Site icon Amar Nazrul [ আমার নজরুল ] GOLN

আমায় আর কতদিন মহামায়া – কাজী নজরুল ইসলাম (রাঙা-জবা) নজরুল সঙ্গীত

আমায় আর কতদিন মহামায়া – কাজী নজরুল ইসলাম (রাঙা-জবা) নজরুল সঙ্গীত

আমায় আর কতদিন মহামায়া গানটি “রাঙা-জবা” গ্রন্থের একটি শ্যামাসঙ্গীতে। ১০০টি শ্যামাসঙ্গীতে সমৃদ্ধ রাঙা-জবা গ্রন্থটি প্রকাশ করেন ২৪ পরগনার রাজীবপুরের বেগম মরিয়ম আজিজ। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ ১ বৈশাখ ১৩৭৩ শুক্রবার ( এপ্রিল, ১৯৬৬ )। মূল্য তিন টাকা। নজরুল নিজের জীবনে তন্ত্র ও যোগাসাধনা করেছেন। শক্তিপূজায় তাঁর ভক্তহৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা ও আর্তি এইসব গানের মধ্যে রূপায়িত।

আমায় আর কতদিন মহামায়া

(আমায়) আর কতদিন মহামায়া রাখ্‌বি মায়ার ঘোরে।
(মোরে) কেন মায়ার ঘূর্ণিপাকে ফেল্‌লি এমন করে।।
(ওমা) কত জনম করেছি পাপ
কত লোকের কুড়িয়েছি শাপ,
তবু মা তার নাই কি গো মাফ ভুগব চিরতরে।।
এমনি ক’রে সন্তানে তোর ফেল্‌লি মা অকূলে,
তোর নাম যে জপমালা তাও যাই হায় ভুলে’।
পাছে মা তোর কাছে আসি
তাইবাঁধন দিলি রাশি রাশি,
কবে মুক্ত হ’ব মুক্তকেশী (তোর) অভয় চরণ ধ’রে।।

আমায় আর কতদিন মহামায়া স্বরলিপি:

নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত:

হালিশহরের সাধক-কবি রামপ্রসাদ সেনের পরে নজরুলই একমাত্র কবি যিনি প্রায় ২৪৭টির মত শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন। অন্য এক সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও হিন্দুর আরাধ্যা একজন দেবীর গুণকীর্তণ করার জন্য কেন তিনি এত গান রচনা করলেন, জানতে কৌতুহল হয়। প্রতিটি গানের কী অসাধারণ শব্দবিন্যাস। ‘ভক্তি আমার ধুপের মত উর্দ্ধে ওঠে অবিরত’ বা ‘মার হাসি মুখ চিত্তে ভাসে চন্দ্রসম নীলাকাশে’। এই গানেরই আরও কয়েকটা লাইনের উল্লেখ করলে কাজী সাহেবের লেখনীর মধ্যে ভক্তিভাবের আভাস পাওয়া যাবে। ‘অন্তরলোক শুদ্ধ হল পবিত্র সেই ধুপসুবাসে (ইসলাম ধর্মে একমাত্র মৃত্যুর পরেই ধুপের ব্যবহার করা হয়) / সব কিছু মোর পুড়ে কবে চিরতরে ভষ্ম হবে, মার ললাটে আঁকব তিলক সেই ভষ্মবিভূতিতে’। শোনা যায়, তিনি ছিলেন কালীভক্ত।

পারিবারিক নানা প্রতিবন্ধকতা নজরুলকে আরও বেশি কালীনির্ভর করে তুলেছিল। স্ত্রী প্রমীলা কাজীর স্থায়ি আরোগ্য এবং পুত্র বুলবুলের মুত্যু তাঁর মনকে আরও দুর্বল করে তোলে। মুর্শিদাবাদে লালগোলা বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার বরদাচরণ মজুমদার ছিলেন তন্ত্রসাধক। তিনিও ছিলেন কালীভক্ত। তাঁর যোগবলে তিনি কাজী সাহেবের মৃত ছেলে বুলবুলকে দেখাতে পারবেন, এই কথা শোনার পরে নজরুল তাঁর কাছে দীক্ষা নেন। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কালীসাধনা করতেন। বিষয়টার মধ্যে কোনও হ্যালুশিনেসন ছিলো কিনা জানা যায় নি। স্ত্রীর শারীরিক সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য তিনি কোথায় না গেছেন? পীরের দরগা থেকে ওষুধ সংগ্রহ করেছেন, বিভিন্ন মন্দির থেকেও দৈব্ ওষুধ নিয়ে আসতেন। সেই কারণে একবার তিনি বিশিষ্ট কথা-সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের (তারাশঙ্করও ছিলেন তন্ত্রসাধক) কাছে গিয়েও ওষুধ নিয়ে আসেন।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

কালীভক্ত এবং সাধক হওয়ার জন্য নজরুল বামাক্ষ্যাপার কাছেও গিয়েছিলেন। তবে শ্যামা মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও নির্ভশীলতা না থাকলে কিন্তু শুধুমাত্র বাহ্যিক ঘটনার প্রভাবে এমন আত্মনিবেদনের গান লেখা সহজ নয়। শ্যামাসংগীতের যে দর্শন, তা তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধী করেছিলেন। শুধু গান লিখেই থেমে থাকেননি। সেই সব গানে সুরারোপও করেছেন। ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা’ গানটিতে কাজী সাহেব মালকোষ রাগাশ্রীত সুর করেছিলেন। কী অদ্ভুত দর্শন গানের প্রতিটি ছত্রে। ‘জ্বলিয়া মরিবি কে সংসার জ্বালায়, তাহারে ডাকিছে মা কোলে আয়, কোলে আয়, জীবনে শ্রান্ত ওরে ঘুম পাড়াইতে তোরে, কোলে তুলে নেয় মা মরণেরও ছলে।’

তাঁর সৃষ্টিতে তিনি দেবী কালীকাকে তিনরকমভাবে দেখেছিলেন। কন্যারূপে, মাতৃরূপে এবং অশুভনাশিনীরূপে। ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ গানটিতে শ্যামার কন্যারূপকেই প্রত্যয় করা যাবে। এই গানেরও একটি লাইনের উল্লেখ করতে ইচ্ছা করছে। ‘পাগলী মেয়ে এলোকেশী নীশিথিনির দুলিয়ে কেশ, নেচে বেড়ায় দিনের চিতায় লীলার যে তার নাইকো শেষ। / সিন্ধুতে মার বিন্দুখানিক ঠিখরে পড়ে রূপের মানিক, বিশ্বে মায়ের রূপ ধরেনা, মা আমার তাই দিগবসন’।

এই গানে কাজী সাহেব শ্যামা মায়ের কন্যা এবং মাতৃরূপকেই প্রকাশ করেছেন। তাঁর চেতনায় মাকে শুধুমাত্র দর্শন আর তত্ত্বের মধ্যে আটকে না রেখে করে তুলেছেন ঘরের মেয়ে। পারবারিক প্রতিবন্ধকতা আর অপার কালীভক্তি যে বিদ্রোহীকবিকে কখন কালীসাধকে পরিণত করেছিল তা বোধহয় তিনি নিজেও জানতে পারেননি। অবশ্য এই সব প্রসঙ্গ কি ১৯৭৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে উৎসাহী কিছু মানুষ প্রকাশ করেছিলেন না বাস্তবে ঘটেছিল সেই বিষয়ে কিছু বিতর্ক রয়ে গেছে কিন্তু ইসলামী সংগীত রচনার পাশাপাশি একাধিক বৈষ্ণবকীর্তণ, গজল, শ্যামাসংগীত যে রচনা করেছিলেন তা নিয়ে কোনও বিতর্ক থাকার কথা নয়। সেই সব শ্যামাসংগীত যে অত্যন্ত উঁচু দরের এবং উৎকৃষ্ট সে বিষয়ও কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

 

আরও দেখুন:

Exit mobile version