সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ কবিতাটি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর সিন্ধু হিন্দোল কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে । সিন্ধু হিন্দোল কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ । ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থে মোট ১৯টি কবিতা রয়েছে। কাব্যগ্রন্থটি “বাহার ও নাহার”-কে (হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও শামসুন নাহার) উৎসর্গ করেন।

সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ কবিতা
হে সিন্ধু, হে বন্ধু মোর, হে চির-বিরহী, হে অতৃপ্ত! রহি’ রহি’ কোন্ বেদনায় উদ্বেলিয়া ওঠ তুমি কানায় কানায়? কি কথা শুনাতে চাও, কারে কি কহিবে বন্ধু তুমি? প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে উর্ধ্বে নীলা নিম্নে বেলা-ভুমি! কথা কও, হে দুরন্ত, বল, তব বুকে কেন এত ঢেউ জাগে, এত কলকল? কিসের এ অশান্ত গর্জন? দিবা নাই রাত্রি নাই, অনন্ত ক্রন্দন থামিল না, বন্ধু, তব! কোথা তব ব্যথা বাজে! মোরে কও, কা’রে নাহি ক’ব! কা’রে তুমি হারালে কখন্? কোন্ মায়া-মণিকার হেরিছ স্বপন? কে সে বালা? কোথা তার ঘর? কবে দেখেছিলে তারে? কেন হ’ল পর যারে এত বাসিয়াছ ভালো! কেন সে আসিল, এসে কেন সে লুকালো? অভিমান ক’রেছে সে? মানিনী ঝেপেছে মুখ নিশীথিনী-কেশে? ঘুমায়েছে একাকিনী জোছনা-বিছানে? চাঁদের চাঁদিনী বুঝি তাই এত টানে তোমার সাগর-প্রাণ, জাগায় জোয়ার? কী রহস্য আছে চাঁদে লুকানো তোমার? বল, বন্ধু বল,
ও কি গান? ওকি কাঁদা? ঐ মত্ত জল-ছলছল- ও কি হুহুঙ্কার? ঐ চাঁদ ঐ সে কি প্রেয়সী তোমার? টানিয়া সে মেঘের আড়াল সুদূরিকা সুদূরেই থাকে চিরকাল? চাঁদের কলঙ্ক ঐ, ও কি তব ক্ষুধাতুর চুম্বনের দাগ? দূরে থাকে কলঙ্কিনী, ও কি রাগ? ও কি অনুরাগ? জান না কি, তাই তরঙ্গে আছাড়ি’ মর আক্রোশে বৃথাই? মনে লাগে তুমি যেন অনন্ত পুরুষ আপনার স্বপ্নে ছিলে আপনি বেহুঁশ! অশান্ত! প্রশান্ত ছিলে এ-নিখিলে জানিতে না আপনারে ছাড়া। তরঙ্গ ছিল না বুকে, তখনো দোলানী এসে দেয়নি ক’ নাড়া! বিপুল আরশি-সম ছিলে স্বচ্ছ, ছিলে স্থির, তব মুখে মুখ রেখে ঘুমাইত তীর।– তপস্বী! ধেয়ানী! তারপর চাঁদ এলো-কবে, নাহি জানি তুমি যেন উঠিলে শিহরি’। হে মৌনী, কহিলে কথা-“মরি মরি, সুন্দর সুন্দর!” “সুন্দর সুন্দর” গাহি’ জাগিয়া উঠিল চরাচর! সেই সে আদিম শব্দ, সেই আদি কথা, সেই বুঝি নির্জনের সৃজনের ব্যথা, সেই বুঝি বুঝিলে রাজন্ একা সে সুন্দর হয় হইলে দু’জন!… কোথা সে উঠিল চাঁদ হৃদয়ে না নভে সে-কথা জানে না কেউ, জানিবে না, চিরকাল নাহি-জানা র’বে। এতদিনে ভার হ’ল আপনারে নিয়া একা থাকা, কেন যেন মনে হয়-ফাঁকা, সব ফাঁকা কে যেন চাহিছে মোরে, কে যেন কী নাই, যারে পাই তারে যেন আরো পেতে চাই! জাগিল আনন্দ-ব্যথা, জাগিল জোয়ার, লাগিল তরঙ্গে দোলা, ভাঙিল দুয়ার, মাতিয়া উঠিলে তুমি! কাঁপিয়া উঠিল কেঁদে নিদ্রাতুরা ভূমি! বাতাসে উঠিল ব্যেপে তব হতাশ্বাস, জাগিল অন্তত শূন্যে নীলিমা-উছাস! বিস্ময়ে বাহিরি এল নব নব নক্ষত্রের দল, রোমাঞ্চিত হ’ল ধরা, বুক চিরে এল তার তৃণ-ফুল-ফল। এল আলো, এল বায়ু, এল তেজ প্রাণ, জানা ও অজানা ব্যেপে ওঠে সে কি অভিনব গান! এ কি মাতামাতি ওগো এ কি উতরোল! এত বুক ছিল হেথা, ছিল এত কোন! শাখা ও শাখীতে যেন কত জানাশোনা, হাওয়া এসে দোলা দেয়, সেও যেন ছিল জানা কত সে আপনা! জলে জলে ছলাছলি চলমান বেগে, ফুলেহুলে চুমোচুমি-চরাচরে বেলা ওঠে জেগে! আনন্দ-বিহ্বল সব আজ কথা কহে, গাহে গান, করে কোলাহল!
বন্ধু ওগো সিন্ধুরাজ! স্বপ্নে চাঁদ-মুখ হেরিয়া উঠিলে জাগি’, ব্যথা ক’রে উঠিল ও-বুক। কী যেন সে ক্ষুধা জাগে, কী যেন সে পীড়া, গ’লে যায় সারা হিয়া, ছিঁড়ে যায় যত স্নায়ু শিরা! নিয়া নেশা, নিয়া ব্যথা-সুখ দুলিয়া উঠিলে সিন্ধু উৎসুক উন্মুখ! কোন্ প্রিয়-বিরহের সুগভীর ছায়া তোমাতে পড়িল যেন, নীল হ’ল তব স্বচ্ছ কায়া! সিন্ধু, ওগো বন্ধু মোর! গর্জিয়া উঠিল ঘোর আর্ত হুহুঙ্কারে! বারেবারে বাসনা-তরঙ্গে তব পড়ে ছায়া তব প্রেয়সীর, ছায়া সে তরঙ্গে ভাঙে, হানে মায়া, উর্ধ্ব প্রিয়া স্থির! ঘুচিল না অনন্ত আড়াল, তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদি সাথে কাল! কাঁদে গ্রীষ্ম, কাঁদে বর্ষা, বসন্ত ও শীত, নিশিদিন শুনি বন্ধু ঐ এক ক্রন্দনের গীত, নিখিল বিরহী কাঁদে সিন্ধু তব সাথে, তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে প্রিয়া রাতে! সেই অশ্রু-সেই লোনা জল তব চক্ষে — হে বিরহী বন্ধু মোরা — করে টলমল! এক জ্বালা এক ব্যথা নিয়া তুমি কাঁদ, আমি কাঁদি, কাঁদে মোর প্রিয়া।

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।
সিন্ধু হিন্দোল কাব্যগ্রন্থ এর অন্যান্য কবিতাঃ
- সিন্ধুঃ প্রথম তরঙ্গ
- সিন্ধুঃ দ্বিতীয় তরঙ্গ
- সিন্ধুঃ তৃতীয় তরঙ্গ
- গোপন প্রিয়া
- অনামিকা
- বিদায় স্মরণে
- পথের স্মৃতি
- উন্মনা
- অতল পথের যাত্রী
- দারিদ্র্য
- বাসন্তি
- ফাল্গুনী
- মঙ্গলাচরণ
- বধু-বরণ
- অভিযান
- রাখী-বন্ধন
- চাঁদনী-রাতে
- মাধবী-প্রলাপ
- দ্বারে বাজে ঝঞ্জার জিঞ্জির