কাজী নজরুলের প্রবন্ধঃ নজরুলের প্রবন্ধের সংখ্যা নগণ্য। ‘নবযুগ’ ও ধূমকেতু’ পত্রিকায় তাঁর যে-সব প্রবন্ধ সম্পাদকীয় স্তম্ভে দেখা দিয়েছিল, তাদেরই কতকগুলি সামান্য পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত আকারে স্থান পেয়েছে ‘যুগবাণী’, রুদ্রমাঙ্গল’, ‘দুর্দিনের যাত্রী’ গ্রন্থগুলিতে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ‘ধূমকেতু’ ও অন্যত্র প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধ ও পত্র নিয়ে ‘ধূমকেতু’ নামে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ বেরিয়েছে। এর কয়েকটি প্রবন্ধ ‘রুদ্রমঙ্গল’ ও ‘দুর্দিনের যাত্রী’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এসব ছাড়াও অবশ্য তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধ আছে।
কাজী নজরুলের প্রবন্ধ । নজরুলের ভাবনা
নজরুলের প্রবন্ধগুলি মননশীলতার অবাবহেতু অতিমাত্রায় ভাবপ্রবণ এবং উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও রূপকে কণ্টকিত। তবে তাঁর ভাষার পৌরুষ ও অকৃত্রিম ভাবাবেগে অনেকস্থলেই চমকৃত হতে হয়। অনেক প্রবন্ধ সংবাদপত্রের তাগাদা মেটানোর জন্যে। রচিত ব’লে সময়াভাবে অযত্নবিন্যস্ত। তাঁর ভাষার পৌরুষ অনেক ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দের পদ্যরচনাকে মনে না করিয়ে দিয়ে পারে না।
কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দের রচনায় তাঁদের অন্ত-পুরুষের যে বহিঃপ্রকাশ ও সাম্বত-সত্তার যে ছায়াপাত ঘটেছে, নজরুলের ক্ষেত্রে তা বহু জায়গাতেই অনুপস্থিত। নজরুলের কোনো কোনো রচনা অবাঞ্ছিতমাত্রায় প্রচারমূলক। এ-সব সত্ত্বেও নজরুলের কয়েকটি রচনা তাঁর ব্যক্তিমানসের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনসমালোচনার জন্যে মূল্যবান। তাই এক বিশেষ ধরনের আবেগ ও পৌরুষসমন্বিত গদ্যপ্রণয়নে তাঁর স্থান উপেক্ষণীয় নয়।
গদ্যরচনায় নজরুল যাদের সমধর্মী তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সখারাম গণেশ দেউস্কর (১৮৬৯-১৯১২) ও ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় (১৮৬১- ১৯০৭)। ‘ধূমকেতু’ লিখিত নজরুলের প্রবন্ধাবলির অনেক জায়গা ‘সন্ধ্যা’য় প্রকাশিত ব্রহ্মাবান্ধবের রচনাগুলিকে মনে করিয়ে দেয়।
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, জ্বলন্ত দেশপ্রেম। এবং মানুষের প্রতি অবিচল ভালোবাসা ও বিশ্বাস গণেশ দেউস্কর ও ব্রহ্মবান্ধবের রচনাকে আঙ্গিকশৈথিল্য ও প্রকরণ-উদাসীনতা সত্ত্বেও যে প্রাণস্পর্শী আবেদনে ঐশ্বর্যশালী করেছে, নজরুলের রচনাতেও তার উপস্থিতি বিরল নয়।
নজরুলের রচনার সবচেয়ে বড় ত্রুটি মননশীলতার স্বল্পতা ও শিল্পসৌষ্ঠব সম্পর্কে আবেগপ্রাবল্যজনিত। উদাসীনতা ও অসতর্কতা। তাঁর রচনার শ্রেষ্ঠ গুণ যৌবনধর্ম, অর্ন্তমুখী ভাবাবেগের অকৃত্রিমতা ও কাব্যধর্মী ওজস্বিতা। কোনো কোনো রচনায় তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে রোমান্টিক ভাবাদর্শের বিবাহ-বন্ধনে অসামান্য শক্তি ও উদ্দীপনা সব্বারিত।
প্রধানত সাংবাদিকতার উদ্দেশে রচিত হলেও নজরুলের কতকগুলি প্রবন্ধ যে সাময়িকতার গণ্ডি পেরিয়ে আজও টিকে আছে তাতে অবশ্যই সাহিত্যগুণের অগ্রান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। কেননা, রবার্ট লিও (Robert Lynd ) বলেছেন, “Literature is journalism that lasts. ”
আরও দেখুনঃ