন ঘন

হাওয়ায় হাওয়ায় শনশন

সাপ খেলাবার বাঁশি।

 

বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো বিবর থেকে ‘অগ্নি-বরণ নাগ-নাগিনি’ তোমাদের নিযুত ফণা দুলিয়ে। ওই শোনো, সাপুড়ের তুবড়ি বাঁশির ডাক ‘ঘন ঘন হাওয়ায় হাওয়ায় শনশন শনশন’! এসো আমার বিষধর কাল-কেউটের দল! তোমাদের বিবর ছেড়ে বেরিয়ে এসো বেরিয়ে এসো এই দিনের রৌদ্র সিন্ধু-কূলে। তটিনী-তীরের কেতকী কুসুমে কুসুমে জড়িয়ে আছে যারা, কেয়ামূলের গোপন তলে আত্মগোপন করে আছে যারা, সেই নাগ-নাগিনিদেরে মনসার পূজা-বেদি হতে আজ ডাক এসেছে।

 

তুবড়ি বাঁশির ডাক প্রবন্ধ [ দুর্দিনের যাত্রী ] Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]
Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]

[ তুবড়ি বাঁশির ডাক প্রবন্ধ [ দুর্দিনের যাত্রী ] কাজী নজরুল ইসলাম ]

 

ওই শোনো তাঁর দূত বাজায়, ‘ঘন ঘন হাওয়ায় হাওয়ায় শনশন শনশন।’ তোমাদের আদিমাতা অগ্নিনাগিনি আজ গগনতলে বেরিয়ে এসেছে তার পুচ্ছে কোটি কোটি নাগ-শিশু খেলা করছে, ওই শোনো তার ডাক ঘনঘন শনশন! ওই শোনো সাপুড়ের গভীর গুরুগুরু ডম্বরু-রব। তারই রবে বিপুল উল্লাসে পুচ্ছ সাপটি উঠেছে দিকে দিকে নাগপুরে নাগ-নাগিনি, অধীর আবেগে বাসুকির ফণা দুলে দুলে উঠছে – বিসুবিয়াসের বিপুল রন্ধ্র দিয়ে তার নাসার বিষ-ফুৎকার শুরু হয়েছে।

বেরিয়ে এসো – বেরিয়ে এসো ; বিবরের অন্ধকার হতে এই রৌদ্রদগ্ধ তপ্ত দিবালোকে হে আমার বিষধর কাল-ফণীর দল। তোমাদের বিষ-দাঁতের ছোবলে ছোবলে ধরণি জর্জরিত হয়ে উঠুক, তোমাদের অত্যুগ্র নিশ্বাসে নিশ্বাসে আকাশ তাম্রবর্ণ হয়ে উঠুক, বাতাসে বাতাসে জ্বালাদগ্ধ অগ্নি-দাহন হু-হু-হু-হু করে ছুটে যাক, তোমাদের কর্কশ পুচ্ছে জড়িয়ে বসুমতীর টুঁটি টিপে ধরো।

 

Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]
Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]

তোমাদের বিষ-জরজর পুচ্ছকে চাবুক করে হানো – হানো – মারো এই মরা নিখিলবাসীর বুকে মুখে। বিষের রক্ত-জ্বালায় তারা মোচড় খেয়ে খেয়ে একবার শেষ আর্তনাদ কর উঠুক। খসে খসে পড়ুক তাদের রক্ত-মাংস-অস্থি তোমাদের বিষ-তিক্ত চাবুকের আঘাতে আঘাতে।

গর্জন করো, গর্জন করো আমার হলাহলশিখ ভুজঙ্গ শিশুর দল! বিপুল রোষে তোমরা একবার ফণা তুলে তোমাদের পুচ্ছের উপর ভর করে দাঁড়াও, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠুক শুধু তোমাদের নিযুত কাল-ফণা। আকাশে-বাতাসে দুলুক শুধু তোমাদের নাগ-হিন্দোল। পাতালপুরের নিদ্রিত অগ্নিসিন্ধুতে ফুঁ দাও, ফুঁ দাও – ফুঁ দিয়ে জ্বালাও তাকে। আসুক নিখিল অগ্নিগিরির বিশ্ব-ধ্বংসী অগ্নিস্রাব, ভস্মস্তূপে পরিণত হোক এ-অরাজক বিশ্ব। ভগবান তার ভুল শোধরাক। এ খেয়ালের সৃষ্টিকে, অত্যাচারকে ধ্বংস করতে তোমাদের কোটি ফণা আস্ফালন করে ভগবানের সিংহাসন ঘিরে ফেলুক। জ্বালা দিয়ে জ্বালাও জ্বালাময় বিধি ও নিয়মকে।

এসো আমার অগ্নি-নাগ-নাগিনির দল! তোমাদের পলক-হারা রক্ত-চাওয়ার জাদুতে হিংস্র পশুর রক্ত হিম করে ফেলো, তোমাদের বিপুল নিশ্বাসের ভীম আকর্ষণে টেনে আনো ওই পশুগুলোকে আমাদের অগ্নি-অজগরের বিপুল মুখগহ্বরে। আকাশে ছড়াও হলাহল-জ্বালা, নীল আকাশ পাংশু হয়ে উঠুক!

 

Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]
Kazi Nazrul Islam [ কাজী নজরুল ইসলাম ]

রবি-শশী-তারা গ্রহ-উপগ্রহ সব বিষ-দাহনে নিবিড় কালো হয়ে উঠুক, বাতাস খুন-খারাবির রঙে রেঙে উঠুক। বিদ্যুতে –বিদ্যুতে তোমাদের অগ্নি-জিহ্বা লকলক করে নেচে উঠুক, বৈশাখী-ঝড়ের দোলায় দোলায় গর্জনে গর্জনে তোমাদের শ্বাস-হুংকার ফুঁসে ফুঁসে উঠুক। ঢালো তোমাদের সঞ্চিত বিষ ওই মহাসিন্ধু নদনদীর বারি-রাশির মাঝে – টগবগ করে ফুটে উঠুক এই বিপুল জলরাশি – আর তার বুকে তোমাদের বিষ-বিন্দু বুদ্‌বুদ্ হয়ে ভেসে বেড়াক।

আজ ‘ভাসান’-উৎসবের দিন। মনসার পূজা-বেদিতে তোমাদের সঞ্চিত বিষ উদ‍্গীরণের আহ্বান এসেছে। এসো – এই ধূমকেতু-পুচ্ছের অযুত অগ্নি-নাগ-নাগিনির মাঝে কে কোথায় আছ কোন্ বিবরের অন্ধকারে লুকিয়ে, হে আমার পরম প্রিয় বিষধর কালফণীর দল! এই অগ্নিনাগ-বাসে তোমাদেরও বিষ-চক্র-লাঞ্ছিত ফণা এসে মিলিত হোক, তোমাদের বিষ-নিশ্বাস-প্রশ্বাসে ধূমকেতুর-ধূম আরও – আরও ধূমায়িত হয়ে উঠুক।

ওই শোনো – শোনো

ঘন ঘন শন শন

সাপ খেলাবার বাঁশি।

 

আরও পড়ুন:

Leave a Comment